মহানবী (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর কুবার মসজিদে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করা হয়। এতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই ইমামতি করেন। এদিন জুমার নামাজের আগে তিনি দুটি খুতবা প্রদান করেন। তখন থেকেই শুক্রবারে জুমার নামাজের জামাতের আগে দুটি খুতবা প্রদানের প্রথা প্রচলিত হয়। নবী করিম (সা.)-এর সময় ইসলাম আরব উপদ্বীপেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের মাতৃভাষা ছিল আরবি। খুলাফায়ে রাশেদিনের আমলে ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে এসব অঞ্চলে আরবি ভাষা দ্রুত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে পরিণত হয়েছিল। তাই স্বভাবতই জুমার নামাজের খুতবা আরবিতে প্রদান করা হতো।
আরবি ‘খুতবা’ শব্দের অর্থ বক্তব্য, উপদেশ, বক্তৃতা বা ভাষণ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ থেকে খুলাফায়ে রাশেদিন, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের যুগে মুসলিম জাহানে আরবি ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় জুমার মূল খুতবা প্রদানের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। নবী করিম (সা.)-এর পরবর্তীকালে ইসলাম আরব সীমানা পেরিয়ে অনারব অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করলেও আরবি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় জুমার খুতবা প্রদান হয়নি।
মহানবী (সা.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি, তাঁর শ্রোতাদের ভাষাও ছিল আরবি। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে ‘নবী করিম (সা.) জুমার নামাজের আগে দুটো খুতবা দিতেন। একটা শেষ করে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বসতেন, তারপর দ্বিতীয় অংশটি দিতেন। খুতবার মাঝে তিনি পবিত্র কোরআনের আয়াত তিলাওয়াত করে মানুষকে উপদেশ দিয়ে বোঝাতেন। (মুসলিম, কিতাবুল জুমা)। ঈদের খুতবায় তিনি সমসাময়িক বিষয়াদিতে করণীয় দায়িত্ব সম্বন্ধে সবাইকে সজাগ করতেন। আর্থিক কোরবানি করতে অনুপ্রাণিত করতেন। মুসলমানদের অনুসৃত প্রধান ধর্মগ্রন্থের ভাষা আরবি, যে ভাষায় পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। তাই ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম নামাজসহ অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত-বন্দেগিতে মুসলমানেরা আরবি ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। জুমার নামাজের আগে খুতবা পাঠ নামাজেরই বিশেষ অংশ। তাই এ ব্যাপারে পূর্ববর্তী আলেম-উলামাদের ইজমা বা ঐকমত্য হয়েছেন যে মূল খুতবা আরবিতেই পাঠ করতে হবে। তবে খুতবা পাঠের আগে প্রত্যেক মুসলিম উম্মাহ নিজ নিজ দেশে মাতৃভাষায় মূল বক্তব্যটুকু বলে দিলে সবাই খুতবার সারমর্মের প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী হতে পারবে। খতিব সাহেব জুমার খুতবা দুটির প্রতিটি আরবি ভাষায় পেশ করার পর মিম্বরে দ-ায়মান অবস্থায় স্থানীয় মাতৃভাষায় এর অনুবাদ পেশ করতে পারেন। আরবি ভাষার বিপরীতে সাধারণ জনগণের মাতৃভাষায় জুমার খুতবা প্রদানের বৈধতায় বর্তমান যুগের আলেমদের মতৈক্য রয়েছে।
মাতৃভাষায় জুমার খুতবার আগে সমাজে প্রচলিত অন্যায়-অবিচার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদকাসক্তি, মজুতদারি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বোমাবাজি, হত্যাকা- ইত্যাদি সামাজিক অনাচার ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং দুর্লঙ্ঘ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অথবা গরিব-মিসকিন, অনাথ আত্মীয়স্বজন, অভাবগ্রস্ত পাড়া-প্রতিবেশী, অভুক্ত অনাহারী ও আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে সামর্থ্যবানদের সহযোগিতার দিকনির্দেশনা প্রদান করা দরকার। সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে, পরিবার পরিকল্পনায়, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ও অর্থনৈতিক যাবতীয় বৈষম্য বা বেকারত্ব দূরীকরণে আত্মকর্মসংস্থানের বাস্তব কোনো রূপরেখা, কর্মপদ্ধতি, সতর্কবাণী বা কোনো আভাস-ইঙ্গিত জুমার খুতবার আগে সাধারণ আলোচনায় স্থান দিতে হবে। সমাজে বিশ্বমানবতার ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, মৈত্রী, আন্তধর্মীয় স¤প্রীতি ও সা¤প্রদায়িক সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠামূলক উদারনৈতিক উপদেশ ইমাম-খতিবদের সাপ্তাহিক বক্তব্যে বা ভাষণে থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
মানুষকে সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজ থেকে বিরত থাকার পবিত্র কোরআনের অমোঘ নির্দেশ বাস্তবায়নে দেশের তিন লাখ মসজিদের ইমাম-খতিবকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাঁদের মূল কাজ ইসলামের প্রকৃত আদর্শ ও নীতি-বিধান কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতিসহকারে মানুষের মধ্যে জুমার নামাজের আগে মূল খুতবায় অথবা খুতবার আগে বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় শ্রোতাদের বোধগম্য বয়ান তুলে ধরা ও যুগোপযোগী কথাবার্তা বলা। সমাজে যখন যে সমস্যা প্রকটতর দেখা দেবে, জুমার খুতবায় ইমাম ও খতিব সাহেব তা থেকে মানুষকে উদ্ধারের সঠিক পথ দেখাবেন। একজন ইমাম বা খতিব তখনই সমাজের জন্য কল্যাণকর হবেন, যখন সব বিষয়ের ওপর তাঁর স্বচ্ছ ধারণা যেমন- বিজ্ঞান, কম্পিউটার, ইন্টারনেট এসব আধুনিক বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান রাখবেন। যুবসমাজের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়রোধে সাপ্তাহিক জুমার খুতবায় ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণীর সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আদর্শ জাতি গঠনে ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। সমাজে ন্যায়নীতি, আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় মসজিদের ইমাম-খতিবদের একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তাই সমকালীন প্রয়োজনীয় বিভিন্ন যুগোপযোগী বিষয়ে তাদের গভীরভাবে অধ্যয়ন, চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করে মাতৃভাষায় জুমার খুতবার সারমর্ম প্রদানে তাঁদের বাস্তবসম্মত কার্যকরী বক্তব্য উপস্থাপন
করা অত্যাবশ্যক। লেখক: ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক। ইমেইল: dr.munimkhan@yahoo.com