ইউপি নির্বাচন
দলীয় মনোনয়নে অনুষ্ঠিত প্রথমবারের (২০১৬) ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের ফলাফলের তুলনায় এবার (২০২১-২২) পিছিয়ে গেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। গতবার আওয়ামী লীগের দুই হাজার ৬৫২ জন চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছিলেন। এবার সেখানে দলটির দুই হাজার ১৯০ জন চেয়ারম্যান জয় পেয়েছেন।অর্থাৎ, গত বারের চেয়ে এবার দলটির মনোনীত চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীরা পাঁচশোর মত ইউপিতে পরাজিত হয়েছেন। অপরদিকে জয় বেড়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। আগেরবার ৮৮৯ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হলেও এবার তার দ্বিগুণ হয়েছে। এবার এক হাজার ৭৮৯ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন।
এদিকে, প্রথমবারের মত দলীয় মনোনয়নে অনুষ্ঠিত ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশ নিলেও এবার তারা অংশ নেয়নি। তবে দলটির অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জয়ীও হয়েছে বলে জানা গেছে। গত সোমবার (৭ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত সাত ধাপে মোট চার হাজার ৪৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। মূলত এই সাত ধাপের ভোটের মধ্য দিয়ে এবারের ইউপি নির্বাচন শেষ হয়েছে। অবশ্য বৃহস্পতিবার দেশের আরও ১০টি ইউপিতে ভোট রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২১ জুন থেকে গত ৭ ফেব্রুয়ারি সাত ধাপে ভোট হয়। এসব ধাপে চার হাজার ১১১টি ইউনিয়ন পরিষদের তফসিল ঘোষণা করা হয়। সোমবার পর্যন্ত ফল প্রকাশ হয়েছে চার হাজার ৪টির। বাকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। এই ফলাফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দুই হাজার ১৯০টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছে। অপরদিকে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছে এক হাজার ৭৮৯টি ইউপিতে। এছাড়া জাতীয় পার্টি ৪৪টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৮টি, জাতীয় পার্টি (জেপি) ৭টি ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী ২টি ইউনিয়ন পরিষদে জয় পেয়েছেন। এছাড়া খেলাফত মজলিশ ১টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ২টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ৩টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ২টি ও জাকের পার্টি ১টিতে জয় পেয়েছেন।
এই ৭ ধাপের ইউপি নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা প্রথম ধাপে ২৬৮ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৪৮৫ জন, তৃতীয় ধাপে ৫২৮ জন, চতুর্থ ধাপে ৪১১ জন, পঞ্চম ধাপে ৩৪১ জন, ষষ্ঠ ধাপে ১১৭ জন এবং সপ্তম ধাপে ৪০ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। সব মিলিয়ে দলটির দুই হাজার ১৯০ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৬৬ জন বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। বাকি এক হাজার ৮২৪ জন লড়াই করে জিতেছেন। অথচ ২০১৬ সালে দলীয় প্রতীকে প্রথমবার অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের দুই হাজার ৬৫২ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যে এক হাজার ৭৮৯টিতে জয় পেয়েছেন তার মধ্যে প্রথম ধাপে ৮৮ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৩৩০ জন, তৃতীয় ধাপে ৪৪৬ জন, চতুর্থ ধাপে ৩৯৮ জন, পঞ্চম ধাপে ৩৪৬ জন, ষষ্ঠ ধাপে ৯৫ জন এবং সপ্তম ধাপে ৮৬ জন নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি এক হাজার ৭৮৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চেয়ারম্যান হয়েছেন। ২০১৬ সালে স্বতন্ত্ররা জয়ী হয়েছিলেন ৮৮৯টিতে।
এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সাত ধাপে ৩৭১ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। এ হিসাবে এবার ৯ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। এর আগে ২০১৬ সালে চেয়ারম্যান পদে মাত্র ২০৭ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন; যা ভোট হওয়া মোট ইউনিয়ন পরিষদের মাত্র ৫ ভাগ। অবশ্য সেটাও ওই সময় পর্যন্ত দেশের রেকর্ড ছিলো।
এদিকে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ছয় পর্বে অনুষ্ঠিত হয় চার হাজার ১০৪টি ইউপির নির্বাচন। এতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ দুই হাজার ৬৫২টি ইউপিতে, বিএনপি ৩৬৭টি, জাতীয় পার্টি-জাপা ৫৬টি, জেপি ৪, জাসদ ৮, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৩, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ১, জাকের পার্টি ১ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৮৮৯টি ইউপিতে জয়ী হয়।
আওয়ামী লীগের ফলাফলের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত বারের চেয়ে কম পেয়েছি এর অর্থ এই নয় যে ফল বিপর্যয় হয়েছে। গতবার সেভাবে বিদ্রোহী ছিলো না, নৌকার সঙ্গে ধানের শীষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলো। যার কারণে নৌকা বেশি জিতেছিল। এবার আমরা দেখেছি অনেক জায়গার নৌকা বিরোধীরা নৌকার বিদ্রোহীর পক্ষে কাজ করেছে। এজন্য হয়তো বিদ্রোহী প্রার্থী অনেক জায়গায় জিতেছে। তবে, আমি মনে করি হারজিত বড় বিষয় নয়। এখানে বিজয় হয়েছে গণতন্ত্রের। এই নির্বাচন গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নিয়েছে। মানুষকে নির্বাচন বিমুখী করার জন্য বিএনপি-জামায়াত যে অপপ্রচার করেছিলো মানুষ জবাব দিয়েছে। এই নির্বাচনে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভোট তার প্রমাণ দেয়।
দলের সভাপতিম-লীর সদস্য মুহম্মদ ফারুক খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিএনপি নির্বাচন করবে না বলে ঘোষণা দিলেও ভেতরে ভেতরে তারা নির্বাচন করেছে। তাদের অনেকে জয়ীও হয়েছে। এর প্রভাব ভোটে পড়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতিটি ইউপিতে ৮/১০ জন যোগ্য চেয়ারম্যান প্রার্থী আছে। কিন্তু আমাদের তো চয়েজ করতে হয়েছে একজনকে। এক্ষেত্রে অনেক যোগ্য নেতা, দলের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন এমন কেউ কেউ আবেগের বশে দাঁড়িয়ে যায়। কখনো কখনো বিরোধী পক্ষের উস্কানিতেও তারা দাঁড়িয়েছে। তাদের অনেকে জয়ীও হয়েছে। তাছাড়া কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে যেখানে আমাদের দলের আধিপত্য বেশি সেখানে আমরা কাউকেই প্রতীক না দিয়ে উন্মুক্ত রেখেছি। যেসব জায়গায় স্বাভাবিকভাবেই স্বতন্ত্র প্রতীকের প্রার্থীই জয়ী হয়েছে এবং তারা আমাদের দলেরই কর্মী বা সমর্থক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলীয় ভিত্তিতে এবার দ্বিতীয়বারের মত ভোট হয়েছে। জাতীয় প্রতীক ছাড়া এরকম নির্বাচন প্রায় দুইশো বছর ধরে চলছে। এখান থেকে বেরিয়ে দলীয়ভাবে ভোট অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত হওয়ার জন্যও কিছুটা সময় তো দরকার। এটার আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় আছে। কতজন বিরোধী হয়ে দাঁড়ালো, কেন দাঁড়ালো সেটা দেখছি। আমাদের মনোনয়নে ভুল-ত্রুটি ছিলো কী না সেটাও পর্যালোচনা করছি। এসব পর্যালোচনা করে আগামীতে এই প্রবণতা কমে যাবে। -বাংলাট্রিবিউন