রাজধানীর সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে একটি প্রকল্পের আওতায় রিমোট কন্ট্রোলারসহ ১০৯টি স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল স্থাপন করা হয়েছিল। এরমধ্যে ৯৮টি বিকল হয়ে পড়েছে। ১১টি সচল থাকলেও সেগুলোর কোনও কাজ নেই।
প্রকল্প শেষ হওয়ার মাত্র দেড় বছরের মধ্যে বাতিগুলোর এমন পরিণতির কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এতে প্রকল্পের পুরো অর্থই বিফলে গেছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্প ও রাস্তা খোঁড়াখুড়ির কারণে সিগনালগুলোর ভূগর্ভস্থ ক্যাবল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াতেই এমন সমস্যা হয়েছে। তাছাড়া এগুলো পরিচালনার জন্য এখনও পুলিশের দক্ষ জনবলও প্রস্তুত হয়নি।
প্রকল্পের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্পের আওতায় দক্ষিণ সিটি এলাকায় ৫৩টি সিগনাল বাতি স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে মৌচাক, মালিবাগ মোড়, মালিবাগ রেলক্রসিং ও শান্তিনগর ট্রাফিক সিগনালগুলো আংশিক অচলাবস্থায় থাকলেও নীলক্ষেত, বেইলী রোড, রমনা থানা, ঝিগাতলা, ইবনে সিনা হাসপাতাল, ধানমণ্ডি ১৫, টয়েনবি সার্কুলার রোড, আরামবাগ ও কাঁঠালবাগান সিগনাল পুরোপুরি অকার্যকর রয়েছে। সাত মসজিদ রোড (শংকর), ধানমণ্ডি ২৭, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল ও মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় ফুটপাত উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নে সিগনালের ভূগর্ভস্থ ক্যাবল, কন্ট্রোলার ও পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেট্রোরেলের অ্যালাইনমেন্টভুক্ত হওয়ায় অপসারণ করা হয়েছে দৈনিক বাংলা ও মতিঝিলের জনতা ব্যাংক সিগনাল।
বিভিন্ন সেবা সংস্থার রাস্তা খনন ও উন্নয়নমূলক কাজের কারণে রাস্তা বন্ধ রয়েছে যেসব এলাকার সেগুলো হলো- কাকরাইল মসজিদ, মৎস্য ভবন, জিরো পয়েন্ট, রাসেল স্কোয়ার, ধানমণ্ডি ১০, ধানমণ্ডি ৬,৭ ইন্টারসেকশন, সায়েন্স ল্যাব, বাটা সিগনাল, কাঁটাবন (সোনারগাঁও রোড), ফকিরাপুল, গুলিস্তান রাসেল স্কোয়ার, কাকরাইল (ইনার সার্কুলার রোড), গোলাপশাহ মাজার, নিউ মার্কেট, ধানমণ্ডি ২৭, রাজারবাগ, পান্থপথ, গ্রিনরোড, আজিমপুর (ইডেন কলেজ), পলাশি, অতীশ দীপঙ্কর রোড, কমলাপুর রোড, পীরজঙ্গি মাজার, বিজয়নগর, বাহাদুর শাহ পার্ক, ইংলিশ রোড, বংশাল রোড, ধোলাইখান (নয়াবপুর রোড) ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন।
রাস্তা একমুখী হওয়ার কারণে জহির রায়হান রোড ও ইত্তেফাক ইন্টারসেকশনে থাকা সিগনালের বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি অপসারণ করা হয়েছে। নিউ ইস্কাটন রোড (বাংলামটর), মিন্টু রোড (হোটেল শেরাটন), কদম চত্বর, কার্জন হল, শাহবাগ ও তোপখানা ও শাপলা চত্বর সিগনাল মেট্রোরেলের অ্যালাইনমেন্টভুক্ত হওয়ায় বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি অপসারণ করা হয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ৩৫টি সিগনালের মধ্যে মগবাজার ও সাতরাস্তা (টঙ্গী ডাইভারশান রোড) ইন্টারসেকশন সচল রয়েছে। সনি সিনেমা হল মোড়, মিরপুর থানা, মিরপুর প্রশিকা, শিয়ালবাড়ী (রূপনগর), বনানী-১১, বনানী-১৭, গুলশান বাড্ডা লিংক রোড, আবুল হোটেল ও ঢাকা ডেন্টাল কলেজ সিগনাল সড়ক ও উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নের কারণে ভূগর্ভস্থ ক্যাবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জসিম উদ্দিন মোড় ও আব্দুল্লাহপুর মোড়ের সিগনালগুলো বি আরটি প্রকল্পের কারণে অপসারণ করা হয়েছে।
মেট্রোরেলের কারণে অপসারণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল কনভেশন সেন্টার, মিরপুর-১০ ও মিরপুর ৬-এর সিগনাল। ডিএনসিসির ইউলুপ প্রকল্পের কারণে অপসারণ করা হয়েছে হাউজ বিল্ডিং মোড় ও বনানী ২৭-এর সিগনাল।
