এক. রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ওই ব্যক্তি, যে নিজে কুরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়।’ (সহিহ বুখারি-৫০২৭) শিক্ষকতা এক মহান পেশা। শিক্ষক এক মহান ব্যক্তি। শিক্ষাগুরুর মর্যাদা অতুলনীয়। শিক্ষক ছাড়া কোনো শিক্ষা পূর্ণতা পায় না। আর সেই শিক্ষক যদি হন কুরআনের শিক্ষক, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কেননা রাসূল সা:-এর নবুওয়তি মিশনের অন্যতম হচ্ছে মানুষকে কুরআন শিক্ষা দেয়া। তাই রাসূলের পরবর্তীতে যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারা শ্রেষ্ঠ মানুষ হবে। অনুরূপ শিক্ষার্থীও যদি হয় কুরআনের শিক্ষার্থী তারাও শ্রেষ্ঠ মানুষ। কারণ কুরআন আল্লাহর সুমহান বাণী, দুনিয়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। শাশ্বত ও চিরন্তন মুজেজা। দুই. রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ওই ব্যক্তি, যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ (সহিহ বুখারি-৬০৩৫)
সুন্দর ব্যবহার মানুষকে ঈমানের পূর্ণতায় পৌঁছে দেয়, উত্তম মুসলমানে পরিণত করে। তা ছাড়া কিয়ামতের দিন মিজানের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী বস্তু সচ্চরিত্র। মানবতাবোধ ও মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ সাধন এর ওপরই নির্ভরশীল এবং এটি মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। কোনো মানুষের চরিত্র গুণাবলি যখন সুন্দর হয়, তখন সে নিজে যেমন মানসিক প্রশান্তি অনুভব করে। তদ্রƒপ তার প্রতিবেশীর জন্য তা প্রশান্তির কারণ হয় এবং তার বেঁচে থাকাটা মানুষের জন্য রহমতস্বরূপ হয়। উত্তম চরিত্র দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান ও মর্যাদার কারণ।
তিন. রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সে, যে ঋণ পরিশোধের বেলায় উত্তম।’ (সহিহ বুখারি-২৩০৫)। মানব জীবনের এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা হচ্ছে ঋণ আদান-প্রদান। এতে ঋণগ্রহীতা যেমন উপকৃত হয় তেমনি ঋণদাতাও এর মধ্য দিয়ে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির সাহায্যে এগিয়ে আসে। তাই প্রয়োজন পূরণের পর ঋণ পরিশোধে ইসলাম কঠোর গুরুত্বারোপ করেছে। কিছু মানুষ এমন আছে, যারা কোনোক্রমে ঋণ নিতে পারলে বেমালুম ভুলে যান। এতে সামাজিক ন্যায়নীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা বিশ্বাস নষ্ট হয়। সমাজবদ্ধতা ও ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন হয়। রাসূল সা: বলেছেন, ‘ঋণ ব্যতীত শহীদের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়’। (মুসলিম)
তাই ঋণ পরিশোধের বিষয়ে যে তৎপর হয়, নবীজী তাকে শ্রেষ্ঠ মানুষ আখ্যা দিয়েছেন।
চার. রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ওই ব্যক্তি, যার থেকে সবাই কল্যাণ আশা করে, অনিষ্টের আশঙ্কা করে না।’ (সুনানে তিরমিজি-২২৬৩)
যিনি শান্তির পথের পথিক, যিনি অন্যের নিরাপত্তা বিধানে সর্বদা সচেষ্ট, যিনি পরের মঙ্গল কামনা ও হিত সাধনায় সদা তৎপর, যার থেকে মানুষ নিরাপদ বোধ করে। নবীজীর চোখে সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ।
পাঁচ. রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ওই ব্যক্তি, যে তার পরিবার (স্ত্রীর) কাছে ভালো।’ (ইবনে হিব্বান-৪১৭৭)
বাইরে অনেক মানুষকে ভালো আচরণ করতে দেখা যায়। কিন্তু স্ত্রী পরিবারের সাথে তার উল্টো চিত্র দেখা যায়। এ কারণে নবীজী সা: উত্তম মানুষের মানদ- বলে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি স্ত্রীর কাছে ভালো সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ। কারণ মানুষ নিজঘরে নিজেকে সবচেয়ে বেশি স্বাধীন মনে করে। তখন তার আসল চরিত্রটা ফুটে ওঠে। তাই উত্তম মানুষ হতে হলে ঘরে বাইরে সর্বদাই উত্তম চরিত্রের চর্চা করতে হবে।
