শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৯ অপরাহ্ন

শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দুই সাংবাদিক পেলেন কেন?

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২১

ইতিহাসে প্রথম যে সাংবাদিক নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তার নাম কার্ল ভন ওজিয়েতস্কি। জার্মান ওই সাংবাদিক তার দেশের সেনাবাহিনীর তৎকালীন গোপন যুদ্ধপ্রস্তুতির বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন। সেজন্য ১৯৩৫ সালে তাকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়েছিল। এরপর কেটে গেছে ৮৬ বছর। এর মধ্যে কোনো সাংবাদিক নোবেল পাননি। সে খরা ঘুচল এবার। ৮৬ বছর পর ফের কোনো সাংবাদিকের হাতে উঠল এ পুরস্কার; আর তা শান্তিতে অবদান রাখার জন্যই। ২০২১ সালে শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন একসঙ্গে ২ সাংবাদিক- ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা ও রাশিয়ার সাংবাদিক দিমিত্রি আন্দ্রিয়েভিচ মুরাতভ।
উনবিংশ শতাব্দীতে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল আবিষ্কার করেন ডিনামাইট নামে ব্যাপক বিধ্বংসী এক বিস্ফোরক, যা তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পত্তির মালিক করে তোলে। মৃত্যুর আগে তিনি উইল করে যান, প্রতি বছর সাহিত্য, পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি ও অর্থনীতি- এ ছয়টি বিষয়ে যারা বিশেষ অবদান রাখবেন; তাদের যেন তার সম্পত্তি থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়।
১৯০১ সাল থেকে শুরু হয় নোবেল পুরস্কার প্রদান। সব নোবেল পুরস্কার সুইডেনের স্টকহোম থেকে ঘোষণা দেওয়া হলেও শান্তিতে নোবেলজয়ী নির্বাচনের দায়িত্ব নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির। এ কারণে শান্তিতে পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া হয় নরওয়ের অসলো থেকে। কাজটি আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুযায়ীই করা হয়। সে অনুযায়ী, নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির প্রধান বেরিট রেইস অ্যান্ডারসেন ৮ অক্টোবর নরওয়ের রাজধানী অসলোতে চলতি বছরের শান্তিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন। পুরস্কারের এক কোটি ক্রোনা ভাগ করে নেবেন মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভ।
এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানিয়েছে, চলতি বছর এ বিষয়ে পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের তালিকায় ৩২৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল। তাদের সবাইকে হটিয়ে বিজয়ী হলেন রেসা ও মুরাতভ। নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব সাহসিকতার সঙ্গে পালনের মাধ্যমে ফিলিপাইন ও রাশিয়ায় মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টিকে এগিয়ে নিতে মৌলিক অবদান রাখার জন্যই চলতি বছর তাদের শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির প্রধান।
আনন্দময় অপ্রত্যাশিত ঘটনা: নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে নিজের নাম শোনার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মারিয়া রেসা জানান, তার জন্য এটি একটি ‘আনন্দময় অপ্রত্যাশিত ঘটনা’।
তিনি আরও বলেন, ‘এ বিশ্ব তথ্যে ভরপুর। কিন্তু তার মধ্যে সঠিক তথ্য বেছে নেওয়া এবং জনগণকে তা জানানোই সাংবাদিকের কাজ। কাজটি যদি যথাযথভাবে না হয়, সেক্ষেত্রে সত্য ও আস্থাশীলতা বিপন্ন হতে বাধ্য।’ ‘আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠান র‌্যাপলার- আমরা শুধু আমাদের পেশাগত দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালনের চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ গত শুক্রবার বিজয়ী ঘোষণার সময় নোবেল কমিটির প্রধান বেরিট রেইস অ্যান্ডারসেন তার সম্পর্কে বলেন, ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা পেশাজীবনের শুরু থেকে দেশটিতে ক্ষমতার অপব্যবহার, ক্রমবর্ধমান সংঘাত ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টিকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে তিনি বেছে নিয়েছেন সাংবাদিকতার একটি বিশেষ ধারা- অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে। দেশটিতে অনুসন্ধানী ধারার সাংবাদিকতাকে অগ্রগামী করতে ২০১২ সালে র‌্যাপলার নামে একটি ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মারিয়া রেসা বর্তমানে সেটির প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে রয়েছেন। পুরস্কার ঘোষণা অনুষ্ঠানে কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, মারিয়া রেসা নির্ভীকভাবে ফিলিপাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সামনে থেকে নেতৃত্ব ছিলেন। তার এবং তার প্রতিষ্ঠান র‌্যাপলারের এ বিষয়ক ভূমিকার স্ফুরণ লক্ষ্য করা যায় দেশটির বিতর্কিত মাদকবিরোধী অভিযানের সময়।
২০১৬ সালে ফিলিপাইনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট দুতার্তে মাদকবিরোধী অভিযানের ঘোষণা দেন। অভিযানে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়াবহ দমন-পীড়ন ও বিপুল সংখ্যক হত্যাকা-ের ফলে একসময় সেটি ফিলিপাইনের সরকার ও জনগণের মধ্যকার লড়াইয়ে রূপ নেওয়ার উপক্রম হয়।
ফিলিপাইনের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্কিত এ অভিযানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বেছে নিয়েছিল দুতার্তের নেতৃত্বাধীন সরকার। তার অংশ হিসেবে সে সময় ফিলিপাইনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঢালাওভাবে ভুয়া সংবাদ ও তথ্য ছড়ানো হচ্ছিল। মারিয়া রেসা ও তার নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান র‌্যাপলারের উদ্যোগে এ বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হয়। ধারাবাহিকভাবে সেসব প্রতিবেদন আকারেও প্রকাশও করা হয়।
মারিয়া রেসাকে নোবেল বিজয়ী হিসেবে ঘোষণার ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অ্যান্ডারসেন।
এটা স্রেফ পাগলামো: সাংবাদিক মারিয়া রেসা যেখানে নোবেল প্রাপ্তির বিষয়টিকে ‘আনন্দময় অপ্রত্যাশিত ঘটনা’ বলছেন, সেখানে বিজয়ী অপর সাংবাদিক দিমিত্রি আন্দ্রিয়েভিচ মুরাতভ এ ঘটনাকে উল্লেখ করেছেন ‘পাগলামো’ হিসেবে। বিবিসিকে রাশিয়ার এই সাংবাদিক বলেন, ‘আমি হাসছি; আসলে আমি এটি কখনো প্রত্যাশা করিনি। এটা পাগলামো, স্রেফ পাগলামো।’ ‘তবে এও সত্য, রাশিয়ায় সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে অতীতে যেসব দমনমূলক নীতি নেওয়া হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তার একটি উপযুক্ত জবাব দেওয়া হয়েছে এ ঘোষণার মাধ্যমে।’ রাশিয়ার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় ক্রমবর্ধমান বৈরী পরিস্থিতির মুখে গত চার দশক ধরে লড়াই করে যাওয়া সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ রুশ পত্রিকা নাভায়া গেজেতার অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদকও তিনি।
১৯৯৩ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে নাভায়া গেজেতা। তার দুবছর পর অর্থাৎ ১৯৯৫ সাল থেকে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান হন মুরাতভ। রাশিয়ার সবচেয়ে নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম হিসেবে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে নাভায়া গেজেতা। শুরু থেকেই রাশিয়ার ক্ষমতাসীন পক্ষকে সমালোচনার দৃষ্টিতে বিবেচনা করে আসছে পত্রিকাটি। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও পেশাগত সততার কারণে সমাজ-রাষ্ট্রের গুরত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে বর্তমানে রাশিয়ার জনগণের অন্যতম ভরসার মাধ্যম এ নাভায়া গেজেতা।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুর্নীতি, পুলিশি দমন-পীড়ন, অবৈধ গ্রেফতার ও আটক, নির্বাচনে কারচুপি, শিল্প কারখানায় অব্যবস্থাপনা, রুশ সেনাবাহিনীর দেশের অভ্যন্তর ও বাইরের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ইত্যাদির মতো বিষয়ে সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশ করে আসছে নাভায়া গেজেতা। সততার সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য অবশ্য বিস্তর খেসারতও দিতে হয়েছে পত্রিকাটিকে। বিভিন্ন সময় রাশিয়ার ক্ষমতাসীন পক্ষের হয়রানি, হুমকি ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি সংবাদ প্রকাশ করার জন্য হত্যার শিকারও হয়েছেন নাভায়া গেজেতার কয়েকজন সাংবাদিক।
