‘বাঙালির মূল্য কমছে, তাই বাংলা ভাষারও মূল্য নেই। বাঙালি যদি তার নিজের মূল্য বুঝতো, তাহলে অবশ্যই নিজের ভাষারও মূল্য বুঝতো।’ বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
সমাজ এবং বুদ্ধিজীবিতা প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছেন । দীর্ঘ আলোচনায় ভাষা ও সংস্কৃতির বিষয়েও আলোকপাত করেন এই গবেষক। গণমানুষ যখন তার অধিকার হারা হয়ে যায়, তখন ভাষা-সংস্কৃতি এমনিতেই মার খেয়ে যায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্রিক সংকটের অবতারণা করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বিশেষ দিবসগুলো যখন বাণিজ্যিক আবরণে ঢেকে যায়, তখন নিজের মাতৃভাষা এবং সংস্কৃতির দুর্দশা টের পাওয়া যায়। আমরা এই অবনমন সর্বত্রই দেখতে পাচ্ছি। শিক্ষায় ইংরেজি ভার্সন জরুরি করে তোলা হচ্ছে। অথচ বাংলা ভাষার চর্চা নিয়ে গুরুত্ব নেই। মহামারির সময় স্কুলগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ। অথচ কওমি মাদরাসাগুলো খোলা রাখা হয়েছে। দিবস পালনের এমন রীতি বা শিক্ষার এমন নীতি মাতৃভাষাবিরোধী বলে আমি মনে করি।’ সভ্যতার যে সংকট চলছে তার জন্য মূলত পুঁজিই দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভাষা সংস্কৃতির আজকের এই সংকট মূলত পুঁজিবাদের কারণেই। মানুষের মূল্য কমে যাচ্ছে। আর বাঙালির মূল্য আরও কমছে। বাঙালির মূল্য কমছে বলেই বাংলা ভাষার মূল্য নেই। বাঙালি যদি তার নিজের মূল্য বুঝতো, তাহলে অবশ্যই তার নিজের ভাষারও মূল্য বুঝতো।’
সংকট উত্তরণের পরামর্শ দিয়ে এই ইমেরিটাস অধ্যাপক বলেন, ‘সমাজের যে কাঠামো তা অতিসত্বর বদলাতে হবে। পুঁজির যে কাঠামো, তা গোটা বিশ্বকে গ্রাস করছে। গ্রাস করছে আমদের চিন্তা-চেতনাকেও। কথিত উন্নয়নে চাপা পড়ছে মানবিক উন্নয়ন। মানুষের চিন্তার উন্নয়ন নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। রাষ্ট্র, সমাজ এমনকি ব্যক্তিবিশেষও মানুষের চিন্তার জায়গাকে সংকুচিত করে দিচ্ছে। গণমানুষ যখন তার অধিকার হারা হয়ে যায়, তখন ভাষা-সংস্কৃতি এমনিতেই মার খেয়ে যায়। এই অবনতি দুনিয়ার সর্বত্রই। বাঙালিকে হয়তো আরও বেশি ঠেকতে হচ্ছে।’
‘সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতির সঠিক পর্যবেক্ষণ যদি করেন, দেখবেন, প্রতিটি রাষ্ট্র গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। বৈষম্য, হিংসা, সংঘাত আবশ্যক করে তুলছে পুঁজি। সমাজের গুটিকয়েক মানুষ অঢেল সম্পত্তির মালিক হচ্ছে। অন্যরা গরিব থেকে গরিব হচ্ছে। মৌলিক অধিকারও পাচ্ছে না। বাকস্বাধীনতা বা নিজস্ব ভাষার মধ্য দিয়ে ভাবের প্রকাশও মৌলিক অধিকার। সে অধিকার খর্ব হচ্ছে প্রতি মূহূর্তে’Íবলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তার মতে, রাষ্ট্র এবং পুঁজির ভাষা জনগণের ভাষা থেকে আলাদা হতে হবে। জনগণের ভাষা মূলত সমাজকে রক্ষা করবে। এই সত্য উলবব্ধি করতে না পারলে সমূলে হারাতে হবে আমাদের।