দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। দেশের প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ ভোগ্যপণ্যের আমদানি ও সরবরাহ হয় এ বাজার থেকে। কিন্তু লকডাউন শুরুর পর থেকে এ বাজারের সঙ্গে সারা দেশের সরবরাহ ব্যবস্থায় ছেদ পড়ে। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি হলেও খালাস, সরবরাহ ও আমদানি প্রক্রিয়ার মধ্যবর্তী সময়ে বন্দর-কাস্টমসে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় যথাসময়ে পণ্য পাচ্ছে না বাজারগুলো। এতে প্রায় প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। শবে বরাত শেষ হওয়ায় রোজার সময় ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। এ সময়ে পণ্যবাজারকে সবদিক থেকে সহায়তা না দিলে পণ্যের সংকট তৈরির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি চলছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ায় ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থাপনায়ও সমস্যা তৈরি হয়েছে। ফলে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরবরাহ চেইনের অব্যবস্থাপনা দূর করে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বিশেষ নজর দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সরবরাহ ও আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা দূর না হলে দেশব্যাপী খাদ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতার শঙ্কাও প্রকাশ করছেন তারা।
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, চলমান লকডাউন কর্মসূচিতে নগদে লেনদেন হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে লেনদেনের সময়সীমা কমে যাওয়া, রেশনিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকের শাখা চালু রাখা, আমদানি পণ্যের জাহাজীকরণ, খালাস ও সরবরাহের দীর্ঘসূত্রতা পণ্যবাজারে সংকট বাড়িয়ে তুলছে। গত দুদিন খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের পাইকারি বাজারগুলোতে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, চাল, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল, মসলা, গম, শুকনো খাবার, পচনশীল মসলাসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাজারের আচরণকে অস্বাভাবিক মনে করছেন খোদ ব্যবসায়ীরাও। তাদের দাবি, টাকা দিয়েও অনেকে নিত্যপণ্য সংগ্রহ করতে পারছেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। এছাড়া সরবরাহ সংকট থাকায় স্থানভেদে পণ্যের দামের ভিন্নতাও দেখা গেছে।
বাজার সূত্রে দেখা গেছে, কয়েক দিনের ব্যবধানে চালের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। সপ্তাহের ব্যবধানে মসুর ডালের দাম কেজিপ্রতি ১৫-২০ টাকা বেড়েছে। ছোলার দাম মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) দাম ২৫০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫৫০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। সাধারণ ছুটির আগে বস্তাপ্রতি (৫০) চিঁড়ার দাম ছিল ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা। সম্প্রতি চিঁড়ার দাম অস্বাভাবিক বেড়ে ২ হাজার ৭০০ টাকায় উঠে গেছে। বেড়েছে আলুর দামও। কেজিপ্রতি ৫-৭ টাকা বেড়ে ১৮-১৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে আলু। এক সপ্তাহ আগেও পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩২ থেকে ৩৫ টাকা। সর্বশেষ শুক্রবার পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৭০ টাকা। এছাড়া প্রায় দ্বিগুণ দামে আদা বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ২৮০ টাকায়, রসুনের দাম ২০ টাকা বেড়ে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে গমের মণপ্রতি দাম (রাশিয়ান) প্রায় ১০০ টাকা বেড়ে এক হাজার টাকায় লেনদেন হয়েছে। এছাড়া কানাডা থেকে আমদানীকৃত গমের দামও সমপরিমাণ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১৫০ টাকায়। চিনির দাম মণপ্রতি ৫০ টাকা বেড়ে লেনদেন হচ্ছে ২ হাজার টাকায়। পাশাপাশি ভোজ্যতেলের দাম মণপ্রতি ৩০-৪০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৪০০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। এদিকে শুকনা মরিচের দাম কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে ২৪০ থেকে ২৮০ টাকায় (মানভেদে), শুকনো আস্ত হলুদের দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে ১১৫ টাকায়, জিরা প্রায় ৫০ টাকা বেড়ে ৪০০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ভোগ্যপণ্য আমদানির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, সংঘনিরোধ কেন্দ্র, বিএসটিআই, পরমাণু শক্তি কমিশনসহ সরকারি আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত বন্ধ রয়েছে। তবে বর্তমানে সীমিত পরিসরে খোলা ও আমদানির কাগজপত্র যাচাই অনুমোদনের সুযোগ তৈরি হলেও তা যথেষ্ট নয়। তাছাড়া নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চট্টগ্রাম কাস্টমসের লোকবল অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকিং লেনদেনের সময়সীমার কারণে পণ্য আমদানির পরও যথাসময়ে খালাস