শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২২ পূর্বাহ্ন

খাবার-দাবার পিঠাঘর ও জিলাপির আড়াই প্যাঁচ শেখা

শাইখ সিরাজ
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৬ জুন, ২০২১

অঘোষিত লকডাউনে রমজানের এই সময়টাতে আমরা অনেকেই প্রিয় খাবার জিলাপি মিস করছি। একদিকে ভালোই হয়েছে, দোকানপাট বন্ধ থাকায় ইফতারের সেই ভাজাপোড়া খাওয়া থেকে সবাই বেঁচে গেছেন। অন্যদিকে জিলাপি না পেয়ে সুগার আমার কন্ট্রোলে আছে, মন্দ কী!
তবে ঘরে বসে অনেকেই জিলাপি বানানোর চেষ্টা করছেন। জিলাপি বানিয়ে ছবি তুলে ফেইসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন। একজনের জিলাপি দেখলাম, সেখানে কোনো প্যাচ নেই। আরেকজনের জিলাপি দেখে কোনোভাবেই বলা যাবে না ওগুলো জিলাপি। আমি প্রথমে দেখে ভেবেছিলাম ওগুলো খুব সম্ভবত চিংড়ি মাছ। তবে ছবির নিচে তিনি লিখে দিয়েছেন- জিলাপি বানিয়েছি, উৎসাহ দিলে আরও বানাব।
ফেইসবুকে চলছে জিলাপি-কা-।:আমাদের বাসায় রমজানের ইফতারিতে চিড়া, কলা, দই থাকবেই। এটা দীর্ঘদিনের রীতি। তার বাইরে অন্যান্য আইটেম, যার সবটুকুই ঘরে বানানো। এতদিন পারু করত, এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে আমরিন। এ বাড়িতে আমরিনের এটা প্রথম রোজা। আমরিন রোজই ইফতারের নানান খাদ্য তৈরি করে। মাঝে একদিন জিলাপি বানিয়েছিল, চিকন পাতলা জিলাপি। বেশ ভালো হয়েছে খেতে। আমরিনকে বললাম, তুমি এত সুন্দর প্যাচ দেওয়া শিখলে কীভাবে। জিলাপির আড়াই প্যাচটাই হচ্ছে এর সৌন্দর্য।
জিলাপি এই উপমহাদেশের জনপ্রিয় একটি খাবার। গ্রামেগঞ্জে সবখানেই জিলাপির বেশ কদর। আর রমজান এলে জিলাপির জনপ্রিয়তা যেন শতগুণ বেড়ে যায়। এটা অবশ্য পুরান ঢাকার কল্যাণে। পুরান ঢাকার জিলাপির সঙ্গে অন্য কোনো জায়গার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঐতিহ্যবাহী এই জিলাপির প্যাচও অন্যরকম। ঠিক প্যাঁচানো নয়। গোল গোল। আর আড়াই পাঁচ না হলে তা জিলাপি হবে না। যে কারিগর খুব সুন্দরভাবে আড়াই পাঁচ দিতে পারে, সে-ই হচ্ছে জিলাপির আসল কারিগর।
সাগর আর আমি তখন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর ‘খাবারদাবার হোটেলটি চালাই। ছাত্রজীবনের কথা। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি, টেলিভিশনে যাই, আবার হোটেলে আসি। এভাবে সেই সময়টা আমাদের কাটত। তবে বেশির ভাগ সময় তখন আমরা হোটেলে দিতাম। এমনিতেই খাবারদাবার আর দশটা হোটেলের চেয়ে একটু আলাদা ধরনের। যেখানে সেই আমলে অর্থাৎ ৭০-এর দশকে হোটেলে পিঠা, খিচুড়ি, সর্ষে ইলিশ, চিংড়ির দোপেঁয়াজা এরকম আরও অনেক খাবার পরিবেশন করা হতো। এ ধরনের খাবার সেই সময়ে হোটেলে কেউ চিন্তা করত না, সাধারণত বাসা বাড়িতে মানুষ করত।
একবার আমরা চিন্তা করলাম জিলাপি বিক্রি করব। কিন্তু সেই জিলাপি প্রচলিত জিলাপি থেকে স্বাদে গন্ধে আলাদা হতে হবে। জিলাপি বানানোর প্রধান উপকরণ হচ্ছে ‘খামি’। খামি হচ্ছে ময়দা ভিজিয়ে যে দলা তৈরি করা হয়। যে কারিগর যত ভালো খামি বানাতে পারবে তার জিলাপি তত সুন্দর হবে। খামি বানাতে হয় আগের রাতে, যা দিয়ে পরের দিন জিলাপি ভাজা হয়।
সাগর আর আমি মাঝেমধ্যে রাতে হোটেল বন্ধ করে ঠাটারীবাজার, নয়া বাজার এবং পুরান ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে খেতে যেতাম। উদ্দেশ্য ছিল, কোন হোটেলের কোন খাবারটি সুস্বাদু। পরে ওই হোটেলের সেই বাবুর্চিকে ভাগিয়ে নিয়ে আসা।
জিলাপির ক্ষেত্রে এমনই এক কারিগর হচ্ছেন গৌরাঙ্গ দাস।
আমরা যা চেয়েছিলাম, খাবারদাবারের জিলাপি হবে আলাদা, গৌরাঙ্গ তা-ই করেছিল। একসময় এসে খাবারদাবারের জিলাপির নাম মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। গৌরাঙ্গের কাছ থেকে শিখেছিলাম জিলাপির আড়াই পাঁচ কীভাবে দিতে হয়।
ইতিহাস বলছে, জিলাপি শব্দটা এসেছে আরবি শব্দ ‘জুলাবিয়া থেকে। এর লিখিত বর্ণনা পাওয়া যায় ১৩শ শতাব্দীর মোহাম্মদ বিন হাসান আল বোগদাদীর রান্নার বইয়ে। ইরানে এই মিষ্টান্ন জেলেবিয়া নামে পরিচিত। যা সাধারণত রমজান মাসে গরিব মিসকিনদের মাঝে বিতরণ করা হয়। মধ্যযুগে ফারসি ভাষাভাষী তুর্কিরা খাবারটি ভারতবর্ষে নিয়ে আসে।
মোগল যুগে রাজা-বাদশাদের খাদ্য তালিকায় জিলিপির প্রবেশ ঘটে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় থেকে। এই মিষ্টি জাহাঙ্গীরের এত প্রিয় ছিল যে, তিনি এই মিষ্টির সঙ্গে নিজের নাম জুড়ে দিতে দ্বিধা করেন নি। তিনি নাম রেখেছিলেন ‘জাহাঙ্গিরাহ’। তবে জিলাপি টিকে আছে তার নিজস্ব ঐতিহ্য নিজ নামেই। ১২.০৫.২০২০ অন্যদিন প্রকাশিত ‘করোনাকালে বহতা জীবন’ বই থেকে নেয়া




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com