বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা সরবরাহের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বাখরাবাদ, কর্ণফুলীসহ যেসব কোম্পানি সরবরাহ ব্যবস্থার শুরুতেই তুলে নিতে পারছে, তিতাস গ্যাস পাচ্ছে তাদের পর। ফলে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় গ্যাসের যে সংকট, চট্টগ্রাম অঞ্চলের কারখানাগুলোয় সে সংকট নেই বললেই চলে। এছাড়া চলতি মৌসুমে বৃষ্টি কম হয়েছে। এ কারণে কৃষককে সেচ ব্যবহার করতে হচ্ছে। এ মুহূর্তে কৃষকের প্রয়োজনে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে।
বর্তমানে চলছে কৃষি ও সেচ মৌসুম। এ সময় কৃষকের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা, যা মেটাতে দেশে এখন বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এতে ব্যবহার হচ্ছে বিপুল পরিমাণ গ্যাস। সব মিলিয়ে বর্তমানে গ্যাসের সরবরাহ থাকলেও তার চাপ ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে গ্যাসের চাপ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংকটের মধ্যে রয়েছে তিতাস।
তিতাস সূত্র বলছে, গ্যাসের সরবরাহ ব্যবস্থার শুরুর দিকের অংশগুলোয় আগেই বেশি পরিমাণ গ্যাস তুলে নেয়া হয়। অন্যদিকে গ্যাস সরবরাহ পাইপের নির্ধারিত সক্ষমতা রয়েছে। এর কম সরবরাহ হলে যতই চাপ দেয়া হোক, সঞ্চালন সম্ভব হয় না। অন্যদিকে এখন সার উৎপাদনেরও ভরা মৌসুম। এরও প্রধান উপকরণ বা কাঁচামাল হলো গ্যাস। এ সার কারখানাগুলোতে বিপুল পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ ও ব্যবহার হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৮ থেকে ২০২০ পর্যন্ত উপদেষ্টা কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে তিতাস থেকে পাঁচ হাজারের ওপরে নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। এটা বড় ধরনের গ্যাসের চাহিদায় চাপ সৃষ্টি করেছে। ফলে সামগ্রিক প্রেক্ষাপটেই গ্যাসের সংকট রয়েছে তিতাসের। এছাড়া গ্রীষ্ম ও সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গ্যাসের সরবরাহ ঠিক থাকলে অন্য খাতে গ্যাস সংকট হবে, তা আগেই জানিয়েছিল গ্যাস কোম্পানিগুলো। তারই অংশ হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী ইকবাল মোহাম্মাদ নূরুল্লাহ বলেন, গ্যাসের প্রেশার না পাওয়া মূলত লোড ম্যানেজমেন্টের সমস্যা। চাপ না পাওয়ার বিষয়টি ব্যবসায়ীরা আমাদের জানিয়েছেন। সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ শুরু করেছি। চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব সমস্যা সমাধান করার। তিতাসের একটি সূত্র বলছে, সংস্থাটি চাহিদামাফিক সরবরাহ পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, যে পরিমাণ এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে সেটি পর্যাপ্ত নয়। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে এ ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এর বাইরে তিতাসের গ্যাসের চাপ বাড়াতে বিভিন্ন পয়েন্টে ওয়েলহেড কম্প্রেশার মেশিন বসানো হয়। কিন্তু কূপ থেকে গ্যাস পাওয়া না গেলে ওয়েলহেড কম্প্রেশার বসিয়ে লাভ নেই।
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসের প্রেশার কম পাওয়া নিয়ে জিটিসিএলকে জানিয়েছিল তিতাস। এরপর চাপ বাড়াতে জিটিসিএল দুই সপ্তাহ আগে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় পিকিং (গ্যাসের সঞ্চালন লাইন পরিষ্কার) করে। এর পর থেকে জিটিসিএলের গ্যাস সঞ্চালন স্বাভাবিক রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিতাস কর্তৃপক্ষ গ্যাস সংকট নিরসনে আশাবাদ জানালেও তেমন কোনো পরিকল্পনা এখনো দৃশ্যমান নয়। দেশের স্থলভাগ কিংবা সমুদ্রসীমায় গত পাঁচ বছরে নতুন করে কোনো গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
সরকারের তথ্য বলছে, বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাসের মজুদ আছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ ১১ বছর চলতে পারে। গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে গেলে পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোনো ধরনের ভবিষ্যৎ ব্যবসা পরিকল্পনাই নেই রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের।
পেট্রোবাংলার অধীন দেশের ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান তিতাস। দেশের বিতরণকৃত মোট গ্যাসের ৫৬ দশমিক ১৭ শতাংশই বিতরণ হয় তিতাসের মাধ্যমে। তিতাসের গত পাঁচ বছরের গ্যাস কেনার পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ সময়ে কোম্পানিটির গ্যাসপ্রাপ্তির পরিমাণ বেড়েছে সামান্যই। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তিতাসের গ্যাস কেনার পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৪৯ মিলিয়ন ঘনমিটার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কিছুটা বেড়ে ১৭ হাজার ৪৪ মিলিয়ন ঘনমিটারে দাঁড়ায়। বিতরণ কোম্পানিটির গ্যাস কেনার পরিমাণ কিছুটা বেড়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ১৭ হাজার ২৩৬ মিলিয়ন ঘনমিটার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তিতাসের গ্যাস কেনার পরিমাণ কিছুটা কমে ১৭ হাজার ১৫৪ মিলিয়ন ঘনমিটারে দাঁড়ায়। আর সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কোম্পানিটির গ্যাস কেনার পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৫৭২ মিলিয়ন ঘনমিটার।
এদিকে নীতিনির্ধারকরা বলছেন, কূপ খনন করলেই গ্যাস পাওয়া যাবে, তা নয়। এক্ষেত্রে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা হলো ১০-২০ শতাংশ। একটা কূপ খনন করতে গড়ে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার খরচ পড়ে। গ্যাস পাওয়া না গেলে এ বিপুল পরিমাণ অর্থের পুরোটাই নষ্ট হয়। বলা হয়, বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। আদতে বিষয়টি সে রকম নয়। যদিও এখনো দৈনিক ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাস বাংলাদেশ থেকেই পাচ্ছি। আমদানিনির্ভর উৎস থেকে পাওয়া যাচ্ছে আরো ১ হাজার এমএমসিএফ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আরো গ্যাসের প্রয়োজন হবে। এদিকে গ্যাসের চাপস্বল্পতায় মারাত্মক সমস্যার মধ্যে রয়েছে দেশের শিল্প খাত। বিশেষ করে শিল্প অধ্যুষিত শিল্প এলাকায় নির্ধারিত চাপের কম গ্যাস সরবরাহ হওয়ায় ক্ষতির শিকার হচ্ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। শ্রীপুর গাজীপুরে স্থাপিত সুতা উৎপাদনকারী কারখানা ইসরাক স্পিনিং মিলস লিমিটেড। উৎপাদন যন্ত্র পরিচালনায় জেনারেটর ব্যবহার হয় কারখানাটিতে। যেটির অনুমোদিত গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গফুটে গ্যাসের চাপ)। গত ৬ এপ্রিল রাত থেকে হঠাৎ করে গ্যাসের চাপ অনেক কমে যায়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত গ্যাসের চাপ ৩ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫ পিএসআই।
গাজীপুরে স্থাপিত বস্ত্র খাতের আরেক কারখানা মোশাররফ কম্পোজিট মিলস। এ প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই। যদিও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি যে গ্যাস পাচ্ছে ৩ পিএসআই। মোশাররফ কম্পোজিট মিলসের মতো অবস্থা গাজীপুরে অবস্থিত বস্ত্র খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান এমএন ডায়িং, প্রিন্টিং ও ওয়াশিং মিলস লিমিটেডের। মাধবখোলা, শ্রীপুর ও বানিয়ারচালা, ভবানীপুরসহ শিল্প অধ্যুষিত গোটা গাজীপুর এলাকায় গ্যাসের চাপের অপ্রতুল চাপের সমস্যা রয়েছে। এতে ভুগতে হচ্ছে পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বস্ত্র খাতের সুতা-কাপড় উৎপাদনকারী কারখানাগুলোকে। এলাকাগুলোয় স্থাপিত টেক্সটাইল মিলগুলোর গ্যাসের প্রেশার ১৫ পিএসআইয়ের পরিবর্তে ৩-৫-এ নেমে এসেছে। ফলে মিলগুলোয় স্থাপিত মেশিনারিজের প্রায় ৭৫ শতাংশ বন্ধ রয়েছে।
বস্ত্র খাতের শিল্প মালিক সংগঠন বিটিএমএর তথ্যমতে, গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। বরং এখন মিলগুলোকে সচল রাখাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সংগঠনটি বলছে, বড় স্পিনিং, উইভিং ও ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিলগুলোতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। এ মেশিনারিজের নিরাপদ ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজস্ব খরচে অবকাঠামো নির্মাণপূর্বক গ্যাসের দ্বারা অত্যাধুনিক জেনারেটর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের মাধ্যমে মিল পরিচালনা করে আসছে। ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের জন্য গ্যাসই হচ্ছে মুখ্য জ্বালানি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মিলগুলো খোলা রাখাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
বস্ত্রশিল্প মালিকরা বলছেন, সরকার রফতানি বাণিজ্য অব্যাহত রাখার মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার বিষয়ে সচেষ্ট। তাই শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি পরিশোধসহ যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে লক-ডাউনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন সাপেক্ষে শিল্প কল-কারখানা সচল আছে। কিন্তু গ্যাস-সরবরাহ পরিস্থিতি তথা গ্যাসের লো-প্রেসার স্বাভাবিক না হওয়ায় মিলগুলি তাদের উৎপাদন সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছেনা। গ্যাসের চাপের বর্তমান পরিস্থিতি আগের তুলনায় আরো খারাপ এমন তথ্য উল্লেখ করে বিটিএমএ জানিয়েছে, মাধবখোলা, শ্রীপুর ও বানিয়ারচালা, ভবানীপুর এবং গাজীপুর সদর সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবস্থিত সমিতির প্রায় ৫০/৬০টি স্পিনিং, উইভিং ও ডায়িং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিলের উৎপাদন গ্যাসের লো-প্রেসার ও অনিয়মিত সরবরাহের কারণে বন্ধ হবার সম্মুখীন। জানতে চাইলে বিটিএমএ সহ-সভাপতি ফজলুল হক বলেন, গ্যাসের চাপের সমস্যা নিয়ে আমরা তিতাসের দারস্থ হয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সমাধান পাওয়া যায়নি। গ্যাসের চাপ কম হওয়ার কারন জানতে চাইলে তারা বলছেন অপর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের বিষয়টি। আমাদের মতে অপর্যাপ্ত গ্যাসের পাশাপাশি গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতাও রয়েছে।
তিতাস সূত্র বলছে, জাতীয় পর্যায়ে উৎপাদন ঘাটতি থাকায় চাহিদা অনুসারে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি বছর সংস্থাটির গ্যাস কেনার পরিমাণ বাড়লেও সেটি খুবই সামান্য। ভবিষ্যতে স্থানীয় উৎস থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া না গেলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য আমাদের কোনো ধরনের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নেই। এক্ষেত্রে আমরা পেট্রোবাংলাকে অনুসরণ করি। তাদেরই এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোম্পানিগুলোর কী করণীয়, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে হবে। অবশ্য দেশের সামুদ্রিক ব্লক থেকে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ চলছে। সেখানে নতুন গ্যাস পাওয়া গেলে তখন সংকট কেটে যাবে বলে আশা তিতাস-সংশ্লিষ্টদের।