১৯৯৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত পত্রিকাটির ছয়জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন নারী সাংবাদিক আনা পুলিৎজা স্ক্রুপস্কায়া, যিনি চেচনিয়ায় রুশ সরকারের সামরিক অভিযান নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন। তবে এত কিছুর পরও মূলনীতি থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটেনি নাভায়া গেজেতা। তার প্রধান কৃতিত্ব পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক দিমিত্রি মুরাতভের। রাশিয়ায় নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ধারাকে বর্তমানে যারা এগিয়ে নিচ্ছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় রয়েছেন মুরাতভ।
ইতোমধ্যে মুরাতভকে অভিনন্দন জানিয়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের দফতর ক্রেমলিন। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘নিজের আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে তিনি কাজ করেন। তিনি মেধাবী, সাহসী ও নিজের কাজের প্রতি নিবেদিত।’ ঠিক কী কারণে ৮৬ বছর পর ফের নোবেল উঠল সাংবাদিকদের হাতে? শান্তিতে কী অবদান রেখেছেন তারা? বিশ্ব শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের কি সরাসরি বা প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা আছে, বা থাকার সুযোগ রয়েছে? ৮ অক্টোবর শান্তিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণার পর বেরিট রেইস অ্যান্ডারসেনের উদ্দেশে এক সাংবাদিক এসব প্রশ্ন করেন। উত্তরে অ্যান্ডারসেন বলেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পূর্বশর্ত। নোবেল কমিটি বিশ্বাস করে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই পারে এ পৃথিবী থেকে যুদ্ধ ও সংঘাত দূর করতে।’ ‘আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম ব্যতীত একটি গণতান্ত্রিক সমাজ কল্পনাও করা যায় না।’-ঢাকাপোস্ট.কম
রাশিয়ার লড়াকু সাংবাদিক মুরাতফ: মাত্র দুটি কম্পিউটার, দুটি কক্ষ, একটি প্রিন্টার দিয়ে শুরু হয়েছিল শান্তিতে নোবেল পুরস্কারবিজয়ী সাংবাদিক মুরাতফের ‘নোভায়া গ্যাজেট’ পত্রিকা। ছিল না কর্মীদের বেতন। এক পর্যায়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ। তার পুরস্কারের অর্থের একটি অংশ দেন এই পত্রিকায় কর্মরতদের বেতন ও কম্পিউটার কেনার জন্য। এমনিভাবেই ১৯৯৩ সালে সাবেক কর্মস্থল কোমসোলস্কায়া প্রাভদা ছেড়ে মুরাতফ ও তার কমপক্ষে ৫০ জন সহকর্মী মিলে শুরু করেন নোভায়া গ্যাজেট। তাদের লক্ষ্য ছিল রাশিয়ার নাগরিকদের সামনে সৎ, নিরপেক্ষ এবং সমৃদ্ধ তথ্য তুলে ধরা। মানবাধিকার, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এক পর্যায়ে তদন্তে মনোনিবেশ করে এ পত্রিকাটি। নিজের ভিতর অমিত এক সাহস সৃষ্টি করেছিলেন মুরাতফ।
তিনি ১৯৬১ সালের ৩০শে অক্টোবর রাশিয়ার কুইবিশেভে, বর্তমানে সামারা’য় জন্মগ্রহণ করেন। কুইবিশেভ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ৫ বছর দর্শন বিভাগে পড়াশোনা করেন। সেখানেই সাংবাদিকতায় তার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। কলেজে পড়ার সময়েই তিনি স্থানীয় পত্রিকাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হন। পার্টটাইম চাকরি নেন তাতে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর সোভিয়েত আর্মিতে যোগ দেন। দায়িত্ব পালন করেন কমিউনিকেশন বিষয়ক নিরাপত্তা স্পেশালিস্ট হিসেবে। তারপর আবার পত্রিকা। এমনি করে চলতে থাকে তার কর্মজীবন।
