সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনেকটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের মতো হচ্ছে। কারণ রেকর্ডসংখ্যক ইউনিয়ন পরিষদে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হয়েছেন। জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ-জানিপপ চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এমনটিই মনে করেন। এছাড়া র্যাব’র বর্তমান ও সাবেক ৭ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে একটি বড় বার্তা বলে মনে করেন তিনি। মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের মাঠ সমতল করার অংশ হিসেবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুলিশ এবং র্যাব’র কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞায় ৭ জনের নাম জানা গেলেও এই তালিকায় সর্বমোট ৫৬৭ জনের নাম রয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, এই সংখ্যাটি এখানেই যে সীমাবদ্ধ থাকবে সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আগামী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এই সংখ্যা ৩ হাজার বা এর থেকেও বেশি হতে পারে। সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে কলিম উল্লাহ জানান, কয়েকটি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে ব্যাপক অনিয়ম দেখা গেছে। এই কয়েকটি ইউনিয়নের চিত্রই বলে দেয় সারা দেশের পরিস্থিতি কেমন ছিল। বিশেষ করে বিনা প্রতিযোগিতায় যে নির্বাচিত হওয়ার হিড়িক, তা অস্বস্তির লক্ষণ এবং তা নির্বাচনের মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
ড. কলিম উল্লাহ বলেন, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আমেরিকা যে বার্তাটি দিচ্ছে- একটি সভ্য রাষ্ট্রের জন্য হিউম্যান রাইটস গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। এখানে যে কা-টি ঘটেছে তা আসলেই ন্যক্কারজনক। নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এখন রাষ্ট্রীয় সংস্থা যদি মানবাধিকার হরণ করে তার চাইতে ন্যক্কারজনক আর কিছু হতে পারে না। এটা একটি লাতিন সিন্ড্রম। লাতিন আমেরিকায় আমরা শুনেছি এমন কর্মকা- ঘটতো। সেটি আমাদের দোরগোড়ায় এসে দেখা দেবে সেটা আমরা কখনোই ভাবিনি। তিনি বলেন, বছর দু’য়েক পরে দেশে জাতীয় নির্বাচন। আসলে নির্বাচনের ময়দান সমতল করার অংশ হিসেবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। সম্প্রতি যে পুলিশ এবং র্যাব’র কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এটি এখানেই শেষ নয়। এটি এক ধরনের খসড়া। তা এখানেই যে সীমাবদ্ধ থাকবে বা আছে সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ হচ্ছে ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা দেয়াটা সহজ। পুরো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাটা কঠিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের পরীক্ষার মধ্যে আছে। একটা সময় ছিল যখন ঢালাওভাবে ইরান, উত্তর কোরিয়া কিংবা মিয়ানমারের মতো দেশের ওপর তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখন তারা উন্নততর রণকৌশলে অগ্রবর্তী হয়ে ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা প্রদান করছে। তাছাড়া ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞাটা অনেক বেশি ইফেক্টিভ। যাতে তার মাধ্যমে অন্যরা সাবধান হয়ে যেতে পারে। প্রকাশ হয়েছে মাত্র ৭-৮জনের নাম। সংখ্যাটা আসলে ৫৬৭ জন। এই সংখ্যাটা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে থাকবে।
তিনি উল্লেখ করেন, সময়ই বলে দেবে এটা কতদূর পর্যন্ত বাড়বে। ৫৬৭ জনের যে সংখ্যাটা যথেষ্ট বিচার বিবেচনা এবং গবেষণা উদ্ভূত ফলাফল। সুতরাং শুধু শুধু এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে- এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ৫৬৭ জনের এই তালিকার মধ্যেই প্রকাশিত ৭ জনের নাম আমরা দেখলাম। বাকিরা কারা বা তাদের নাম পরিচয় কি সেটা আমি বলতে পারি না। তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা লবিষ্ট নিয়োগ না করে এঙ্গেজড হতে যাচ্ছেন। কিন্তু আমার মনে হয় সুপার পাওয়ার রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের চেষ্টা করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছু হবে না। আমাদের উচিত হবে নিজেদের অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে সেইভাবে সমাধানের দিকে যাওয়া।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে কলিম উল্লাহ বলেন, আমরা চরণদ্বীপ, বোয়ালখালী, মাধাইয়া, চান্দিনা এবং কচুয়াসহ কয়েকটি ইউনিয়ন আমরা আমলে নিয়েছিলাম। সেখানে আমরা দেখেছি ব্যাপক অনিয়ম সংগঠিত হয়েছে। যা আসলে নীতি বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। তো তিনটি কেস স্টাডির অবস্থা যদি এরকম হয়, তাহলে সারা দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি কেমন ছিল তা সহজে অনুমেয়।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাবিত আইন নিয়ে এই নির্বাচন পর্যবেক্ষক বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করে এটি গত ৫০ বছরের পেন্ডিং কাজ। দেরিতে হলেও এটি যে শুরু করা হয়েছে তাতে অবশ্যই সাধুবাদ দেয়া দরকার। আরেকটি বিষয় হলো- আইনগত একটি ভিত্তি থাকলে নির্বাচন কমিশন গঠন করাটা অনেক সহজতর হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি পর পর দুই বার সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। তার থেকে বেরিয়ে গিয়ে এবার আইনের ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় সেটা যদি করা যায়; এখন দেখার বিষয় কাকে করতে যাচ্ছে। যদি ধামাধরা টাইপের লোক হয় তাহলে তো অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের যে ভাবমূর্তি তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এখন সর্বজনগ্রাহ্য এই ধরনের ব্যক্তিত্ব নিয়ে যদি করা যায় তাহলে আর যাই হোক দেশ একটি বড় সংকট থেকে রক্ষা পাবে। তিনি বলেন, আইন প্রণয়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। এটি যার যার ব্যক্তিগত জায়গা থেকে বিভিন্নভাবে দেখতে পারে। তবে আমি মনে করি একেবারে আইন না থাকার চেয়ে এটা ভালো। এখন আমরা দেখি যে তা কতটা কার্যকর হয়।