রাক্ষুসী নদীর আগ্রাসী থাবায় দিশেহারা হয়ে পরেছেন বরিশাল অঞ্চলের নদী তীরের বাসিন্দারা। এ অঞ্চলের ৯১টি নদীর ১২৩টি পয়েন্টে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে ভাঙন আতঙ্কে নদী তীরের মানুষ বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন। ভাঙন প্রতিরোধে ইতোমধ্যে আটটিস্থানে জরুরী ভিত্তিতে কাজ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। অন্যান্য পয়েন্টে স্থায়ীভাবে ভাঙন ঠেকাতে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পাউবোর হিসেবে, গত বছর বর্ষার সময় বরিশাল অঞ্চলের ৭৬টি নদীর ৮৬ পয়েন্টে তীব্র ভাঙন ছিলো। এবার শুকনো মৌসুমের শুরুতেই বিভাগের ৯১টি নদীর ১২৩টি স্থানে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। বরিশাল নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন কীর্তনখোলা নদী তীরের মানুষ। এছাড়া জেলার বাবুগঞ্জের বাহেরচর, রাকুদিয়া, মীরগঞ্জ, দোয়ারিকা ও বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নিজ জন্মভূমি রহিমগঞ্জ, বরিশাল সদরের চরবাড়িয়া, কাউয়ার চর, লামছরি, হবিনগর, কামারপাড়া, আটহাজার, কালীগঞ্জ, ইছাগুড়া, বাউশিয়া, জয়নগর, উলানিয়া, দূর্গাপাশা, উজিরপুরের শিকারপুর, গৌরনদীর আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরবর্তী মিয়ারচর, টিকাসার, মুলাদীর রামচর, ছবিপুর ও সফিপুর, হিজলা উপজেলার ধুলখোলা, মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়া, চানপুর, দড়িরচর-খাজুরিয়া ও শ্রীপুরসহ শতাধিক পয়েন্টে নদী ভাঙন এখন তীব্রতর হয়েছে। এসব এলাকায় নদী ভাঙনে সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পরেছেন শত শত পরিবার। এখনও ভাঙন আতঙ্কে ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে চরম হতাশা আর আতঙ্ক বিরাজ করছে। বরিশালে নদী ভাঙন এখন সারাবছরের দুর্যোগে পরিনত হয়েছে। বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ জাভেদ ইকবাল বলেন, নদীতে পানির দীর্ঘ স্থায়ীত্বের কারণে ভাঙন প্রতিরোধে পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছেনা পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ কারণে যথাসময়ে ভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছেনা। তিনি আরও বলেন, গত একবছরে পাউবো থেকে বিভিন্নস্থানে নদী ভাঙন প্রতিরোধে জরুরী ভিত্তিতে সাড়ে নয় লাখ জিও ব্যাগ ফেলা হলেও নদী ভাঙন প্রতিরোধ হয়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, জিও ব্যাগ ফেলার পর জোয়ারের তোড়ে সেগুলো স্থানচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। ফলে কারনে ভাঙন প্রতিরোধ হচ্ছেনা। পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশাল জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ নুরুল ইসলাম সরকার জানান, জরুরী ভিত্তিতে বিভিন্নস্থানে নদী ভাঙন প্রতিরোধে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। ভাঙনের তীব্রতা থেকে জনগনের সহায়-সম্পদ রক্ষায় আরও দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া আরও ১৬টি প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে নদী ভাঙন প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরবর্তী গৌরনদীর মিয়ারচর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে তারা এখন দিশেহারা হয়ে পরেছেন। বাবুগঞ্জের সন্ধ্যা নদীর তীরবর্তী বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নিজ জন্মভূমি রহিমগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা মোঃ হারুন-অর রশিদ বলেন, তাদের গ্রামে ব্যাপক নদী ভাঙন দেখা দিলেও ভাঙন প্রতিরোধে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। হিজলার ধুলখোলা এলাকার বাসিন্দা আকতার হোসেন জানান, মেঘনার তীব্র ভাঙনে ঐতিহ্যবাহী আলীগঞ্জ বাজার জামে মসজিদ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পাশাপাশি হুমকির মুখে রয়েছে স্থানীয় বেশকয়েকটি বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ভূমি অফিস, বসত-ঘরসহ বাজার-ঘাট। মুলাদী উপজেলার সফিপুর এলাকার বাসিন্দা মোঃ নুরুল হক খান বলেন, ইতোমধ্যে কয়েকশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী মৃধারহাট বাজারটি রাক্ষুসী জয়ন্তী নদী গ্রাস করে নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে জয়ন্তী নদী এখন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। মেহেন্দিগঞ্জের শ্রীপুর এলাকার বাসিন্দা মালেক খান বলেন, বছরের পর বছর ধরে নদী ভাঙন অব্যাহত থাকলেও ভাঙন প্রতিরোধে সংশ্লিষ্টদের তেমন কোন ভূমিকা নেই। কালাবদরসহ আশপাশের নদীগুলো আগ্রাসী হয়ে ওঠায় ঐতিহ্যবাহী শ্রীপুর বাজার, দুটি বিদ্যালয়ের ভবন, মাদরাসাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তারা (ক্ষতিগ্রস্তরা) সহায়তা নয়; নদী ভাঙনরোধে স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রাণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি করেছেন।