দেশে বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুটের ওপরে। স্থানীয় উত্তোলন ও আমদানীকৃত এলএনজি দিয়ে বতর্মানে দৈনিক সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭০ কোটি ঘনফুটের মতো। এর মধ্যে বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক এলএনজি যুক্ত হচ্ছে ৪০ কোটি ঘনফুট। সব মিলিয়ে প্রতিদিন গ্যাসের সরবরাহে ঘাটতি থাকছে ১৩০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ সংকটে বর্তমানে ২ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসন্ন গ্রীষ্মের বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেলে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যকার এ ঘাটতির পরিমাণ আরো তীব্র হবে। অন্যদিকে কাতার ও ওমানের দুটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়ায় সমস্যা আরো জটিল রূপ নিয়েছে। গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান-২০১৭ অনুযায়ী, চলতি বছরে দেশে গ্যাসের চাহিদা হবে ৪৬০ কোটি ঘনফুট। পর্যায়ক্রমে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা দাঁড়াবে ৫২৫ কোটি ঘনফুটে এবং ২০৩০-৩১ সালে হবে ৬২২ কোটি ঘনফুটের। তবে এ ক্রমবর্ধমান এ গ্যাসের চাহিদা কীভাবে পূরণ করা হবে, সে বিষয়ে খাতসংশ্লিষ্টদের স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা এখনো দৃশ্যমান নয়। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় গত দুই অর্থবছরে দেশে এলএনজির কার্গো এসেছে ১৩৮টি। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছে ৬৬টি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছে ৭২টি। পেট্রোবাংলার তথ্যানুসারে, গত বছরের তুলনায় এ অর্থবছরে এলএনজির অন্তত ২৪টি কার্গো কম আসবে। গত দুই বছরে স্পট ও দীর্ঘমেয়াদি মিলিয়ে চার মিলিয়ন টনের ওপর এলএনজি দেশে এলেও এবার সরবরাহ সাড়ে ৩ মিলিয়ন টনের নিচে থাকবে বলে জ্বালানি বিভাগ-সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের তথ্য-উপাত্ত বলছে, সরবরাহকৃত মোট গ্যাসের ৭৮ শতাংশ আসার কথা স্থানীয় উৎস থেকে। এছাড়া ১৭ ও ৫ শতাংশ আসার কথা যথাক্রমে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ও স্পট মার্কেট থেকে কেনা এলএনজির মাধ্যমে। বর্তমানে স্থানীয় উৎস থেকে সরবরাহ ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় সরবরাহ চালু থাকলেও উচ্চমূল্যের কারণে স্পট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রয়েছে।
দেশে গ্যাসের চাহিদা সবচেয়ে তীব্র হয় গ্রীষ্মে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের চাহিদা বেশি হওয়ায় জ্বালানি পণ্যটির সংকটও ওই সময় থাকে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) মূল্য অস্থিরতার কারণে এবার গ্রীষ্ম আসার আগে শীতকালেই দেশে গ্যাসের সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় গ্রীষ্মকালে এ সংকট আরো তীব্র হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের ভাষ্যমতে, দেশে শীত মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে কম। গ্যাসের ব্যবহারও হয় কম। জ্বালানি বিভাগও গ্যাস রেশনিংয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি খুব সহজেই সামাল দিতে পারে। তবে পরিস্থিতি ভিন্ন হয়ে ওঠে গ্রীষ্মকালে। চাহিদা বেশি থাকায় ওই সময় রেশনিংয়ের পরিকল্পনা খুব একটা কাজে আসে না। এ সময় গ্যাসের চাহিদা পূরণের বিষয়টি অনেকাংশেই নির্ভর করে আমদানীকৃত এলএনজির ওপর। কিন্তু পণ্যটির আন্তর্জাতিক বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি আসন্ন গ্রীষ্মের চাহিদা পূরণ নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় এলএনজির অবদান মাত্র ২২ শতাংশ। যদিও পণ্যটির সরবরাহ কমে যাওয়ায় এখন সার্বিক গ্যাস ব্যবস্থাপনাতেই তার প্রভাব পড়ছে। তবে এখন পরিস্থিতি খুব জটিল হয়ে দেখা দেয়নি। বর্তমানে যা চলছে, সেটিকে বলা চলে প্রাথমিক পর্যায়। নিজস্ব উৎস অনুসন্ধান ও গ্যাসের বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করা না গেলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, গ্যাসের বর্তমান সংকটের পেছনে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিরতা ও কভিডসহ নানা কিছুর প্রভাব রয়েছে। মহামারীর প্রভাব ছাড়াও দেশের জ্বালানি খাতে এ অবস্থা তৈরি হবে, তা আগেই অনুমেয় ছিল। কারণ আমরা গ্যাসের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী জোগান-সংস্থান করতে পারিনি। আগামীতে জ্বালানির সংস্থান কীভাবে হবে তা নিয়ে নানা কথা বলা হলেও বাস্তবে অনুসন্ধান কার্যক্রমের জায়গাগুলোয় মনোযোগ দেয়া হয়নি। বর্তমানে এরই প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