আসাদ গেট, মানিক মিয়া এভিনিউ, গুলশান-২, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিজয় সরণি (র্যাংগস), কলেজ গেইট, দারুস সালাম, জাহাঙ্গীর গেট ও মিরপুর মাজার রোডের সিগনাল সচল রয়েছে। মোহাম্মদপুর থানা ইন্টারসেকশনটি সচল থাকলেও পুলিশ সেটি বন্ধ রেখেছে। মেট্রোরেলের কারণে আরও অপসারণ করা হয়েছে আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, হোটেল সোনারগাঁও ও খামারবাড়ীর সিগনাল। ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড প্রকল্পের জন্য অপসারণ করা হয়েছে মহাখালী রেলক্রসিং ও গুলশান-১ ইন্টারসেকশন ডিটিসিএ’র সিগনাল।
জানা গেছে, নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০১-২০০২ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের (ডিইউটিপি) মাধ্যমে ৭০টি ইন্টারসেকশনে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগনাল স্থাপন করা হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যমান ৭০টি ইন্টারসেকশনে ট্রাফিক সিগনালগুলোর উন্নয়ন, সচলকরণসহ ট্রাফিক সিগনাল পরিচালনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রকল্পটির আওতায় আরও ২৯টি ইন্টারসেকশনে নতুন ট্রাফিক সিগনাল স্থাপন কাজ বাস্তবায়ন হয়।
প্রকল্পে অতিরিক্ত অর্থায়নের আওতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাকার ৪৩টি ইন্টারসেকশনে পুনরায় ট্রাফিক সিগনাল সচল করা হয়। কাজটি ২০১৯ সালের ২০ মার্চ শেষ হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়নকৃত সিগনালগুলো পুলিশের কাছে হস্তান্তরের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত রয়েছে। এ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ২০১৪ সালের ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত ৩৯তম সভায় সিগনালগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পুলিশের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। যার ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ৭ এপ্রিল স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব প্রকল্পের মেয়াদ শেষে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম ঢাকা মহানগর পুলিশ-এর কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেন।
২০১৯ সালের ২৫ মার্চ এক সভায় ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহমেদ জানান, ঢাকায় বিদ্যমান স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগনালগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ এখনও প্রস্তুত নয়। এর জন্য বিশেষায়িত জনবলের প্রয়োজন।
ইতোমধ্যেই ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের জন্য ৩৯ জনের একটি টেকনিক্যাল ইউনিট গঠনের প্রস্তাব সরকার অনুমোদন করেছে। এই জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হতে আরও এক বছর লাগবে। এটি সম্পন্ন হলে সিগনালগুলো বুঝে নেওয়া সম্ভব হবে বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে প্রকল্পের সর্বশেষ পরিচালক ও ডিএসসিসির নগর পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্প শেষ হওয়ার শেষ তিন মাসে আমি দায়িত্ব পালন করেছি। এর আগে যিনি দায়িত্বে ছিলেন তিনি অবসরে গেছেন। প্রকল্পের আওতায় কয়টি সিগনাল বাতি স্থাপন করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব দফতরে রক্ষিত ছিল না। বর্তমানে যেগুলো আছে সেগুলো ডিএসসিসির বিদ্যুৎ বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন সিগনালগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকার্যকর রয়েছে।’ তবে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে পুনরায় সচল করা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক, নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, প্রকল্পটি গ্রহণের আগে দেখার দরকার ছিল তা ঢাকার বাস্তবতায় কতটা গ্রহণযোগ্য। প্রথমবার যখন সিগনাল বাতিগুলো চালু করতে সমস্যা হয়েছে, দ্বিতীয়বার সেই প্রকল্পে আবার অর্থায়ন করার আগে আরও গবেষণার দরকার ছিল।-বাংলাট্রিবিউন