আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরির আসবাবপত্রের। কর্মহীন হয়ে পড়ছে এই শিল্পীরা, ভাল নেই তারা। বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে পারছেন না, তাই আজও এই শিল্পকে ধরে রেখেছেন দিনাজপুরের বিরামপুরের মৃৎশিল্পীরা। শনিবার-মঙ্গলবার সপ্তাহে দুই দিন বিরামপুরে হাটবার। আর এই হাটে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মৃৎশিল্পীরা নিজ হাতের মাটির তৈরি করা হাড়ি, কলসি, ঢাকনা,বাটনা, রুটি তৈরি তাওয়া,কাসা ও সাড়া সহ বিভিন্ন মাটির তৈরি আসবাবপত্র বিক্রি করতে আসেন। হাড়ি ২০ থেকে ৩০ টাকা, বাটনা ২৫ থেকে ৩০ টাকা, কাসা ১০ টাকা ২০ টাকা এবং ৩০ টাকা, তাওয়া ২০ টাকা ও কলসি ২৫ টাকা দরে বিক্রি করছেন তারা। আজ কালের স্রোতে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে এই সব মানুষের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের। এখন আর কেউ মাটির তৈরির জিনিস ব্যবহার করে না। সিলভর, প্লাস্টিক এবং বিভিন্ন উন্নত জাতের ধাতব পদার্থের তৈরি জিনিস পাতি ব্যবহার হয়ে আসছে। এক সময় মাটির আসবাবপত্রের বিকল্প কিছু ছিলো না। প্রতিটি রান্না-বান্না সহ সকল প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহৃত হতো মৃৎশিল্পের জিনিস পাতির। মাটির হাড়িতে রান্না হতো ভাত ও তরকারি, তা খাওয়ার জন্য মাটির থালা এবং গ্লাস, পানি রাখার জন্য ছিলো মাটির কলসি। আবার মেয়েরা কলসি কাঁখে করে দূর-দূরান্ত থেকে পানি নিয়ে আসতো। আজ-কাল এসব কথা গল্পকাহিনীর মতো। মঙ্গলবার বিরামপুর পাতিল হাটিতে মাছ ধোঁয়া সাড়া কিনতে আসা মজিবর রহমান বলেন, আজ হাটের দিন মাছ ধোঁয়ার একটা সাড়া কিনতে আসছি। এখন তো আগের মতো মাটির তৈরির জিনিস আর কিনতে হয় না। আগে তো আমাদের সময় মাটির তৈরির আসবাবপত্র ছাড়া কিছুই ছিলো না। হাড়ি কিনতে আসা একজন বয়স্ক বৃদ্ধা নসিমন বিবির সাথে কথা হয়, তিনি বলেন, মাটির হাড়ি আর একটা কলসি নিলাম। হাড়িতে ভাত আর তরকারি রান্না করবো। তিনি আরও বলেন, আমি আজও মাটির হাড়িতে ভাত-তরকারি রান্না করে আসছি। মাটির কলসিতে পানি রাখি, এতে করে গরমের সময় পানি ঠান্ডা রাখে। মাটির থালাতে ভাত খায়, তাতে চোখের জ্যোতি ভাল রাখে। কথা হয় মৃৎশিল্পী জিতেন চন্দ্র পালের সাথে, তিনি বলেন, এখন আর আগের মতো নাই, দিন পাল্টায়ছে। মানুষ আর আমাদের জিনিস পাতি নেই না। এখন আর যুগের তৈরি জিনিস ব্যবহার করে না। চাহিদা কম, তার উপর আবার সকল জিনিসের দাম বেশি। আগে আমরা এক গরুর গাড়ি মাটি নিতাম মাত্র ৫ টাকা দিয়ে, এখন এক ভ্যান মাটি নিতে লাগে ৮০ থেকে ১০০ টাকা, আবার ভাটায় তা পুড়াতে আগে ধানের তুষ ব্যবহার করতাম। এখন তা আর পাওয়া যায় না, এখন কাঠের গুড়া বেশি দামে নিয়ে জ্বালানি কাজে ব্যবহার করছি। বর্তমান আমাদের একদম পুশাচ্ছে না। আবার বর্ষাকাল শুরু হয়েছে, ভাটায় এসব পুড়তে বেশি সময় লাগে এবং খরচ হয় বেশি। মৃৎশিল্পী বজেন মহন্ত পাল বলেন, বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছি, এছাড়া কোন কাজ জানি না। এতো কষ্ট করে সব তৈরি করি, তাতে তার কোন চাহিদা নেই বাজারে। বিভিন্ন হাটে দোকান দিয়ে বেড়ায়, যা বিক্রি হয় তাতে নুন নিয়ে আনতে পান্তা ফুরায়। কোন হাটে ৪ থেকে ৫০০, আবার কোন হাটে ৭০০ টাকা বিক্রি হয়। এতে করে তেমন কোন লাভ হয় না, ছেলে মেদের নিয়ে কোন রকম দিন কাটাচ্ছি।