গ্রামের নাম পাড়াগাঁও। ময়মনসিংহের ভালুকার হবিরবাড়ি ইউনিয়নে এর অবস্থান। নামের মতোই এর প্রকৃতি। তবে সেই পাড়াগাঁওকে বাংলাদেশের ‘রোল মডেল’ বানিয়েছেন মো. আব্দুল মোতালেব। এক সময়ের হাসির পাত্র হওয়া ‘পাগল’ উপাধি পাওয়া এই ব্যক্তি ‘খেজুর মোতালেব’ নামেই এখন বেশি পরিচিত। সৌদি খেজুর যে বাংলাদেশে চাষ করা সম্ভব তা করে দেখিয়েছেন তিনি। গতকাল সোমবার (১৫ নভেম্বর) সকালে যখন তার বাগানে আমাদের পা পড়লো, তখন কিছু একটা নিয়ে ভেতরে তোড়জোড় চলছে। এগিয়ে গিয়ে দেখা গেলো, কয়েক ফুট মাটি খুঁড়ে বিশালাকার এক খেজুর গাছ তোলা দেখছেন আলুথালু পোশাকে এক ব্যক্তি। সেখানে কাজ করছেন কয়েকজন কর্মচারী।
পরে জানা গেলো, আলুথালু পোশাকের ব্যক্তিটিই মোতালেব। হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানালেন। শুরুতেই গাছ তুলছেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই গাছ দুটো বিক্রি হয়ে গেছে। বাইরে ট্রাক এসে দাঁড়িয়ে আছে। যাবে সিলেটের জাফলং। দুটো গাছের দাম চার লাখ টাকা। আর খেজুরসহ হলে গাছ দুটির দাম হতো ছয় লাখ! খেজুর গাছের এত দাম শুনে চক্ষু চকড়গাছ হওয়ার উপক্রম। গাছ দুটি ছিল আজোয়া খেজুরের। সৌদি খেজুর চাষে ‘পাগল মোতালেব’র বছরে আয় ৫০ লাখ টাকামোতালেবের খেজুর গাছ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়, একটির দাম তিন লাখ টাকা/ছবি: জাগো নিউজ
বলতে বলতে জীবন সংগ্রামের ঝাঁপি খুলে বসেন মোতালেব। বাগান শুরু করেছেন ২০০১ সালে। তবে তার আগে ১৯৯৮ সালে যান সৌদি আরব। সেখানে কাজ করতে করতে একপর্যায়ে কাজ পান খেজুর বাগানে। দুই বছরে বেতন বেড়ে হয় ছয়শ রিয়াল। বাড়ি থেকে দেশে ফেরার তাগাদা পেতেন। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন দেশে ফিরে আসবেন, আর কখনো সৌদি যাবেন না। তিনি ছুটিতে এলে আর ফিরবেন না, এটা আঁচ করতে পেরে সৌদির মালিকপক্ষ তার ছয় মাসের বেতন আটকে দেয়। সেই বেতন না নিয়েই মোতালেব দেশে চলে আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন ৩৫ কেজি বীজ খেজুর।
তিনি বলেন, ‘আমি এটা বুঝছি, যারা কাজ করতে পারে তারা সব জায়গায় কাজ করতে পারে। বিদেশ যাওয়া লাগে না। টাকা রাখতে পারলে দেশেও রাখা যায়। ১৯৯৫ সালে ৯৭ হাজার টাকা লোকসান করি বিদেশি মাগুর চাষ করে। আমার ১০-১২ বিঘা জমি আছে। বিদেশ যাওয়ার জন্য মালয়েশিয়ায় টাকা দিয়েও মার খাই। পরে ৯০ হাজার টাকা খরচ করে সৌদি যাই। লাখ টাকার ওপর ঋণ ছিল।’ ‘বাগানে কাজ করতে করতে একদিন খেজুর নামালাম গাছ থেকে। খেয়ে দেখলাম পৃথিবীতে যত ফল আছে এর ওপর কোনো ফল নেই। এত স্বাদ। সেটা ছিল আজোয়া আর সুক্কারি জাতের খেজুর। সেদিন থেকেই আমার টার্গেট ছিল দেশে আমার এই খেজুর নিয়ে যেতেই হবে। কাটিং করা একটা গাছ নিয়ে লাগিয়ে দেখি তাতে ফল আসে। এরপর ভাবি বাংলাদেশে তো ছয় ঋতু, এখানে দুই ঋতু, তাহলে টেকাবো কীভাবে? তখন নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। দেখলাম গাছ টেকানো যায়। ব্যস ৩৫ কেজি বীজ খেজুর নিয়ে এসে পড়ছি।’
কোনো কিছুতে সহজে হাল না ছাড়া মোতালেব বলেন, ‘লোকে বিদেশে গেলে স্যুটকেস-ভর্তি জিনিস নিয়ে আসে, আর আমি আনছিলাম খেজুর। দেশের মানুষ হাসাহাসি করতো, পাগল বলতো। আমার দেওয়া বীজ থেকে ২৭৫টি চারা বের হয়। চারাগুলো সাইজ করে লাগাইনি। তিন বছর তো বেশি সময় না, মুকুল এলে চারা লাগাবো। শুরু করি ২০০১ সালে। ১৭ মাস পর একদিন আমার বউ এসে বললোÍ তোমার গাছে মুকুল আইছে। আমি তো বিশ্বাসই করিনি। পরে বাজি ধরে গিয়ে দেখি সত্যি মুকুল বের হয়েছে, কিন্তু পুরুষ। তখন একটা সাহস এলো পুরুষ মুকুল যখন আসছে তখন মেয়েও হবে। সেটা চৈত্র মাসের ১৭ তারিখ ছিল। বৈশাখে একটা এলো সেটাও পুরুষ। পরের বছর পাঁচটা, তারপরের বছর সাতটা, তার পরেরবার নয়টা গাছে মুকুল এলো, সবগুলো পুরুষ। তবুও হতাশ হইনি। তবে টেনশন বাড়ছিল।’ ‘হাল ছাড়ছিলাম না। পরের বছর ১১টা গাছের মধ্যে একটা গাছে মেয়ে মুকুল এলো। তুলে আলাদা করে লাগালাম। এই গাছটাই শাইখ সিরাজের নামে রাখলাম। আজোয়া গাছ। এটাই বাংলাদেশে প্রথম সৌদি খেজুর গাছ। প্রতি বছর উনি আসেন একবার। ওনার কাছে অনেক ঋণ আছে বলেই এটা ওনার নামে রেখেছি।’ ‘এখন আমি কাটিং জানি। নারী গাছগুলো থেকে গজানো চারা নারীই হয়। সেগুলো পুরুষ গাছে কাটিং করে বসানো যায়। এটা সারা বাংলাদেশে আমার মতো কেউ পারে না। আমার সব গাছ কাটিং করে মেয়ে বানাইছি।’
নিজেকে খেজুর মোতালেব নামে পরিচয় দিতে ভালোবাসা এই ব্যক্তি জানান, সাধারণত প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে মুকুল আসে। ফল আসে জুন, জুলাই, আগস্টে। কাঁচা খেজুর বেশি বিক্রি করেন। পাকাটা শুকাতে গেলে খরচ, আবহাওয়াও বাধ সাধে। কাঁচাটা মিষ্টি হয়ে গেলে বিক্রি শুরু হয়। তার বাগানের খেজুরের সর্বনি¤œ দাম এক হাজার টাকা কেজি। সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা। তার বাগানে আছে আজোয়া, সুক্কারি, মরিয়ম, আম্বার, বকরি ও বাঁশি জাতের খেজুর। আজোয়া সবচেয়ে বেশি চলে। আম্বারের দাম সবচেয়ে বেশি। আজোয়া বিক্রি হয় কেজিপ্রতি আড়াই হাজার টাকা।
নিজের বাগান অনেকটা গুছিয়ে আনা মোতালেবের অন্যতম গুণ গাছের কাটিং জানা। তিনি বলেন, ‘আমি কাটিং করলে ১০০টার মধ্যে ৯৫টাই বাঁচে। আমি সাতটা গাছ দিয়ে পাঁচ বিঘার বাগানের সব গাছই মেয়ে বানিয়েছি। বিক্রি তো করতেই আছি। প্রতি চার-পাঁচটা গাছের সঙ্গে একটা পুরুষ গাছ লাগে। আমার বাগানে বর্তমানে ছয়শর বেশি গাছ আছে। আরেকটি পাঁচ বিঘার বাগান আছে শুধু পুরুষ ও বীজ গাছ।’
তার ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের যে কোনো জায়গার যে কোনো মাটিতে সৌদি খেজুর লাগালেই হবে। তবে মেয়ে গাছ হতে হবে। তার এই বাগানের ছয়শ গাছের প্রায় সবগুলো ফলন দিচ্ছে। একটা গাছ দেড়-দুইশ বছর বাঁচে। বজ্রপাত ছাড়া সহজে গাছ মরে না। সৌদিতে গাছ নাকি এত সুন্দরও থাকে না।
বড় গাছ অর্থাৎ ১৫-২০ বছর বয়সী সব গাছের জন্য চারপাশ দিয়ে মই আকারে বানিয়েছেন লোহার খাঁচা। খেজুর পাড়া, গাছের পরিচর্যা করতে এতে সুবিধা হয়। বানাতে খরচও হয়ে ২০-৩০ হাজার টাকা করে। আর পরিচর্যাও করা লাগে নিয়মিত। ইউরিয়া, ফসফেট, গোবর সার দিতে হয়। মাঝে মধ্যে পানি দেওয়া লাগে। পরিষ্কার করা লাগে নিয়মিত। এছাড়া এখন তার কোনো খরচ নেই।
