সাফিনাজ রাশনা, বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই নারী অতিস¤প্রতি করোনামুক্ত হয়েছেন। কিন্তু শারীরিক দুর্বলতাসহ নানা ধরনের ভোগান্তি থেকে এখনও মুক্ত নন তিনি। রাশনা বলেন, ‘আমি সিঁড়ি দিয়ে অনায়াসেই উঠি সবসময়। তবে করোনামুক্ত হওয়ার পর এখন শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে। ঘুম থেকে উঠেও পুরো শরীর কাঁপছে। দু’মিনিটের বেশি ফোনে কথা বলতে দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। খাবারও তেতো লাগছে। করোনা পজিটিভ থাকার তুলনায় নেগেটিভ হওয়ার পর কষ্ট বেশি অনুভব হচ্ছে।’
একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন গণমাধ্যমকর্মী সাজ্জাদ হোসেন। তিনি করোনায় সংক্রমিত ছিলেন প্রায় এক মাসেরও বেশি, তার বাসা ছয় তলায়। তার ভাষ্য, ‘আমি সিঁড়ি দিয়ে বিরতীহীনভাবে বাসায় উঠে যেতাম। কিন্তু এখন প্রতিটি ফ্লোরে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে উঠতে হয়। রিকশায় দুই মিনিটের পথও এখন আমার কাছে অনেক দূরের লাগে।’
রাশনা এবং সাজ্জাদের মতো অনেকেই ওমিক্রনে সংক্রমিত হয়ে এবং সেরে ওঠার পরও নানাধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওমিক্রন নিয়ে শুরু থেকেই ভুল বার্তা প্রচার হয়েছে। ওমিক্রন করোনার আগের ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টার মতো সিভিয়ার বা জটিল নয়Í এমন কথা শুরু থেকেই প্রচারে এলেও এটি একটি ‘মিথ’ (গল্প বা কেচ্ছা)। শুরু থেকেই আরও বলা হচ্ছিল, ডেল্টার তুলনায় অতিসংক্রমণশীল ওমিক্রনে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার কম; এটাও সঠিক বার্তা নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ‘এই মিথ বিশ্বাস করা ঠিক হবে না’।
গত ২৪ ঘণ্টায় (১০ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত) নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৭ হাজার ২৬৪ জনের। ওমিক্রন তান্ডবের মধ্যে গত তিন সপ্তাহ পর এই প্রথম শনাক্ত রোগী সংখ্যা ৮ হাজারের নিচে নেমে এলো। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর সেই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। এদিন আরও ৪১ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। মৃত্যুর এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা আরও বেশ কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
প্রায় দুই বছর ধরে চলা এ মহামারির সংক্রমণচিত্রে ঊর্ধ্বগতি-নি¤œমুখী চিত্র দেখেছে দেশ। তবে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা দেখা গিয়েছে বছরের জুন জুলাই ও আগস্ট মাসে। ডেল্টার তা-বে সেসময়ে দেশ একদিনে সর্বোচ্চ রোগী আর সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছে। তবে আগস্টের শেষদিকে এসে সংক্রমণ কমতে শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। শনাক্তের হার কমে আসে ১ শতাংশের কাছাকাছি। তবে বছর শেষে নতুন ত্রাসের জন্ম দেয় করোনার অতিসংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। ডেন্টার তুলনায় পাঁচ থেকে ছয়গুণ বেশি সংক্রমণক্ষমতা নিয়ে ওমিক্রন ছড়াতে থাকে বাতাসের গতিতে। আর চলতি বছরের মধ্য জানুয়ারি থেকে সংক্রমণ ফের ঊর্ধ্বমুখী।
গত ১৭ জানুয়ারিতে দৈনিক শনাক্ত হওয়া রোগী সংখ্যা ৭ হাজার ছাড়িয়ে এরপর থেকে শনাক্ত টানা বাড়তে থাকে। এর মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজির ছাড়িয়ে যায় রোগী সংখ্যা আর শনাক্তের হার ৩৩ দশমিক ৫৫ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায় গত ২৮ জানুয়ারি। তবে ধীরে সেখান থেকে রোগী সংখ্যা কমছে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক শনাক্ত ১০ হাজারের নিচে নেমে আসে, ঠিক ছয়দিন পর সেটা নেমে এলো ৮ হাজারের নিচে।
এদিকে দেশে গত জানুয়ারি মাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ওমিক্রনে আক্রান্ত ছিলেন বলে জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। বাকি ২০ শতাংশ ছিল ডেল্টায় আক্রান্ত। আইইডিসিআর প্রতিষ্ঠানটির অন্তর্র্বতীকালীন প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। পুরো জানুয়ারি মাস জুড়ে চার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ১৪৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১১৮টি বা ৮০ শতাংশ ওমিক্রন এবং ৩০টি বা ২০ শতাংশ ডেলটা পাওয়া গেছে। ওমিক্রনের মধ্যে আবার অমিক্রন বিএ১ ৩৯ শতাংশ এবং বিএন২ ৪১ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের করা জেনোম সিকোয়েন্সিংয়ে ওমিক্রন ৮২ শতাংশ এবং ১৮ শতাংশ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আবার হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ ওমিক্রন এবং বাকি ৩৫ শতাংশ ডেল্টা বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। মৃদু উপসর্গের কারণে ওমিক্রন রোগীদের থেকে দ্রুত সংক্রমণ প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে।
গত ২৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র সিডিসির পরিচালক ড. রচেল ওয়ালেনস্কি বলছেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের উপসর্গকে ‘মৃদু’ হিসেবে আখ্যায়িত করা বিভ্রান্তিকর। তিনি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ হলো মৃদু মানে হালকা নয়।’
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক মানুষ মনে করছেন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট কোভিড-১৯ এর মৃদু রোগ। কিন্তু ঘটনা তা নয়। সংক্রমণে মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে অনেকের। তাই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। শুধু ওয়ালেনস্কি নন, বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ হাফিংটন পোস্টকে জানিয়েছেন, মৃদু উপসর্গ সবসময় মৃদু হবে এমন নয়। যেমন, কোভিড-১৯ এর মৃদু সংস্করণ বলতে হাসপাতালে ভর্তি না হওয়াকে ধরা হয়। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর জানান, যখন এই ভ্যারিয়েন্টকে মৃদু বলা হয়েছিল তখনই এর প্রতিবাদ করা হয়েছিল। আর ওমিক্রন মৃদু- এ ধারণার কারণে একে হেলাফেলা বা অবহেলা করার প্রবণতা খুব লক্ষণীয়। এটা অনেক বড় ধরনের ভুল। যখন একটি ভাইরাস অনেক মানুষকে একসঙ্গে আক্রান্ত করে, তখন একে মৃদু ভাবার কোনও সুযোগই নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘সব মিলিয়ে ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর গোটা বিশ্বে ৫ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। কাজেই ওমিক্রন ততবেশি ক্ষতি করে না- আমার মনে হয় প্রচলিত এই মিথ অবশ্যই চিন্তা করার বিষয় রয়েছে।’ প্রতিটি জীবন মূল্যবান উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি জীবনের ক্ষেত্রে যেখানেই আমাদের ইন্টারভেনশনের সুযোগ রয়েছে, সেখানেই আমরা যতি টানতে চাই। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং টিকা নেওয়ার কোনও বিকল্প নেই।’-বাংলাট্রিবিউন