ছয়. রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ সে-ই, যার আয়ু দীর্ঘ হয় এবং আমল উত্তম হয়।’ (জামে তিরমিজি-২৩২৯, মুসনাদে আহমদ-১৭৬৯৮)
মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত রয়েছে সৎকর্মের মধ্যে, অন্য কিছুতে নয়। আমরা সবাই দীর্ঘায়ু কামনা করি, কিন্তু দীর্ঘায়ু যদি অসৎকর্মে ব্যবহার হয় তবে তা সীমাহীন ক্ষতিকারক। নিজের আয়ুকে কল্যাণকর ও ঈর্ষণীয় করে তোলা। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অসৎকর্ম থেকে হিফাজত করা।
সাত. রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ সেই ব্যক্তি, যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী। (দারাকতনি, সিলসিলায়ে সহিহাহ-৪২৬)। এখানে পরোপকারীকে শ্রেষ্ঠ মানুষ আখ্যা দেয়া হয়েছে। পরোপকার মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ গুণ। এটা ঈমানের দাবি এবং এতে আল্লাহর সন্তুষ্ট রয়েছে।
আট. রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘শ্রেষ্ঠ মানুষ হলো সে-ই, যার অন্তর পরিচ্ছন্ন ও মুখ সত্যবাদী। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! সত্যবাদী মুখ বোঝা গেল, কিন্তু পরিচ্ছন্ন অন্তরের অধিকারী কে? রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যে অন্তর স্বচ্ছ ও নির্মল, মুত্তাকি, যাতে কোনো পাপ নেই, বাড়াবাড়ি বা জুলুম নেই, নেই খিয়ানত ও বিদ্বেষ।’ (ইবনে মাজাহ-৪২১৬)
নয়. রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম সঙ্গী সে, যে তার সঙ্গীর কাছে উত্তম। আর আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম প্রতিবেশী সে, যে তার প্রতিবেশীর কাছে উত্তম।’ (জামে তিরমিজি-১৯৪৪)। প্রতিবেশী মানুষের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। হাদিসে প্রতিবেশীর হকের প্রতি লক্ষ রাখাকে ঈমানের সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
দশ. রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘ওই মুমিন শ্রেষ্ঠ, যে আল্লাহর পথে তার জান ও মাল দিয়ে যুদ্ধ করে।’ (সহিহ বুখারি-২৭৮৬, সহিহ মুসলিম-৪৯৯৪)
জিহাদ হলো আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করা এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার এক মহা সংগ্রামের নাম। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান। দ্বীনের সর্বোচ্চ চূড়া। পঞ্চ স্তম্ভের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু চূড়া বা ছাদ না থাকলে তাকে পূর্ণাঙ্গ গৃহ বলা যায় না। চূড়াহীন গৃহের যে তুলনা, জিহাদবিহীন ইসলামের সেই তুলনা। জিহাদেই জীবন, জিহাদেই সম্মান ও মর্যাদা। জিহাদ হলো মুমিন ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্যের অন্যতম মানদ-। আল্লাহ বলেন, যারা ঈমানদার তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে। আর যারা কাফির, তারা যুদ্ধ করে তাগুতের পথে। অতএব, তোমরা শয়তানের বন্ধুদের সাথে যুদ্ধ করো। নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল সদা দুর্বল।’ (সূরা নিসা-৭৬) আল্লাহর পথে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য যারা সংগ্রাম করে নবীজীর চোখে তারাও শ্রেষ্ঠ মানুষ।
আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের মানুষকে নবীজী সা: শ্রেষ্ঠ মানুষ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এর কোনোটিই একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বরং সবই আপন আপন জায়গায় স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় সবগুলোই শ্রেষ্ঠ। সর্বোপরি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে এই শ্রেষ্ঠ মানুষের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হোক এই প্রত্যাশা। লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক