বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার ইন্দোনেশিয়ার একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞকে ‘মসকুইটো কমান্ডার’ বা মশার কমান্ডার উপাধিতে ভূষিত করেছে। যিনি ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণে যুগান্তকারী প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন, তার নাম ড. আদি উতারিনি; ইয়োগিয়াকার্তার গদজাহ মাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের জনস্বা¯ে’্যর অধ্যাপক।
করোনা সঙ্কটে বিপর্যস্ত ইন্দোনেশিয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপও কম নয়। এর মধ্যে গত বছরের আগস্টে উতারিনি ও তার দল একটি বড় বিজয়ের খবর দিয়েছে, যা ডেঙ্গু রোগকে পরাজিত করার পথে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হ”েছ। উতারিনি ও তার সহকর্মীরা ইন্দোনেশিয়ার একটি বড় শহর ইয়োগিয়াকার্তার কিছু অংশে ডেঙ্গু জ্বরের ঘটনা ৭৭ শতাংশ কমিয়ে আনতে পেরেছেন। এপিডেমিওলজিস্টরা এ ফলাফলকে ‘চমকপ্রদ’ বলে অভিহিত করেছেন। এটি এমন একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে বহুল কাক্সিক্ষত জয় এনে দিয়েছে, যা এশিয়া, আফি”কা ও দক্ষিণ আমেরিকার নি¤œ আয়ের দেশগুলোকে বিপর্যস্ত করেছে।
এ গবেষণায় তারা একটি ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত মশা ব্যবহার করে দেখেছেন, এটি সেই মশার ডেঙ্গুর বিস্তার করার সক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। এখন তা সম্প্রসারণ করা হ”েছ। দ্য ওয়ার্ল্ড মসকুইটো প্রোগ্রাম মনে করে, এটিই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসের বিষয়ে একটি সমাধান নিয়ে আসতে পারে। ৫০ বছর আগে ডেঙ্গু মহামারীতে রূপ নেয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মাত্র ৯টি দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে ছিল; কিš’ এখন বছরে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গু বিষয়ে এই পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়েছে ‘ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া’য় আক্রান্ত মশাকে। গবেষকরা ভাইরাসটিকে বর্ণনা করেছেন ‘প্রাকৃতিকভাবে অলৌকিক’ হিসেবে। ওলবাকিয়া মশার ক্ষতি করে না, কিš’ ডেঙ্গু ভাইরাসের বিস্তারে দায়ী একটি অংশকে শরীর থেকে সরিয়ে দেয়। ব্যাকটেরিয়াটি ডেঙ্গু ভাইরাসের ফের তৈরি হওয়াকে কঠিন করে তোলে। ফলে ওই মশাটি আবার যখন কাউকে কামড়ায় তখন তার আর আক্রান্ত করার তেমন সক্ষমতা থাকে না। এ পরীক্ষায় ওলবাকিয়ায় আক্রান্ত ৫০ লাখ মশার ডিম ব্যবহার করা হয়েছে। ডিমগুলো প্রতি দুই সপ্তাহে একবার করে শহরের একটি জায়গায় পানির পাত্রে রাখা হয়েছিল। এ প্রক্রিয়ায় আক্রান্ত মশার সংখ্যা বাড়াতে ৯ মাস পর্যন্ত সময় লেগেছিল। ইয়োগিয়াকার্তা শহরকে ২৪টি জোনে ভাগ করে অর্ধেক পরিমাণ মশা ছাড়া হয়েছিল। এর ফলাফল নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্তের ঘটনা ৭৭ শতাংশ কমেছে এবং আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে নেয়ার সংখ্যা কমেছে ৮৬ শতাংশ। ড. উতারিনির গবেষণা টিমের একজন সদস্য ড. কেটি অ্যান্ডারস ‘নেচার’ ম্যাগাজিনকে বলেছেন, পুরো শহরে মশা ছাড়ার কৌশলটি খুবই সফল হয়েছে এবং ওই অঞ্চল থেকে ডেঙ্গু দূর করার লক্ষ্য নিয়ে প্রকল্পটিকে এগিয়ে নেয়া হ”েছ। তিনি বলেন, এর ফলাফল সত্যিই অভূতপূর্ব। আমরা মনে করি, বিশ্বজুড়ে বড় শহরগুলোতে ডেঙ্গু সমস্যা সমাধানে এটি দারুণ প্রভাব ফেলতে পারে।