প্রতি বছর একটি গাছ থেকে কী পরিমাণ খেজুর পাওয়া যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গড়ে একেকটা গাছে ৫০-৬০ কেজি খেজুর পাওয়া যায় বছরে। কোনো কোনো গাছ একশ কেজি খেজুর দেয়। চারা বিক্রি থেকেও লাভ পাওয়া যায়। আমার এখানে কলমের নারী চারা নিলে ৫০ হাজার টাকা লাগবে। ফল ধরবে এটা স্ট্যাম্পে লিখে গ্যারান্টি দেই। এছাড়া বীজের চারা আছে ২০০ থেকে ১০ হাজার, ১৫ হাজার টাকা। তবে গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না। কেউ কেউ বাটপারি করে বিক্রি করে।’
বাগানের অনেক গাছের গোড়া বা একটু উপর থেকে ডাল বা ফড়কি বের হতে দেখা গেলো। এগুলো কলম করে নামিয়ে লাগালে মেয়ে গাছ হলে ফড়কি আকারে বের হওয়া চারাটিও মেয়ে হবে। এই কাটিং সবাই পারে না। এটা শেখানোর জন্য সরকারি প্রশিক্ষণের দরকার আছে বলে মনে করেন মোতালেব। প্রথম তিন বছর অনেক কষ্ট করেছেন বলে জানান। তবে বাগান থেকে আজীবন আয় আসবে, এটাই বড় লাভ বলে মনে করেন তিনি।
তার বাগানে কর্মচারী আছে ১৫ জন। সারা বছর কাজ করে। একেকজনের মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া লাগে। বাগান করতে গিয়ে ছয় বিঘা জমি বিক্রি করছিলেন। আবার কিনেছেন। এখন বছরে ৫০ লাখের মতো আয় হয় তার। আবার খরচও আছে। বাড়তি হিসেবে খেজুরের পাশাপাশি আদা ও কচু লাগান। এ থেকে বছরে আসে ১০-১২ লাখ টাকা।
মোতালেবের অভিজ্ঞতায় এমনও হয়েছে, সৌদির চেয়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত খেজুরের নাকি স্বাদ বেশি। আর সুক্কারি খেজুর সাইজে ছোট কিন্তু ফলন বেশি। লম্বা হয় আম্বার খেজুর। আসল সৌদির যে পাঁচটি জাত আছে তার সবগুলো আছে তার। তবে সুক্কারি আর আজোয়া গাছই বেশি।
তবে মোতালেব স্বীকার করলেন কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ পাশে না দাঁড়ালে টিকতে পারতেন না। বনবিভাগ অনেক ‘ঝামেলা’ করেছে। শাইখ সিরাজ অনেক সহযোগিতা করেছেন। বর্তমান জেলা প্রশাসকও সহযোগিতার কথা বলেছেন। বলেন, ‘আমার এখানে আসা অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা করবো। এজন্য ঘর করছি। ছয়টা চারা বিক্রি করছি এজন্য।’
উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘নতুন করে শুরু করতে হলে মেয়ে চারা দিয়ে শুরু করতে হবে। বীজের চারা দিয়ে শুরু করে লাভ নেই। সুযোগ হলে আমি প্রশাসনের সামনে খেজুর উপস্থাপন করে দেখিয়ে দিতে চাই যে, কত ভালো খেজুর এখানে হয়। সরকারের সহযোগিতা পেলে সারাদেশে এটা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।’
‘সরকারি সহযোগিতা পেলে গাছ বিক্রি না করে হাজার হাজার চারা বানাতাম। আরও কম দামে চারা বিক্রি করতাম। আগে দেড় লাখ টাকা বেচতাম। এখন ৫০ হাজারে বিক্রি করি শাইখ সিরাজের কথায়। আরও বেশি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। কয়েকশ লোক আমার কাছ থেকে চারা নিয়ে বাগান করছে। আমাদের দেশে খেজুর শুকানো কঠিন। মেঘ-বৃষ্টি বেশি। তাই কাঁচাই বিক্রি করি। খেজুর পেড়ে পাকা অবস্থায় ৬-৭ দিন লাগে শুকাতে। মেশিন কিনবো। মেশিন কেনার প্ল্যান আছে।’ সাহস আর হতাশ না হয়ে লেগে থাকাই মোতালেবের সফলতার চাবিকাঠি। সারাদেশে এই খেজুর ছড়িয়ে দিতে পারাই তার সবচেয়ে বড় সফলতা হবে বলে মনে করেন তিনি।