দেশে এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনের জন্য নিয়োজিত ভাসমান টার্মিনাল দুটি। এর মধ্যে একটি অকেজো থাকায় গ্যাস সংকট আরো তীব্র হয়ে উঠেছে বলে মনে করছে পেট্রোবাংলা। সংস্থাটি জানিয়েছে, এ সংকট গ্রীষ্ম মৌসুমে যাতে আরো প্রকট আকার ধারণ না করে, সেজন্য আরেকটি টার্মিনাল দ্রুত কমিশনিংয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বাজারেও জোর দেয়া হচ্ছে। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় প্রতি মাসে চারটি করে কার্গো দেশে আনার পরিকল্পনা পেট্রোবাংলার। তবে বেশিও আসতে পারে। বছরে ৪৮টি কার্গো দেশে আনা গেলে এবং হিসাব-নিকাশ করে স্পট থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে কার্গো কেনা গেলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে। বিষয়গুলো নিয়ে বর্তমানে পেট্রোবাংলা কাজ করছে।
গ্যাসের সরবরাহ সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন থেকে শুরু করে পণ্য রফতানিতে এরই মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করতে সরবরাহ কোম্পানিগুলোকে বারবার চিঠি দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে তারা গ্যাসের মূল্য না বাড়ানোর জন্যও সরকারের প্রতি বারবার অনুরোধ জানিয়ে চলেছে।
আসন্ন গ্রীষ্মে গ্যাসের এ সরবাহ ঘাটতি আরো প্রকট হয়ে ওঠার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ঘাটতি পূরণের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, আসন্ন গ্রীষ্ম মৌসুমের কথা মাথায় রেখে কোন কোন খাতে কী পরিমাণ গ্যাসের প্রয়োজন হবে, তার একটি হিসাব আমরা করছি। দেশীয় গ্যাস বাদে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় আমরা কী পরিমাণ গ্যাস পাব সেটারও হিসাব করা হচ্ছে। সব হিসাব করে ঠিক কী পরিমাণ গ্যাসের ঘাটতি থাকবে, তা স্পট থেকে কেনা হবে নাকি দীর্ঘমেয়াদি যেসব চুক্তি করা হয়েছে সেগুলো থেকে আসবে সে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এখন হাতে যেহেতু সময় আছে এবং এলএনজির বাজার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, ফলে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বর্তমানে যে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, তাতে প্রতি এমএমবিটিইউ কিনতে হচ্ছে ১০ ডলার করে। অন্যদিকে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ২৪ ডলার। অর্থাৎ স্পটের দাম দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিমূল্যের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বেশি। এত উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করতে গেলে তার ভর্তুকি মেটানোর মতো প্রয়োজনীয় অর্থ নেই পেট্রোবাংলার কাছে। গ্যাসের বিদ্যমান ট্যারিফ ব্যবস্থায় সব ধরনের হিসাব-নিকাশ এখন এলএনজিকে ঘিরে। এলএনজির উচ্চমূল্যের যুক্তিতে সব খাতে গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবও করছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। বিষয়টি নিয়েও আপত্তি রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ খন্দকার আবদুস সালেক সুফি বলেন, বর্তমানে গ্যাস মিশ্রণে ৭৮ শতাংশ উত্তোলিত নিজস্ব গ্যাস আর ২২ শতাংশ এলএনজি। স্পট মার্কেট থেকে আনা হচ্ছে ৫ শতাংশ। ফলে গণহারে বিপুল মাত্রায় দাম বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক কমানো যেতে পারে। পেট্রোবাংলার গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করা যেতে পারে। এমন বিকল্প চিন্তা করতে হবে। সামনের তিন বছর আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।