ডিজিজেস মডেলিং স্টাডিজের ধারণা যে, ওলবাকিয়া সম্পূর্ণভাবে ডেঙ্গু দমনে সক্ষম হতে পারে। ওলবাকিয়া মশার ক্ষতি করে না, কিš’ ডেঙ্গু ভাইরাসের জন্য দরকার হয় এমন একটি অংশকে শরীর থেকে সরিয়ে দেয়। এ গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার বোস্টন ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথ অ্যান্ড মেডিসিনের অধ্যাপক ডেভিড হ্যামার বলছেন, এ পদ্ধতিটি মশাবাহিত অন্য রোগ যেমন জিকা, ইয়েলো ফিভার কিংবা চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সম্ভাবনাময় হতে পারে। অস্ট্রেলিয়া ও ভিয়েতনামে এর ছোট ছোট পরীক্ষা হয়েছে। এতে চমকপ্রদ ফল পাওয়া যায়। কিš’ ডেঙ্গু সংক্রমণের উচ্চ হারের, প্রায় চার লাখ জনসংখ্যার ঘনবসতিপূর্ণ শহর ইয়োগিয়াকার্তায় এর পরীক্ষায় যুগান্তকারী সাফল্য আসে।
ইয়োগিয়াকার্তায় ২০১১ সালে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গবেষণা শুরু হয়েছিল। এতে সাহায্য করার জন্য ২০১৩ সালে নিয়োগ দেয়া হয় অভিজ্ঞ জনস্বা¯’্য গবেষক ড. উতারিনিকে, যিনি যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া নিয়েও কাজ করেছেন। তিনি তার টিম নিয়ে কাজ শুরু করে সাফল্য লাভ করেন।
বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে গবেষণা টিমের অন্যতম সদস্য ড. অ্যান্ডারস তাদের গবেষণা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, বিশ্বজুড়ে বড় শহরগুলোতে যেখানে ডেঙ্গু রোগ বড় ধরনের জনস্বা¯’্য সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, সেখানে এটি দারুণ প্রভাব ফেলতে পারে। ‘ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া’ যেসব মশার শরীরে ঢুকবে সেটির উর্বরতাকে এমনভাবে পরিবর্তন করতে পারে যে, ওই মশার বাচ্চার মধ্যেও তার উপস্থিতি থাকবে। এর অর্থ হলো, একবার ‘ওলবাকিয়া’ দেয়া হলে সেটি দীর্ঘ সময় থাকতে পারে এবং ডেঙ্গু সংক্রমণে তার উপস্থিতি থাকবে। এর অর্থ হলো একবার ‘ওলবাকিয়া’ দেয়া হলে এটি সুরক্ষা দেবে। ড. উতারিনি ও তার দলের এ গবেষণাকে একটি মাইলফলক অর্জন হিসেবে দেখা হ”েছ। কারণ ডেঙ্গু ছড়ানো এডিস মশা সাধারণত ওলবাকিয়ায় আক্রান্ত হয় না। আবিষ্ক”ত পদ্ধতিতেই ওলবাকিয়া মশার শরীরে ঢুকিয়ে দিয়ে ডেঙ্গু দমন করা সম্ভব।
গবেষক দলের প্রধান, ‘মশার কমান্ডার’ উপাধিপ্রাপ্ত ইয়োগিয়াকার্তার গদজাহ মাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বা¯’্য গবেষক অধ্যাপক উতারিনি বলেন, এটি একটি খুব বড় স্বস্তির ব্যাপার ছিল যে, আমরা গবেষণায় সফল হয়েছি। ডেঙ্গু দমন নিয়ে আশাবাদী উতারিনি আরো বলেন, ‘এ প্রযুক্তিতে বিশ্বাস করি। সম্ভবত অন্ধকারে শেষ পর্যন্ত একটি আলো আছে।’
মশা দিবস ও মশাবাহিত রোগ: করোনা মহামারীর এ বিপদের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরও এবার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ঢাকাসহ সারা দেশেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হ”েছ। করোনাভাইরাসে দেশে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। এর মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে চলতি বছরে এ পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত ৩১ জন মারা গেছে। ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত একটি রোগ।
করোনা ও ডেঙ্গু জ্বরের এ আতঙ্কজনক অবস্থায়ই গত ২০ আগস্ট পালিত হলো ‘বিশ্ব মশা দিবস’। ব্রিটিশ চিকিৎসক ড. স্যার রোনাল্ড রসের গবেষণাকে সম্মান জানাতেই এ দিবসটি পালন করা হয়। যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন ১৯৩০ সালে বিশ্ব মশা দিবসের সূচনা করে। কারণ ডক্টর রস কলকাতার পিজি হাসপাতালে বসে ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি আবিষ্কার করেন, স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশাই ম্যালেরিয়া রোগের জন্য দায়ী। অ্যানোফিলিস মশার কামড়েই হয় ম্যালেরিয়া। গবেষণায় তিনি দেখান প্লাসমোডিয়াম কিভাবে মশার শরীর থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে, তার সম্পূর্ণ জীবনচক্র। ড. রস প্রমাণ করেন, অ্যানোফিলিস প্রজাতির মশার পাকস্থলীর প্রাচীরের জলকোষে একধরনের দানাদার কালচে রঞ্জক পদার্থ রয়েছে। গবেষণাগারে তিনি খাঁচায় বন্দী পাখির মাধ্যমে এ জীবাণুর জীবনচক্র বিশ্লেষণ করে দেখতে পান, রোগাক্রান্ত পাখির দেহ থেকে ম্যালেরিয়া সুস্থ পাখির দেহে সংক্রমিত হয়েছে। এ গবেষণার জন্য ড. রস নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
