শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২২ অপরাহ্ন

ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে ভয়ংকর অপরাধের ৭ অভিযোগ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

বহুল আলোচিত মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে সোমবার (৩১ জানুয়ারি)। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা। দীর্ঘ শুনানি, সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের জন্য এ দিন ধার্য করেছেন বিচারক। সিনহা হত্যা মামলার প্রধান আসামী বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ আসামির কী সাজা হবে তা নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে কৌতুহল। নিহত সিনহার পরিবারেরর পাশাপাশি টেকনাফ থানার ওসি থাকাকালীন প্রদীপের হাতে নির্যাতিত শত শত পরিবার এ মামলার রায় শুনতে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. ইসমাঈল চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন।
সিনহা হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে টেকনাফ মডেল থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ ইন্সপেক্টর প্রদীপ কুমার দাশের নানা অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে। এ মামলার আসামি এবং সাক্ষীদের জবানবন্দিতেও উঠেছে হত্যাকা-ের দিন তার নির্মম আচরণের বিবরণ। চলুন জেনে নেই, অভিযোগপত্রে ওসি প্রদীপ সম্পর্কে উঠে আসা ৭টি ভয়ংকর অভিযোগ প্রসঙ্গে
১. প্রদীপের ক্রসফায়ার বাণিজ্য: সিনহা হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি প্রদীপ কুমার দাশ ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানা থেকে টেকনাফ মডেল থানায় যোগদান করেন। সিনহা হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, দায়িত্ব নিয়েই ওসি প্রদীপ ক্রসফায়ার বাণিজ্যে নামেন। মাদক নির্মূলের আড়ালে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশাল অঙ্কের অর্থ কামানো ছিল তার নেশা। তার অপরাধের কার্যপ্রণালী কেমন ছিলো তার বিবরণ মেলে অভিযোগপত্রে।
কোন ঘটনায় মাদক উদ্ধার হলে অথবা টার্গেট কোন ব্যক্তিকে মাদক দিয়ে ফাঁসানো হলে (ফিটিং মামলায়) প্রথমত আসামি বা ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হতো। তারপর তার নিজস্ব সোর্স অর্থ আদায়ের জন্য দেন দরবার করত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিমকে ক্রসফায়ার না দেয়ার বিনিময়ে পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হতো। চাহিদা অনুয়ায়ী টাকা না পেলে ভিকটিমকে ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা করে তার আত্মীয়স্বজনদের মামলার আসামি করা হতো। আসামিদের বাড়িঘর হতে উচ্ছেদ ও বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ, সম্পদ বেদখল করে লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে আদায় করাই ছিল তার নেশা ও পেশা। এই কাজের জন্য তিনি তার সমমনা পুলিশ সদস্যদের দ্বারা নিজস্ব একটি পেটোয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন। (অভিযোগপত্র থেকে পাঠ-অ, পৃষ্ঠা-১১)
২. কু-কর্মের বিষয়ে সদা সতর্ক: অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, কু-কর্মের বিষয়ে যেন কেউ সংবাদ সংগ্রহ করতে এবং প্রচার করতে না পারে সে বিষয়ে প্রদীপ কুমার দাশ ছিলেন খুব সতর্ক। কিন্তু প্রদীপের এই স্পর্শকাতর জায়গাতেই হাত দিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা। এ নিয়ে র‌্যাবের রিমান্ড শেষে আদালতে দেওয়া মামলার প্রধান আসামি ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী চমকে যাওয়ার মতো তথ্য দিয়েছেন। ঘটনার কিছু দিন আগে এলাকায় ডাকাতের আনাগোনা বেড়েছে এবং একটি গ্রুপ অত্র এলাকায় ভিডিও চিত্রধারণ করার নামে অন্য উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। গ্রুপটিকে সুবিধামতো পেলে জানে শেষ করে দিতে হবে। (অভিযোগপত্র থেকে পাঠ-ই, পৃষ্ঠা-১৬)
