ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানকে কেন্দ্র করে স্পটলাইটে এখন তাইওয়ান। এ অঞ্চলটিও তার বৃহৎ প্রতিবেশী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। কিছু বিশ্লেষক এরইমধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া পরিস্থিতির সঙ্গে চীন-তাইওয়ানের বাস্তবতার মিল খুঁজতে শুরু করেছেন। দীর্ঘদিন ধরেই স্বনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলটিতে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে বেইজিং। ইউক্রেন ও তাইওয়ানের মধ্যে কিছুটা মিল থাকলেও বহু দূরের দুই অঞ্চলের বাস্তবতায় অনেক ফারাকও রয়েছে। চীন-তাইওয়ান সম্পর্কে বৈরিতা সত্ত্বেও দুই পক্ষের মধ্যে বাণিজ্য থেমে নেই। তাইওয়ানের কোম্পানিগুলো চীনে প্রায় ছয় হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। অঞ্চলটির প্রায় ১০ লাখ মানুষ চীনে থাকে। উভয় পক্ষের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিবেচনায় অনেকের ধারণা, নিজস্ব অথনৈতিক স্বার্থেই চীন হয়তো অঞ্চলটিকে আক্রমণ করবে না।
তাইওয়ানের পরিষেবা খাতে কাজ করেন ৪০ বছরের ইথান লিন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের পরিস্থিতি ইউক্রেনের সঙ্গে খুব একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। রাজনৈতিক হোক কিংবা সংযোগের দিক থেকে, সব ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাইওয়ানের সঙ্গে চীনের অনেক বিনিময় রয়েছে। তাই আমি মনে করি না যে, এটি বিপজ্জনক।’
চীনা চাপ: চীনের পূর্ব উপকূল থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে ২৩ মিলিয়ন মানুষের একটি স্বশাসিত দ্বীপ তাইওয়ান। অঞ্চলটিকে নিজেদের ভূখ- বলে দাবি করে চীন। সম্প্রতি বেইজিং ও তাইপের মধ্যকার উত্তেজনা চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। সাই ইং-ওয়েন ২০১৬ সালে তাইওয়ানের নেতৃত্ব নেওয়ার পর থেকেই পুরোনো সমস্যাটি আরও তীব্র হয়েছে। চীন অঞ্লটির ওপর সামরিক চাপ বাড়িয়েছে। কাছাকাছি পানিসীমায় জাহাজ পাঠিয়েছে। দফায় দফায় লঙ্ঘন করেছে তাইওয়ানের আকাশসীমা।
চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির ইস্টার্ন কমান্ড গত মঙ্গলবার জানিয়েছে, তারা সম্প্রতি পূর্ব চীন সাগরের একটি অজ্ঞাত স্থানে মহড়া চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র কী হস্তক্ষেপ করবে? এখন জোরেশোরে যে প্রশ্নটি উঠছে সেটি হলো, যুক্তরাষ্ট্র বা তার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো যেখানে ইউক্রেনকে রক্ষা করতে সেনা পাঠাচ্ছে না, সেখানে চীন তাইওয়ানে আক্রমণ চালালে তারা হস্তক্ষেপ করবে কিনা। উপরন্তু তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও আনুষ্ঠানিক সম্পর্কও নেই। তবে অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের কাছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করে থাকে। তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে একটি প্রভাবশালী অঞ্চল। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে গাড়িতে পর্যন্ত এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
তাইওয়ানের তামকাং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের একজন অধ্যাপক কাও-চেং ওয়াং। তিনি বলেন, ‘তাইওয়ানের অর্থনীতি ও প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে আরও গুরুত্ব দেবে। তবে আমাদের দেখতে হবে যে, সংঘাত কোন দিকে গড়াচ্ছে।’
ইউক্রেনের রাশিয়ার সামরিক অভিযানের ঘটনায় মস্কোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষেধাজ্ঞায় যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তাইওয়ান। শুক্রবার এ ঘোষণা দেয় সেখানকার কর্তৃপক্ষ। তবে মস্কোর বিরুদ্ধে ঠিক কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিংবা নিষেধাজ্ঞার ধরন কেমন হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। সাইয়ের ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির একজন আইনপ্রণেতা ওয়াং টিং-ইউ। তিনি টুইটারে লিখেছেন, ‘একটি বৃহৎ শক্তি যখন একটি ছোট প্রতিবেশীকে হুঁশিয়ারি দেয় তখন আমরা বসে থাকতে পারি না।’ বহু শত বছর ধরে তাইওয়ান চীনের শাসনের অধীন ছিল। তবে ১৬২৪ হতে ১৬৬১ সাল পর্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য এটি ছিল ওলন্দাজ উপনিবেশ। এরপর আবার চীন তাইওয়ানের দখল ফিরে পায়। তবে ১৮৯৫ সালে প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধে জাপান জয়ী হওয়ার পর তাইওয়ান ফের চীনের হাতছাড়া হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের অন্যতম প্রধান এক শক্তি হিসেবে চীন তার মিত্রদের সমর্থনে আবার তাইওয়ান শাসন করতে শুরু করে। পরাজিত পক্ষ জাপানকে পিছু হটতে হয়।
পরবর্তী ধাপে চীন-তাইওয়ান বিরোধের সূত্রপাত ১৯২৭ সালে। ওই সময়ে চীনজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধ। ১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা জাতীয়তাবাদী সরকারকে উৎখাতের মধ্য দিয়ে এ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটায়। জাতীয়তাবাদী নেতারা পালিয়ে তাইওয়ান চলে যান। এখনও তারাই তাইওয়ান নিয়ন্ত্রণ করে। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ‘উভয় পক্ষের সর্বোত্তম স্বার্থে’ চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে ‘শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলনের’ ওপর জোর দিয়েছেন। চীনের তাইওয়ান বিষয়ক দফতর নিয়মিতভাবে অঞ্চলটির পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে থাকে। বিশ্ব মানচিত্রে তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায় না বেইজিং।
চীনের সামরিক পদক্ষেপের আশঙ্কা কতটা? সিঙ্গাপুরের নানয়াং টেকনোলজিকাল ইউনিভার্সিটির চীনা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ লি মিনজিয়াং। তিনি বলেন, চীন পুনর্মিলন অর্জনের জন্য প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করেনি। তবে আপাতত সামরিক পদক্ষেপের আশঙ্কা নেই। বাইরের ঘটনাগুলো বেইজিংয়ের হিসাব নিকাশের ওপর তুলনামূলকভাবে কম প্রভাব ফেলবে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মালিকানাধীন গ্লোবাল টাইমস পত্রিকা তাইওয়ানকে ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী পূর্ব ডোনেস্ক অঞ্চলের সঙ্গে তুলনা করেছে। এ সপ্তাহেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সাক্ষাৎকারে তাইওয়ানের ওপর চীনের হামলার ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যেখানে তিনি পুতিনের পদক্ষেপের প্রশংসা করেছিলেন। চীনা কর্মকর্তারা অবশ্য আরও সতর্ক। তারা বলছেন, তাইওয়ান আর ইউক্রেন এক নয়। এ সপ্তাহেই চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনয়িং বলেছেন, তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে এমন মন্তব্য নতুন নয়। তবে এই মুহূর্তেই তাইওয়ানে চীনের সামরিক অভিযান চালানোর মতো কোনও আলামত এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। এপি অবলম্বনে।