গত ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। তার এ উপস্থিতি কৌশলগত দুই প্রতিবেশীর সুসম্পর্ক স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলে। তবে এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিশালী অর্থনৈতিক বন্ধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি ক্রমেই বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অন্যতম প্রধান উপাদান হয়ে উঠছে।
দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কে বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব ও বাংলাদেশে চীনা প্রভাব বাড়তে থাকায় ভারতের করণীয় কী হতে পারে, তা নিয়ে মতামত জানিয়েছেন দিল্লির ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক গ্রোথের অধ্যাপক প্রভাকর সাহো এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনসের ফেলো দুর্গেশ কে রাই। গত রোববার (১৬ জানুয়ারি) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ডেকান হেরাল্ডে প্রকাশিত লেখাটির সারমর্ম জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো- বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারই নয়, তাদের অন্যতম প্রধান রপ্তানি গন্তব্যও বটে। কিন্তু, চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দক্ষতা ও দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত বিনিয়োগ সা¤প্রতিক অতীতে বাংলাদেশের বৈদেশিক অর্থনৈতিক প্রোফাইলে ভারতের প্রভাব কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ৯৭ শতাংশ আমদানি পণ্যে শুল্কছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে চীন। কাজেই, ভারত যদি বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রভাব ধরে রাখতে চায়, তাহলে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টিকারী সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মূল ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে হবে।
গত এক দশকে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য দ্রুত বেড়েছে। ২০১০ সালের ৩৪০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে ২০১৮ সালে এর পরিমাণ প্রায় তিনগুণ বেড়ে ৯৮০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এমনকি করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বেশি স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে। এসময় ভারতের বৈশ্বিক বাণিজ্য ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশের সঙ্গে কমেছে মাত্র ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আবার, ২০২১ সালে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের সাথে তাদের বাণিজ্য বেড়েছে দ্রুতগতিতে।
তবে, ভারত সবসময় বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ‘অনুকূল বাণিজ্য ভারসাম্য’ বজায় রেখেছে, যা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালে ভারতের পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশ ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০২১ সালে তা বেড়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছায়। বিপরীতে, বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে ভারতের অংশ ৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং এটি তাদের অষ্টম বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য। এক্ষেত্রে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ অবদান রেখে বাংলাদেশের ১৫তম রপ্তানি গন্তব্য চীন। কিন্তু, ২০২০ সালে বাংলাদেশের আমদানি বাজারের প্রায় ৩০ শতাংশ দখল করে শীর্ষ রপ্তানিকারক হয়ে উঠেছে চীন, এর ১৬ শতাংশ দখলে রেখে ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়। অর্থাৎ, ভারতের তুলনায় চীনের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য বৈষম্য বেশি।
দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকার (সাফটা) অংশ হওয়ায় বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই একে অপরের বাজারে শুল্কছাড়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়। তবে বেশ কিছু শুল্ক-বহির্ভূত বাধা (নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার বা এনটিবি) রয়েছে, যা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পূর্ণাঙ্গ সম্ভাবনার পথে অন্তরায়। বাংলাদেশ ভারতে পণ্য রপ্তানি নিয়ে দুটি সুনির্দিষ্ট উদ্বেগের কথা বলে- প্রথমত, নতুন ভারতীয় শুল্কবিধি, যা ‘বাংলাদেশে তৈরি’ নিশ্চিতকরণের শর্ত দেয় এবং দ্বিতীয়ত, পাটজাত পণ্য, হাইড্রোজেন পারক্সাইড ও মাছ ধরা জাল আমদানিতে ভারত আরোপিত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক।
সীমিত বাণিজ্যিক রুট: বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে শুল্ক-বহির্ভূত বাধাগুলোর মধ্যে সীমিত রুট, কাস্টমসে হয়রানি, ভিসা সমস্যা প্রভৃতির কথা শোনা যায়। এগুলো দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের খরচ বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের জন্য ভারতের সঙ্গে বেনাপোল-পেট্রাপোল দিয়ে সড়কপথে বাণিজ্যের তুলনায় চীনের সঙ্গে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের অবকাঠামো বেশি কার্যকর।
যেসব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র দ্বিপাক্ষিক বণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে ও যেখানে জরুরি মনোযোগ প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম হলো বিদ্যমান স্থলসীমান্ত কাস্টমস স্টেশনগুলোর (এলসিএস) অবকাঠামো উন্নত করা এবং বন্দর জটিলতাবিহীন নতুন এলসিএস তৈরি। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি আরও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে। এটি মানদ-ের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সামঞ্জস্য ও সনদ স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তাকে আবশ্যক করে তুলেছে।
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত দেশগুলোর বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায় বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারস্পরিক সহযোগিতার উপায় খুঁজে দেখতে পারে বাংলাদেশ ও ভারত। একই ধরনের সুযোগ রয়েছে পাট খাতেও।
চীনকে নিয়ে উদ্বেগ: তুলনামূলক সস্তা পণ্য রপ্তানি, আগ্রাসী বিনিয়োগ ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর জন্য আর্থিক সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের বাজার দখল করে নিচ্ছে চীন। বাংলাদেশে এরই মধ্যে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পে (চট্টগ্রাম ও মোংলা) অর্থায়ন ও নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ লাইনের উন্নয়নের মতো বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। হাত দিয়েছে মৈত্রী সেতু, পয়ঃনিষ্কাশন কেন্দ্র, অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিমানবন্দর স¤প্রসারণ, সড়ক ও রেল যোগাযোগের মতো দৃশ্যমান অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতেও। এগুলো তাদের সম্পর্কে জনমনে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। ভারতের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে চীনকে আটকাতে অবশ্যই বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে ভারতকে। এটি বাংলাদেশের জন্যেও ভালো। কারণ, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য তুলনামূলক প্রতিকূল এবং এতে চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় ভারতকে অবশ্যই দৃশ্যমান অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে হবে এবং এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে অর্থনৈতিক লাভের কথা বিবেচনা না করেই বাংলাদেশকে সহায়তা করতে হবে।