প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতির পিতা হত্যার ষড়যন্ত্রকারী এবং ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী উভয়কেই বিচারের সম্মুখীন করার সংকল্প ব্যক্ত করে বলেছেন, এই দেশের দুঃখী জনগণের মুখে হাসি ফোটানোই হবে এই হত্যাকান্ডের প্রকৃত প্রতিশোধ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের দুঃখী নিরন্ন জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা এবং উন্নত জীবনের ব্যবস্থা করা যেটা জাতির পিতার আজীবন লালিত স্বপ্ন, সেই ব্যবস্থা যখন করতে পারবো সেদিনই আমি মনেকরি এই হত্যার প্রকৃত প্রতিশোধ নিতে পারবো।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই হত্যাকান্ডের বিচার করাটা জরুরী ছিল সেটা করেছি এবং কারা জড়িত ছিল একদিন সেটাও বের হবে। সেদিনও খুব বেশি দেরী নয়। এই হত্যাকান্ড যারা ঘটিয়েছে এবং যারা পাশে ছিল ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে, সবাই কিন্তু সমানভাবে দোষী।
প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গত সোমবার বিকেলে জাতির পিতার ৪৬তম শাহাদত বার্ষিকী এবং ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণ সভায় সভাপতির ভাষণে এসব কথা বলেন। তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভেনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা তখনকার পত্র-পত্রিকাগুলো পড়লেই অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। একটা বিধ্বস্ত দেশ গড়তে যেখানে বছরের পর বছর লেগে যায় সেখানে একটি বছরও সময় দেয়া হলো না, সাথে সাথে সমালোচনা শুরু হলো। ধৈর্য্য না ধরে নানা সমালোচনা, নানা কথা লেখা হলো। কারা এগুলো লিখেছিল, কাদের খুশী করতে এবং এই হত্যাকান্ডের জন্য গ্রাউন্ড প্রিপেয়ার কারা করছিল? আত্মস্বীকৃত খুনী ফারুক-রশিদের বিবিসিতে প্রদত্ত ইন্টারভিউ এর উদ্ধৃতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই হত্যাকান্ড যারা ঘটিয়েছে এবং যারা পাশে ছিল ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে সবাই কিন্তু সমানভাবে দোষী।
শেখ হাসিনা বলেন, একটা জিনিস চিন্তা করেন ’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা দেশে ফেরেন এবং সেই ’৭২ সাল থেকেই এদেশে ষড়যন্ত্র শুরু। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভক্তি হলো, জাসদ সৃষ্টি হলো, পাকিস্তানী হানাদারবাহিনীর দোসরা যারা এদেশে থেকে গিয়েছিল সব আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির সঙ্গে মিশে গেল।
তিনি বলেন, এই হত্যাকান্ডের বিচার করাটা জরুরী ছিল সেটা করেছি এবং কারা জড়িত ছিল একদিন সেটাও বের হবে। সেদিনও খুব বেশি দেরী নয়। তবে, আমার একটাই লক্ষ্য ছিল আমি সবসময় বলেছি বাংলাদেশের দুঃখী নিরন্ন জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা এবং উন্নত জীবনের ব্যবস্থা, যেটা জাতির পিতার আজীবন লালিত স্বপ্ন। সেই ব্যবস্থা যখন করতে পারবো সেদিনই আমি মনেকরি এই হত্যার প্রকৃত প্রতিশোধ নিতে পারবো।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সভায় প্রারম্ভিক বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ’৭৫ এর ১৫ আগষ্টে শহিদ জাতির পিতা, বঙ্গমাতা এবং তাঁদের পরিবারের শাহাদতবরণকারি সদস্যদের সম্মানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
স্মরণ সভায় শ্রদ্ধা নিবেদন করে সাবেক মন্ত্রী এবং দলের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী এবং দলের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ড.আব্দুর রাজ্জাক ও এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, দপ্তর সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি ব্যরিষ্টার বিপ্লব বড়ুয়া এবং ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা বক্তৃতা করেন। আরো বক্তৃতা করেন মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কোচি, দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির প্রমুখ। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ এমপি গণভবন থেকে সভাটি সঞ্চালনা করেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, জাতির পিতা রক্ত দিয়ে গেছেন এদেশের মানুষের জন্য,রক্ত দিয়ে গেছেন আমার মা, আমার ভাইয়েরা। আমিও সেই রক্ত দিতেই বাংলাদেশে পা রেখেছি।
তিনি বলেন, মৃত্যুকে সামনা সামনি দেখেছি। কিন্তু কোনদিন আমি ভীত হইনি,আমি ভীত হবো না। কারন আমি প্রস্তুত। আমি তো জানি যেকোন মুহুর্তে আমাকে চলে যেতে হবে। যেটুকু সময় আছে দেশের জন্য কতটুক করতে পারি। তিনি বলেন, কাজেই আমিও জানি। আমার জীবনের কোন মায়া নেই, আমার কোন কিছু চাওয়ার নেই। আমার একটাই চাওয়া যেই আদর্শ নিয়ে আমার বাবা এদেশ স্বাধীন করেছেন তার সেই আদর্শ বাংলার মানুষের কাছে পৌছে দেব। এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন,আজকে ১৫ই অগাষ্টের এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা হবে যে ওই রক্ত কখনো বৃথা যায়নি, বৃথা যাবে না, বৃথা যেতে আমরা দেব না। এদেশের দুখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে আমার বাবা, মা,ভাইয়ের আত্মা যেন শান্তি পায়। সেটাই আমি চাই। দেশবাসীর দোয়া চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে। এখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে। তবে, করোনা মোকাবেলায় তিনি সকলকে সাবধান করে পুণরায় স্বাস্থ্যমতবিধি মেনে চলার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপদগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকদের হাতে একে একে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তাঁদের তিন সন্তান এবং দুই পুত্রবধু, বঙ্গবন্ধুর অনুজ ও ভগ্নিপতি এবং সামরিক সচিব কর্নেল জামিল সহ পরিবারের ১৮ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।
একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনীদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে মুল বাধা ইনডেমনিটি আইন জাতীয় সংসদে বাতিল করা হয়। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সুপ্রীম কোর্টে আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামীদের রিভিউ পিটিশন খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি আত্বস্বীকৃত খুনী ফারুক,মহিউদ্দিন সহ ৫ আসামীর ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়। পরে ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরো একজন খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। রশিদ, ডালিম, নূর চৌধুরী সহ বাকী খুনীরা এখনও বিশে^র বিভিন্ন দেশে পলাতক রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় খুনীদের বিচারের প্রসংগ টেনে বলেন, এখনও যারা পলাতক তারমধ্যে পাকিস্তানী পাসপোর্টধারী ডালিম পাকিস্তানেই আছে, মাঝে মাঝে কেনিয়া বা অন্যান্য দেশেও যায়, রশিদ পাকিস্তান এবং লিবিয়া এই দুই জায়গায় থাকে। রাশেদ এবং নূর চৌধুরী আমেরিকা ও কানাডায় আছে। মোসলেহ উদ্দিনের খোঁজ মাঝে মাঝে পাওয়া যায়, মাঝে মাঝে পাওয়া যায়না।
তিনি বলেন, এ ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারকে বহুবার বলা হলেও তারা এটা স্বীকার করেনা। এমনকি অপরাধীদের ফিরিয়েও দেয়না। এমনই একটা অবস্থার মধ্যে বিষয়টা রয়েছে।
নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে ডিপোর্ট (দেশে ফেরত) করার কথা উঠলেও সেটা না হওয়ায় সে সময়রকার কানাডার বাংলাদেশি হাইকমিশনারের ভ’মিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী এবং বলেন, সে খন্দকার মোশতাকের দ্বিতীয় স্ত্রী’র আগের পক্ষের ছেলে। তিনি বলেন, একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে যে দায়িত্বটা পালন করার ছিল সেটা কিন্তু সে পালন করে নাই। কাজেই সে নূরকে ডিপোর্ট করার কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। তবে, সেখানকার প্রবাসী বাঙালি এবং আমরা মামলা করে তারপরেও চেষ্টা চালাচ্ছি তাকে ফিরিয়ে আনার।
বঙ্গবন্ধুকে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েই এই হত্যাকান্ড ঘটানো হয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ’৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে একরকম জোর করেই দেশে ফিরে আসলেও অনেক সমস্যা ও বাধা তাঁকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। তারপরেও জাতির পিতার এনে দেয়া স্বাধীনতার সুফল বাংলার মানুষের প্রত্যেক ঘরে পৌঁছে দেয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়েই তিনি সকল বাধা অতিক্রমে কাজ করে যাচ্ছেন। এ সময় দলের নেতা-কর্মী সহ সকলের সহযোগিতা প্রাপ্তির উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ কেউ এমনও আছেন যারা তাৎক্ষণিক কিছু প্রাপ্তির আশায় অস্থির থাকেন, তারা দলের দু:সময় দেখলেই ঘাবড়ে যান, ভয় পেয়ে যান। আর এটা তাদের মধ্যে আসে যাদের অর্থের লোলুপতা থাকে। তিনি বলেন, যারা রাজনীতি করে ব্যাপক ধনসম্পদ গড়ে তুলে অর্থের লোলুপতা নিয়ে বাঁচে তারা প্রয়োজনের সময় দাঁড়াতে পারেনা। আত্মসমর্পন করে। আর যাঁরা এর উর্ধ্বে উঠতে পারে তাঁরা যেকোন বাধা আসুক তা অতিক্রম করতে পারে এই কারণে কেননা সততাই শক্তি। আর এই সততা দিয়েই এগিয়ে যাওয়া যায় এবং সেটাই বড় সম্পদ।
বিত্ত-বৈভব এবং সামরিক শক্তি অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের কোন কাজে আসেনা উল্লেখ করে তিনি সারাবিশে^ তোলপাড় সৃষ্টিকারি করোনা ভাইরাস প্রসংগ টেনে উন্নত দেশগুলোর পরিস্থিতির দিকে এ বিষয়ে লক্ষ্য করে দেখার আহবান জানান।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, আজকের শোক দিবসে আমি এইটুকুই বলবো আপনাদের সকলের সহযোগিতায় জাতির পিতা হত্যাকান্ডের বিচার আমরা করতে পেরেছি। অর্থনৈতিক ভাবে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ ধরে আমরা চলেছি।