দেশে বছরে ছয় লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন চাল ‘বিলাসিতায় নষ্ট হয়। সামাজিক অনুষ্ঠান, গৃহস্থালি পর্যায়ে পরিবেশনসহ বিভিন্নভাবে এ অপচয় হয়। নষ্ট হওয়া এ চাল দিয়ে চার হাজারের বেশি মানুষের সারা বছরের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। একটু সচেতন হলেই বিপুল পরিমাণ এই চাল বিনষ্টের হাত থেকে বাঁচানো যায়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি সংসদীয় কমিটিতে দেশে চাল উৎপাদন ও ব্যবহার বিষয়ক গবেষণা তথ্যটি ডিজিটাল পদ্ধতিতে উপস্থাপন করেছে ব্রি। জানা যায়, চালের চাহিদা নিরূপণে দুটি ভিত্তিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ দুটি হচ্ছে হিউম্যান কনজাম্পশন ও নন-হিউম্যান কনজাম্পশন। জনপ্রতি প্রতিদিনের খাবারসহ (ভাত) হিউম্যান কনজাম্পশন হচ্ছে মোট চাহিদার ৭৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশসহ খাবার চাল ৬৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ, মুড়ি ৫ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, চিড়া শূন্য দশমিক ৯১ শতাংশ, খই শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ, পিঠা ও বেকারি পণ্য শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ। অপরদিকে নন-হিউম্যান কনজাম্পশন (বীজ ও পশুখাদ্যসহ বিবিধ ব্যবহার) খাতে চালের প্রয়োজন পড়ে ২৬ দশমিক ২২ শতাংশ। এর মধ্যে বীজ ১ দশমিক ৫২ শতাংশ, ফিড ও অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাতে ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ, কর্তনকালীন ক্ষতি ৫ দশমিক ২০ শতাংশ, ফলোনোত্তর ক্ষতি ৭ দশমিক ১০ শতাংশ এবং প্রক্রিয়াজাতে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।
গবেষণায় ব্রি বলেছে, দেশের মানুষ যে চাল খায় (হিউম্যান কনজাম্পশন) তার মধ্যে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ গৃহস্থালি পর্যায়ে অপচয় হয়। অপচয়ের মধ্যে খাদ্য সংগ্রহ ও প্রস্তুতি পর্যায়ে ৩ শতাংশ, পরিবেশন পর্যায়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং প্লেটে অপচয় ১ দশমিক ১ শতাংশ। গৃহস্থালি পর্যায়ে অপচয়ের প্রধান কারণ অজ্ঞতা ও বিলাসী মানসিকতা বলে ‘ব্রি’ তার গবেষণায় উল্লেখ করেছে।
জানা গেছে, ১৭ কোটি মানুষ হিসাবে গেল বছর দেশে ভোগ্য-চালের চাহিদা ছিলো দুই কোটি ৫২ লাখ মেট্রিক টন। ব্রি’র গবেষণার তথ্য অনুযায়ী এই ভোগ্য-চালের মধ্যে গৃহস্থালি পর্যায়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অপচয় হলে মোট অপচয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৮৬ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে খাদ্য সংগ্রহ ও প্রস্তুতি পর্যায়ে ৩ শতাংশ অপচয়ের হিসাবে চালের পরিমাণ দাঁড়ায় সাত লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। আর পরিবেশন ও প্লেট পর্যায়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হিসাবে অপচয় হয় ছয় লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। সংগ্রহ ও প্রস্তুতি পর্যায়ের অপচয় অজ্ঞতা এবং পরিবেশন প্লেট পর্যায়ের অপচয় বিলাসিতার কারণে হয় বলে ব্রি গবেষণায় উল্লেখ করেছে।
ব্রি’র তথ্য মতে, গৃহস্থালি পর্যায়ে চালের যে অপচয় হয় তা দিয়ে ৯ হাজার ৩৭৬ জন মানুষের সারা বছরের খাবারের জোগাড় হয়ে যায়। অপরদিকে বিলাসিতার কারণে যে পরিমাণ অপচয় হয় তাতে চার হাজার ২৬২ জন মানুষের বছরের খাবার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। সরকারি হিসাব মতে, জনপ্রতি দৈনিক চালের চাহিদা ৪০৫ গ্রাম। সেই হিসেবে বছরে জনপ্রতি চালের দরকার পড়ে ১৪৭ কেজি ৮২৫ গ্রাম।
কারও খাবারের অভাব নেই বলেই তিনি নষ্ট করবেন এই ধরনের মানসিকতা থাকা উচিত নয় ‑ মন্তব্য করে ব্রি’র মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. শাহজাহান কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সকল প্রক্রিয়া শেষ করে একটি শস্যদানা খাবার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছাতে যে দীর্ঘ পরিভ্রমণ তার উপলব্ধি থাকলে কেউ বিলাসিতা করে খাবার নষ্ট করতো বলে মনে হয় না। একটা ভাত তৈরি করতে কত কষ্ট করতে হয়। এটা যে অনুধাবন করবে সে নষ্ট করবে না।
আমরা যে ভাত রান্না করি গড়ে তার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নষ্ট হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, খাবার খাওয়ার সময় নষ্ট করছি। বিয়ে-শাদিসহ বড় বড় অনুষ্ঠানে আমরা খাবার নষ্ট করি। এতে আমাদের কোনও উপলব্ধি হয় না। কিন্তু এই খাবারগুলো দিয়ে কত মানুষের আহার হতো সেটা আমাদের ভেবে দেখা উচিত। যে পরিমাণ খাবার আমরা পরিবেশন পর্যায়ে নষ্ট করছি সেটা না পেয়ে অনেকে হয়তো অনাহারে কাটাচ্ছেন। গৃহস্থালি পর্যায়ের অপচয়টি কেবল সচেতন হলেই ঠেকানো সম্ভব উল্লেখ করে শাহজাহান কবীর বলেন, মানুষের সচেতনতার বিকল্প নেই। আমার টাকা আছে বলেই নষ্ট করবো এটা উচিত নয়। এটা আইন বা নৈতিকতা অনুমোদন করে না। এজন্য আমাদের আহ্বান থাকবে- আমাদের খাবারের জন্য কৃষক থেকে শুরু করে কত মানুষের কত মেহনত তা বিবেচনায় রেখে চলতে হবে।