করোনাভাইরাস সংক্রমণ মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। করোনা আক্রান্ত রোগীদের প্রয়োজনীয় কাক্সিক্ষত চিকিৎসা নিশ্চিত করা অনেকের জন্যই প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে যাদের আইসিইউতে রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন হয় ওই রোগী ও তার পরিবারকে পড়তে হচ্ছে বড় ধরনের সমস্যায়। এমনও হচ্ছে যে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) একটি বেড পেতে ৫০টি হাসপাতালে খুঁজতে হচ্ছে। এছাড়া হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সঙ্কট তো আছেই। একটি জাতীয় গণমাধ্যমের সাংবাদিক তার ফেসবুক পোস্টে আইসিইউর সঙ্কট বুঝাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘এক রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত আরেক রোগীকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে আইসিইউতে একটি বেড পাওয়ার জন্য।’ অর্থাৎ ঢাকার হাসপাতালগুলোতে আইসিইউতে কোনো বেড খালি নেই। একজন রোগীর সুস্থ হওয়া কিংবা মৃত্যুর পরই কেবল একটি আইসিইউ বেড খালি হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতালে ভর্তি ও সুচিকিৎসা পেতে রাজধানীতে এক প্রকার হাহাকার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন রোগীর স্বজনরা। আর সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় আক্রান্তদের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা।
লকডাউনের কারণে রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাতায়াতেও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে রোগীর পরিবারের সদস্যদের। সাধারণত রোগী সুস্থ হলে অথবা মৃত্যু বরণ করলেই যেহেতু কোনো একটি আইসিইউ বেড খালি হয়, তাই রোগী বাড়তে থাকায় আইসিইউ সঙ্কট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। কঠোর লকডাউনেও সংক্রমণ খুব একটা কমেনি। অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের ১৫ এপ্রিলের বুলেটিনের তথ্যে বলা হয়েছে, সারাদেশে মোট ৮২৫টি আইসিইউ বেডের (শয্যা) মধ্যে ৬৫২টিতে রোগী ভর্তি আছে। খালি আছে ১৭৩টি আইসিইউ বেড।
কিন্তু আক্রান্তদের স্বজনরা অনেকে বলেছেন, ঢাকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগীর জন্য প্রয়োজন হলেই একটি আইসিইউ শয্যা পাওয়া কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষ বা মধ্যবিত্ত, যারা সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বেড খোঁজেন তাদের জন্য এ সঙ্কট আরো প্রকট বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকার বড় একটি বেসরকারি হাসপাতালের সহকারী সুপারেনটেনডেন্টের শাশুড়ি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। ওই কর্মকর্তা শত চেষ্টা করেও শাশুড়ির জন্য একটি আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তার শাশুড়ি মারা গেছেন। এটি গত সপ্তাহের ঘটনা।
ঢাকার ইব্রাহীম মজিদ নামের এক ব্যক্তি জানান, তিন দিন আগে তার মায়ের জন্য একটি আইসিইউ বেড জোগাড় করতে সরকারি বেসরকারি প্রায় ৫০টি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হয়েছে। পরিবার, বন্ধু-বান্ধবের সহযোগিতায় প্রায় সাত ঘণ্টার চেষ্টায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা হয়। বিবিসি বাংলাকে মজিদ বলেন, সাধারণ মানুষের জন্য এ এক বিরাট সঙ্কট।
তার বর্ণনায়, ‘আমার মা কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিন্তু অক্সিজেন লেভেল অনেক কমে যাওয়ায় তার আইসিইউ প্রয়োজন হয়। ডাক্তার এসে যখন বলে যে তার আইসিইউ প্রয়োজন, কিন্তু ওখানে খালি নেই। তখন বিভিন্ন জায়গায় কল দেয়া হয়। সরাসরি কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েও খোঁজ করা হয়। এ সময় কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না।’ ওই সময়ের ভোগান্তির কথা তুলে ধরে মজিদ বলেন, তখন পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে ফোন করা হয়। প্রায় সাত ঘণ্টার চেষ্টায় তারা একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইইউ বেড পেয়ে ওইখানে তার মাকে ভর্তি করেন।
তার ভাষায়, ‘কিছু আইসিইউ আছে কিন্তু সেন্ট্রাল অক্সিজেন বা সার্বক্ষণিক পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা পাই। পরে কথা বলে জেনেছি ৫০টির মতো হাসপাতালে যোগাযোগ করা হয়েছিল।’
বাংলাদেশে এখন সংক্রমণ হার ২০ ভাগের ওপরে। প্রতিদিন পাঁচ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। অনেকের জন্যই হাসপাতালে হাই ফ্লো অক্সিজেন সুবিধা প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু পাওয়া সহজ নয়।
স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়তি চাপ: ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন সেবিকা রুমানা খাতুন বলেন, ‘আমি যে কেবিনে ডিউটি করতেছি সেখানে ৩০টি বেড আছে। ৩০টি বেডেই কন্টিনিউ (সব সময়) রোগী থাকতেছে। কমতেছে না রোগী।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই বাড়তি রোগীর কারণে আমাদের নার্সদেরও বেশ চাপের মধ্য পড়তে হয়েছে। এটাও বাস্তবতা যে বেড খালি না থাকায় অনেক সময় নতুন রোগী আসলে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।’
ঢাকার বেসরকারি আরেকটি হাসপাতালে রোগী ভর্তি ও ছেড়ে দেয়ার দায়িত্বে থাকা সাজেদা আক্তার মনি বলেন, প্রতিদিনই করোনার অনেক রোগী আসে। বেশির ভাগ রোগীই ফেরত দিতে হয়। হাসপাতালে করোনা ইউনিটে কোনো বেড খালি নেই। তিনি আরো বলেন, একটি বেড খালি হলে অন্তত পাঁচজনের তদবির থাকে রোগী ভর্তির। প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ জন কোভিড রোগী সিট খালি না থাকায় ফেরত দিতে হচ্ছে বলেও জানান সাজেদা আক্তার। এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যু ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে শুধু এপ্রিল মাসের ১৫ দিনেই এক হাজারের বেশি রোগীর মৃত্যু হয়েছে। আর প্রতিদিনই এই সংখ্যা এক শ’ ছুঁই ছুঁই করছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রিটেনসহ ভাইরাসের নতুন কয়েকটি ভ্যারিয়ান্ট বা ধরন বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে সম্প্রতি। এর সাথে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এতে বিপুল সংখ্যক রোগীর হাসপাতালে অক্সিজেন এমনকি আইসিইউ সুবিধার প্রয়োজন পড়ছে বলে জানা যাচ্ছে। কোভিড ডেডিকেডেট একটি সরকারি হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ইশান জাহান বলেন ‘এখনকার অবস্থায় যেটা হচ্ছে যে রোগীর অক্সিজেন লেভেল ভালো আছে। কথা বলছে। এরকম অবস্থায় হঠাৎ করে রোগী বলছে যে আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের ট্রিটমেন্ট শুরু করার সুযোগ অনেক সময় রোগী দিচ্ছেন না। অল্প সময়ের মধ্যেই রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে মারাও যাচ্ছে।’
এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ দিলেও প্রথম সপ্তাহে একেবারেই ঢিলেঢালাভাবে সেটি পালিত হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় সর্বাত্মক লকডাউনের শুরুতে কঠোরতা দেখা যাচ্ছে। তবে পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা সাধারণ মানুষ এখনো অনুধাবন করতে পারছেন না বলে অনেকে মনে করেন।
স্বাস্থ্যকর্মী ইশান জাহান বলেন, ‘আসলে এটা খুবই দুঃখজনক যে সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারছেন না পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক। যখন একজন রোগী নিয়ে হাসপাতালে যান তখন ওই ব্যক্তিই বুঝেন যে হাসপাতালের একটা সিট পাওয়ার জন্য একটা অক্সিজেনের সিলিন্ডারের জন্য একটা আইসিইউ বেডের জন্য কী পরিমাণ হাহাকার চলছে।’
সূত্র: বিবিসি