এবং গুদাম ও পাইকারি বাজারে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বন্দরে খালাস না হওয়ায় জাহাজগুলো জরিমানাও গুনতে হচ্ছে। এতে পণ্যের দামেও প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামের শীর্ষ এক আমদানিকারক বলেন, বিশ্বের সিংহভাগ দেশ থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে নভেল করোনাভাইরাসের কারণে আমদানি প্রক্রিয়া কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে। পাশাপাশি আমাদের দেশেও আমদানির পর খালাস ও সরবরাহ প্রক্রিয়ায় ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার পণ্য আমদানি না করেও বেসরকারি পর্যায় থেকে পণ্য সংগ্রহ করে (চাল ছাড়া) ত্রাণ হিসেবে বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। শ্রমিক সংকটের কারণে গম ও ডালজাতীয় পণ্যের ক্রাশিং কমে এসেছে। শ্রমিক সংকটে খালাসে সময় বেশি লাগা এবং পরিবহনের ক্ষেত্রেও কিছুটা বিলম্ব হওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। দেশে পর্যাপ্ত ভোগ্যপণ্য আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সরকারি সহযোগিতা বাড়ানো না গেলে স্বাভাবিকভাবেই কৃত্রিম সংকট তৈরি হবে। এতে দাম বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে মনে করছেন তিনি। শুক্রবার ভোগ্যপণ্য আমদানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সরকারি সংস্থাগুলো খোলা রেখে ব্যবসায়ীদের সেবা দেয়ার দাবি জানিয়েছে দেশের অন্যতম ব্যবসায়ী সংগঠন দ্য চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (সিসিসিআই)। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে দেয়া ওই চিঠিতে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত সরকারি অফিসগুলোর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক কার্যালয় খোলা রাখার দাবি জানানো হয়। সিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, সারা দেশে সব ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, জরুরি ওষুধ ও কাঁচামাল ইত্যাদি আমদানি ও সারা দেশে সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। ফলে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে প্রধান আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় খোলা রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। না হলে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকরা প্রয়োজনীয় সরকারি অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হবেন। এছাড়া বিআরটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর, জ্বালানি খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা না হলে আসন্ন রোজায় ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের অস্থিরতার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় দীর্ঘ সময় ধরে রেশন ও ত্রাণ দেয়ার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু আমদানি প্রক্রিয়া অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ধীরগতিতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে ভোগ্যপণ্যের আমদানি, খালাস, বাজারজাত, পরিবহন ও সরবরাহে সহযোগিতা সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করছেন তারা। খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সেকান্দর বলেন, সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ কার্যক্রম ছাড়াও আসন্ন রোজার কারণে পাইকারি বাজারে ক্রেতাদের চাপ অনেক বেশি। বিকাল ৫টায় বিক্রি বন্ধ হয়ে গেলেও সরবরাহ কার্যক্রম চালু থাকায় সর্বশেষ বুধবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাতুনগঞ্জের একাধিক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। তাছাড়া সন্ধ্যার পরও ডাল ক্রাশিং মিল চালু রাখার অপরাধে বেশ কয়েকটি মিলকে জরিমানা করেছে প্রশাসন। ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার ও ক্রাশিং মিলগুলোকে ছাড় না দিলে পণ্যের বাজারে সরবরাহ সংকট দেখা দিতে বাধ্য। এমনিতে মিলগুলো শ্রমিক সংকটে সক্ষমতার অর্ধেক ডাল মিলিং করছে। এর ওপর প্রশাসনের চাপে অনেকেই মিল বন্ধ করে দিতে পারেন, যা বাজারের সাম্প্রতিক সংকট আরো বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম আট মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ভোগ্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টন। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্দর দিয়ে দেশে নিত্য ভোগ্যপণ্য (চাল ছাড়া) আমদানি হয়েছে ৭২ লাখ ৭ হাজার ২৭ টন। উল্লেখযোগ্য নিত্যপণ্যের মধ্যে গম আমদানি হয়েছে ৪৯ লাখ ৪০ হাজার টন, মসুর ডাল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৫৪ হাজার টন, ছোলা ২ লাখ টন এবং পাম অয়েল আমদানি হয়েছে ৯ লাখ ৯১ হাজার টন। এই সময়ে আগের অর্থবছরের তুলনায় গম বেশি আমদানি হয়েছে প্রায় ১২ লাখ টন, মসুর ডাল বেশি আমদানি হয়েছে ৪১ হাজার টন, ছোলা বেশি আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টন এবং পাম অয়েল ৪০ হাজার টন বেশি আমদানি হয়েছে। এইচ আর/ খবরপত্র