৩. সিনহা পানি চান; ওসি প্রদীপ গলায় পাড়া দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন: মেজর সিনহার শরীরে ৪ রাউন্ড গুলি বর্ষণের পর ওসি প্রদীপকে ফোন করেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী। তিনি আহত সিনহাকে হাসপাতালে না পাঠাতে বলেন। ৩০ মিনিটের মধ্যে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে আসেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তারপরের নির্মমতার বর্ণনা মেলে ওই চেকপোস্টে সেদিন কর্তব্যরত এপিবিএন সদস্য এসআই শাজাহানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে।
ওসি প্রদীপ স্যার আসার পর ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও নন্দদুলালের সঙ্গে একান্তে কথা বলে। কথা বলা শেষে ফোর্স নিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা মেজর (অব.) সিনহার কাছে যায় এবং রাগত স্বরে বলে ‘অনেক টার্গেট করে কুত্তার বাচ্চারে শেষ করতে পারছি’। প্রদীপ স্যার মেজর (অব) সিনহাকে পা দিয়ে নড়া-চড়া দিয়ে দেখে বেঁচে আছে কি না। মেজর সিনহা তখনও গোঙ্গাচ্ছিল এবং পানি চাচ্ছিল, তখন প্রদীপ স্যার গালাগালি করে লাথি মারে এবং মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য পা দিয়ে গলা চেপে ধরে’। (অভিযোগপত্র থেকে পাঠ- পৃষ্ঠা-১৬, প্যারা-৩)
৪. মেজর সিনহা নড়াচড়া করছে কি না ৩ বার জানতে চান প্রদীপ: ঘটনার প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা পর মেজর সিনহাকে হাসপাতালে নেওয়ার দায়িত্ব পান বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের এএসআই লিটন মিয়া। হাসপাতালে পৌঁছা পর্যন্ত ওসি প্রদীপের ৩ বার কল পান তিনি। এএসআই লিটন মিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ‘হাসপাতালে যাওয়ার পথে ওসি প্রদীপ স্যারের সঙ্গে আমার ৩ বার কথা হয়। তিনি আমাদের অবস্থান ও মেজর সাহেব নড়াচড়া করছে কি না জানতে চায়’। (অভিযোগপত্র পৃষ্ঠা-১৬)
৫. সিফাতকে ওয়াটার থেরাপি দেন প্রদীপ: সিনহার সহকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী সাহেদুল ইসলাম সিফাত জানান, তার ওপর নির্যাতনের নির্দেশ দিয়েছিলেন ওসি প্রদীপ। ওসি প্রদীপ আমাকে চেকপোস্টের ভেতরে এনে মারধর করে এবং চিৎকার করে বলে ‘শালারে পানি ঢাল’। (অভিযোগপত্র পৃষ্ঠা-১৭)
৬. পরিকল্পনা হয় জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে:জুলাই মাসের শেষ দিন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তবে, পুলিশের সোর্স ও মামলার আসামি নুরুল আমিনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে জানা যাচ্ছে, ওই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই সিনহাকে বাগে পেতে মুখিয়েছিলেন ওসি প্রদীপ।
নুরুল আমিন স্বীকারোক্তি দেন ‘জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আইসি লিয়াকত স্যারের মাধ্যমে ওসি প্রদীপ স্যার আমাদের টেকনাফ থানায় ডাকিয়া পাঠান। আমি ও নিজাম উদ্দিন থানায় গেলে ওসি প্রদীপ স্যার ও আইসি লিয়াকত স্যারের সঙ্গে দেখা হয়। ওসি প্রদীপ স্যার বলেন সিনহা টিনহা এসব ঝামেলা রাখা যাবে না। গায়েব কইরা ফেলতে হবে’। (অভিযোগপত্র পৃষ্ঠা-১৭)
৭. সেনা সদস্যকে তাড়িয়ে দেন ওসি প্রদীপ: শামলাপুর চেকপোস্টের ঘটনা শুনে ছুটে আসেন রামু সেনা নিবাসের এএসইউ’র সার্জেন্ট মো. আইয়ুব আলী। তিনি মেজর সিনহাকে চিনতে পারেন। ব্যক্তিগত মোবাইল দিয়ে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার ছবি তুলতে গেলে পরিচয় দেয়ার পরও ওসি প্রদীপের নির্দেশে পুলিশ সদস্যরা তার মোবাইল কেড়ে নেয় এবং ঘটনাস্থল থেকে তাকে তাড়িয়ে দেয়। পরে সেনাবাহিনীর লে. মুনতাসির আরিফের সঙ্গে বাহারছড়া পুলিশ কেন্দ্রে যান সার্জেন্ট আইয়ুব। ওসি প্রদীপ তাকেও সেখান থেকে যেতে বলেন। ফোনে বলেন সেনাবাহিনীর জন্য কাজ করতে পারছেন না।
টেকনাফের ভুক্তভোগীদের অভিযোগ: প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ ওসি থাকাকালীন মাদক নির্মূলের নামে ২২ মাসে ১৪৪টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে। তাতে মারা গেছে ২০৪ জন। নিহত সবাইকে দেয়া হয়েছে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের তকমা। অথচ সাধারণ মানুষ বলছে, ক্রসফায়ারে নিহতদের বেশিরভাই ছিল নিরীহ মানুষ।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com