নোভায়া গ্যাজেটে তাকে বানানো হয় ডেপুটি প্রেস এডিটর। প্রথম চেচেন যুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিনিধি হয়ে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকতা করেন দিমিত্রি মুরাতফ। ১৯৯৫ সালে তাকে এ পত্রিকাটির সম্পাদকীয় পরিষদের প্রধান করা হয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন। তারপর আর এ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। ২০১৯ সালে তিনি আবার নির্বাচন করেন। তাতে তিনি আবারো নোভায়া গ্যাজেট-এর সম্পাদকীয় পরিষদের প্রধান নির্বাচিত হন। পত্রিকাটির ভূয়সী প্রশংসা করেছে সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। তারা বলেছে, বর্তমানে রাশিয়ায় একমাত্র সমালোচনামূলক পত্রিকা এটিই।
এই পত্রিকাটিতে মাঝে মাঝেই মানবাধিকার লঙ্ঘন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতি এবং ক্ষমতা অপব্যবহারের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে রিপোর্ট করতেন মুরাতফ। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে সমর্থন দেয়ার জন্য তার নিজের ছিল রাজনৈতিক বিশ্বাস। তা নিয়ে অনুসারী সাংবাদিক ও সরকারের সঙ্গে অনেক সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৪ সালে পত্রিকাটি কলামনিস্ট গ্রেগরি রোজনভের লেখা সাতটি আর্টিক্যাল প্রকাশ করে। এতে ১৯৯৮ সালে সের্গেই কিরিয়েঙ্কো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে থাকার সময়ে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের ৪৮০ কোটি ডলার আত্মসাত করেছিলেন বলে তথ্য ফাঁস করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী কলিন পাওয়েলকে লেখা চিঠিতে উত্থাপিত অভিযোগের ভিত্তিতে ওই রিপোর্ট করা হয়েছিল। এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার কংগ্রেসম্যান ফিলিপ ক্রেইন, মাইক পেন্স, চার্লি নুরউড, ড্যান বার্টন ও হেনরি বোনিলা। আমেরিকান ডিফেন্স কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল ওই চিঠি। নোভায়া গ্যাজেট-এ প্রকাশিত ওই খবরে বলা হয় সের্গেই কিরিয়েঙ্কো আত্মসাৎ করা ওই তহবিলের কিছু অংশ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রিয়েল এস্টেট কিনেছেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, ওই চিঠিটি দ্য এক্সিল কৌতুক করে বানিয়েছিল। জবাবে প্রধানমন্ত্রী সের্গেই কিরিয়েঙ্কো বিদ্রোহ করার জন্য মামলা করে দেন নোভায়া গ্যাজেট ও সাংবাদিক রোজনভের বিরুদ্ধে। আদালত থেকে নিজের পক্ষে রায় পান কিরিয়েঙ্কো। ফলে তিনি নোভায়া গ্যাজেটকে নির্দেশনা দিয়ে দেন, কিরিয়েঙ্কোকে নিয়ে অর্থ আত্মসাৎ সম্পর্কিত কোনো খবর প্রকাশ করতে হলে সরকারি ভাবে প্রমাণিত তথ্যই শুধু প্রকাশ করতে বাধ্য তারা।
২০১৮ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার ব্যবসায়ী ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী একটি রিপোর্ট লেখেন সাংবাদিক ডেনিস কোরোতকভ। তা প্রকাশিতও হয় নোভায়া গ্যাজেটে। এরপরই ডেনিস কোরোতকভ এবং নোভায়া গ্যাজেটের প্রধান সম্পাদককে হুমকি দিয়ে তাদের অফিসের গেটে পাঠিয়ে দেয়া হয় ছাগলের কর্তিত মাথা ও অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার সময় দেয়া ফুলের তোড়া। ২০১৭ সালে চেচনিয়াতে সমকামী বিরোধী রিপোর্ট প্রকাশ করে নোভায়া গ্যাজেট। ওই সময় সমকামী বিরোধী বিক্ষোভে নিহত হন তিনজন, আটক করা হয় কয়েক ডজন মানুষকে, ভীতি প্রদর্শন করা হয়।
দিমিত্রি মুরাতফের সময়ে নোভায়া গ্যাজেট পত্রিকার ৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। ২০০০ সালে মস্কোতে একটি এপার্টমেন্ট ভবনে হত্যা করা হয় ইগর দোমনিকভকে। ২০০১ সালে চেচনিয়ায় ক্রসফায়ারে আহত হয়ে মারা যান সাংবাদিক ভিক্টর পপকভ। রাশিয়ার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির একটি কেলেঙ্কারি তদন্তের পর ২০০৩ সালে মারা যান সাংবাদিক ইউরি শচেকোচিখিন। চেচনিয়া ও উত্তর ককেশাস অঞ্চল নিয়ে রিপোর্ট করার পর ২০০৬ সালে নিজের এপার্টমেন্ট ব্লকে হত্যা করা হয় আনা পোলিটকোভস্কায়াকে। ২০০৯ সালে গুলি করে হত্যা করা হয় আনাস্তাসিয়া বাবুরোভা এবং নাতালিয়া এস্তেমিরোভাকে। পত্রিকাটি তার চরিত্র হারাচ্ছে এমন অভিযোগে ২০১৭ সালে এই পত্রিকা থেকে পদত্যাগ করেন মুরাতফ। তিনি এ পত্রিকায় কমপক্ষে ২০ বছর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তবে তার অনুপস্থিতি ছিল অল্প সময়ের। তিনি ২০১৯ সালে আবার স্টাফদের ভোটে পদে ফিরে আসেন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com