মশা এক ভয়ঙ্কর পতঙ্গ। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মশাবাহিত পাঁচটি রোগ চিহ্নিত করেছেন জনস্বা¯’্য বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হ”েছ ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জাপানিজ এনসিফালাইটিস। এ ছাড়া জিকা ও ইয়েলো ফিভারও মশার কামড়ে হয়ে থাকে। প”থিবীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে। এর মধ্যে ১০০টির মতো প্রজাতি রোগ ছড়ায়। প্রতি বছর কীটপতঙ্গের আক্রমণে বিশ্বে যত মানুষ মারা যায়, এর মধ্যে মশাবাহিত রোগেই মারা যায় সর্বোচ্চ সংখ্যক। বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশার খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকায়ই ১৪ প্রজাতির মশা রয়েছে। বাংলাদেশে শুধু অ্যানোফিলিস মশাই আছে ৩৬ প্রজাতির বলে কীটতত্ত্ববিদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানিয়েছেন।
ডেঙ্গু জ্বরের কাহিনী: এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বর হয়। ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণে ৩ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয় জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং শরীরে ফুসকুড়ি ওঠা। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কখনোবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয় অর্থাৎ রক্তচাপ বিপজ্জনক পর্যায়ে কমে যায়। এডিস স্ত্রী মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। এর মধ্যে এডিস ইজিপ্ট মশকীই প্রধানতম দায়ী। প্রতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এর প্রকোপ থাকে। ডেঙ্গু মহামারী হিসেবে দেখা দেয়ার প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় ১৭৭৯ ও ১৭৮০ সালে এশিয়া, আফি”কা ও উত্তর আমেরিকায়। বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ববিষয়ক প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের এক গবেষণায় বলা হয়, ১৯৫২ সালে আফি”কায় প্রথম ডেঙ্গু জ্বর রোগটি দেখা যায়। ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়াতে এটি বিস্তার লাভ করে। বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম এডিসবাহিত ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। ২০১৫ সালের পর ডেঙ্গু বাড়তে থাকে। ডেঙ্গু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। স্প্যানিশ ‘ডেঙ্গু’ শব্দ থেকে এ রোগের নামকরণ হয়। স্পেনে শব্দটি এসেছে পূর্ব আফি”কার সোহাইলি আদিবাসীদের কাছ থেকে। তাদের বিশ্বাস ছিল ‘খারাপ আত্মার সংস্পর্শে হাড়গোড় ভাঙার ব্যথাঅলা’ এ জ্বর হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দাসদের যদি ‘ডেঙ্গু জ্বর’ হতো, তখন তাদের হাঁটার ভঙ্গিমা ডান্ডি নৌকার মতো হতো বলে একে ডান্ডিজ্বরও বলা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ৯টি দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়েছিল। কিন্তু এখন প্রায় ৪০ কোটি মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হ”েছ। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস কাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক