উঠতি ধনীদের চাপে অভিজাত ক্লাব
রাজধানীর নতুন-পুরনো অন্যান্য ক্লাবেও এখন সদস্যপদ পেতে বিপুল অংকের বিনিয়োগ নিয়ে নামতে হচ্ছে ধনীদের। ধনীর সংখ্যা বাড়লে অভিজাত ক্লাবের কদরও অনেক বেড়ে যায় বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, বিস্ময়কর হলেও সত্য, অতিধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সবার শীর্ষে। ধনীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় অভিজাত ক্লাবের চাহিদা বাড়বে এটিই স্বাভাবিক। সম্পদ ও অভিজাত ক্লাব যদি সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির একমাত্র উপজীব্য হয়, সেটি দুঃখজনক। দেশে যে হারে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে, সে হারে শিল্পায়নসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিসর বাড়ছে না। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ পরিস্থিতিও ধনী বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
রাজধানীর বনানী ও উত্তরা ক্লাবের সদস্যপদের দাম উঠেছে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকায়। সদস্যপদের ধরন অনুযায়ী নির্ধারিত হচ্ছে ক্লাবের সদস্য ফি। মাত্র এক বছর আগে উদ্বোধন হওয়া ঢাকা বোট ক্লাবের সদস্যপদ পেতেও ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা গুনতে হচ্ছে। বোট ক্লাবের চেয়েও বেশি দর উঠেছে পূর্বাচল ক্লাবের। নতুন গড়ে ওঠা এলাকা পূর্বাচলভিত্তিক এ ক্লাবের সদস্যপদ এখন ৪০ লাখ টাকায় ঠেকেছে। রাজধানী ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, চট্টগ্রাম ক্লাব ও কুমিল্লা ক্লাবের সদস্যপদ পেতেও গুনতে হচ্ছে ৩০ লাখ টাকার বেশি। এর মধ্যে কুমিল্লা ক্লাবের সদস্যপদ বিক্রি হচ্ছে ৫০ লাখ টাকায়। দেশের অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরের অভিজাত ক্লাবের সদস্যপদের দামও বাড়ছে তরতর করে। এ অবস্থায় দেশের অভিজাত ক্লাবগুলোর সদস্যপদ কেনার বিষয়টি এখন উচ্চমুনাফার বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে দাম আরো বাড়তে পারে এ আশায় ধনীদের কেউ কেউ নতুন ক্লাবগুলোর পাঁচ-সাতটি করেও সদস্যপদ কিনে রাখছেন। উঠতি ধনীরা পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের পাশাপাশি কর্মচারীদের নামেও ক্লাবের সদস্যপদ নিয়ে রাখছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছে।
নতুন করে সদস্যপদ দেয়া বন্ধ রেখেছে রাজধানীর দুই অভিজাত ক্লাব ‘ঢাকা’ ও ‘গুলশান’ ক্লাব। যদিও ক্লাব দুটির সদস্যপদ দেশের ধনীদের কাছে বহুল আকাঙ্ক্ষিত সম্পদ। বিদ্যমান সদস্যদের কারো মৃত্যু হলে কিংবা স্বেচ্ছায় ক্লাবের সদস্যপদ বিক্রি করতে চাইলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ধনীরা। কোটি টাকাও ছাড়িয়েছে ক্লাব দুটির সদস্যপদের দাম। অনেকে কোটি টাকা দিয়েও পাচ্ছেন না ক্লাব দুটির সদস্যপদ।
অভিজাত ক্লাবগুলোর সদস্যপদ লাভজনক বিনিয়োগ হয়ে ওঠার বড় উদাহরণ ঢাকা বোট ক্লাব ও পূর্বাচল ক্লাবের সদস্যপদের দাম। ঢাকা বোট ক্লাবের অবস্থান সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের তুরাগ নদীর তীরে। ২০১৪ সালে ক্লাবটি গঠনের উদ্যোগ নেন পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত এমএ হাসেমের সন্তান রুবেল আজিজ। রাজধানীর বনানী ক্লাবের সভাপতির দায়িত্বেও রয়েছেন তিনি। শুরুতে ক্লাবটির সদস্য ফি ছিল মাত্র ১ লাখ টাকা। দুই বছরের মধ্যেই বোট ক্লাবের সদস্য ফি ৫ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ টাকায়। বর্তমানে শ্রেণীভেদে ঢাকা বোট ক্লাবের সদস্যপদ বিক্রি হচ্ছে ১৫, ২০ ও ২৫ লাখ টাকায়। তার পরও ক্লাবটির সদস্য সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। সদস্য ফিসহ অন্যান্য খাত থেকে আয়কৃত প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা ক্লাবটির ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে। শহর হিসেবে এখনো গড়ে না উঠলেও পূর্বাচলে জন্ম নিচ্ছে নানা নামের অভিজাত ক্লাব। এর মধ্যে পূর্বাচল ক্লাবের সদস্য ফি উঠে গিয়েছে ৪০ লাখ টাকার ঘরে। যদিও ৭ লাখ টাকায় সদস্য নেয়া শুরু করেছিল ক্লাবটি।
অভিজাত ক্লাবের সদস্যপদ উচ্চমুনাফার বিনিয়োগ হয়ে ওঠার বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বণিক বার্তার কথা হয়। খোঁজখবর নেয়া হয় অভিজাত ক্লাবগুলোর সদস্য সংখ্যা, ফি, অনুদান, তহবিল ব্যয়ের খাতসহ নানা বিষয়ে। এতে সামাজিক ক্লাবগুলো উচ্চমুনাফার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের গল্পই বেশি শোনা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে দেশে অতিধনীর সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। ব্যাংকের অর্থ লোপাট কিংবা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে রাতারাতি ফুলেফেঁপে উঠছে বিশেষ একটি শ্রেণী। নব্য ধনীদের বড় অংশ অভিজাত ক্লাবের সদস্য হয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে চাইছে। ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অভিজাত ক্লাবের সংখ্যা ও সদস্যপদের দাম।
দেশের অন্যতম অভিজাত ক্লাব ‘গুলশান ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালে। ক্লাবটির বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৩০০। অনেক আগে থেকেই নতুন সদস্য নেয়া বন্ধ রেখেছে গুলশান ক্লাব। তবে সদস্যদের কারো মৃত্যু হলে কিংবা সদস্যপদ হস্তান্তর করতে চাইলে নতুন কেউ সেটি নেয়ার সুযোগ আছে। গত বছর গুলশান ক্লাবের একজন সদস্যের মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকারীরা সদস্যপদটি বিক্রি করে দেন। পরিচিতজনের কাছে বিক্রি করা ওই সদস্যপদের দাম ছিল ৮০ লাখ টাকা। এর বাইরে ওই ক্রেতা হস্তান্তর ফি বাবদ গুলশান ক্লাবকে দিয়েছেন ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এখন অনেকে কোটি টাকা নিয়ে সদস্যপদ কিনতে চাইলেও পারছেন না।
গুলশান ক্লাবের সভাপতি রফিকুল আলম হেলাল বলেন, আমরা নতুন করে কোনো সদস্যপদ দিচ্ছি না। ক্লাবের বিদ্যমান সদস্যদের পরিবারের দুজন করে নতুন সদস্য করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর বাইরে অন্য কারো সদস্য হওয়ার সুযোগ নেই। তবে কোনো সদস্য যদি নিজের পদ অন্যের কাছে স্থানান্তর করতে চান, সেটি একান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয়। সে সদস্যপদ বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো লেনদেন হলে সেটিও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। এক্ষেত্রে ক্লাবের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে না।
গুলশান ক্লাবের মতোই চাহিদার তুঙ্গে রয়েছে ঢাকা ক্লাবের সদস্যপদ। তবে বিক্রেতা না থাকায় নব্য ধনীরা ক্লাবটির সদস্য হতে পারছেন না। দেশের অন্যতম প্রাচীন ঢাকা ক্লাব প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বঙ্গভঙ্গের পর ১৯১১ সালে। বর্তমানে ক্লাবটির সদস্য সংখ্যা তিন হাজারের বেশি।
ঢাকা ক্লাবসংশ্লিষ্ট এক সূত্রের বক্তব্য অনুযায়ী, গুলশান, বনানী, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় নতুন নতুন ক্লাব গড়ে ওঠায় ঢাকা ক্লাবের আকর্ষণ এখন কিছুটা কমে গেছে। বর্তমানে ঢাকা ক্লাবে ব্যবসায়ী ও নব্য ধনীদের তুলনায় সরকারি কর্মকর্তারাই বেশি যান। এ কারণে ক্লাবটির সদস্যপদের চাহিদা গুলশান ক্লাবের তুলনায় কম। কোনো সদস্যপদ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ঢাকা ক্লাবকে ৩ লাখ টাকা করে পরিশোধ করতে হয়। নতুন করে ক্লাবটির সদস্যপদ দেয়া হচ্ছে না বলে জানান ঢাকা ক্লাবের সভাপতি খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল। তিনি বলেন, কেউ চাইলে তার সদস্যপদ পরিবার বা তার মনোনীত কোনো ব্যক্তিকে হস্তান্তর করতে পারেন। হস্তান্তরের বিষয়টি ক্লাবকে জানালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে ক্লাবের কোনো সদস্যপদ বিক্রির সুযোগ নেই। ঢাকা ও গুলশান ক্লাবের পরই চাহিদার তুঙ্গে রয়েছে রাজধানীর বনানী ক্লাবের সদস্যপদ। বর্তমানে এ ক্লাবের সদস্য সংখ্যা ৯৬১। বনানী ক্লাবের সদস্য হতে শ্রেণীভেদে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। প্রায় সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে রাজধানীর উত্তরা ক্লাবের সদস্য হতে। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এ ক্লাবের সদস্য সংখ্যা ২ হাজার ৬২১।
রাজধানীর বাইরে অভিজাত ক্লাবের সদস্য হতে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে কুমিল্লায়। ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ক্লাবের নতুন সদস্য দেয়া বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০০। কুমিল্লা ক্লাবের একজন সদস্য বলেন, ২০১৩ সালে ৭ লাখ টাকা ব্যয় করে কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য হয়েছি। এখন সর্বনি¤œ ৫০ লাখ টাকায় এ ক্লাবের সদস্যপদ হস্তান্তর হচ্ছে। চাহিদা যেভাবে বাড়ছে, আগামীতে কুমিল্লা ক্লাবের সদস্যপদ আরো বেশি দামে বিক্রি হবে।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সবচেয়ে অভিজাত ক্লাব চট্টগ্রাম ক্লাব। ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ক্লাব পার করেছে ১৪৪ বছর। গত মাসেই চট্টগ্রাম ক্লাবের একটি সদস্যপদ বিক্রি হয়েছে ৩৫ লাখ টাকায়। অতিরিক্ত ৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে নিবন্ধন ফি হিসেবে। চট্টগ্রাম ক্লাব ছাড়াও বন্দরনগরীতে ‘সিনিয়রস ক্লাব’ ও ‘খুলশী ক্লাব’ নামে দুটি অভিজাত ক্লাব রয়েছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে সমাদৃত নরায়ণগঞ্জ। রাজধানীর নিকটবর্তী এ নগরে অভিজাত ক্লাব হিসেবে স্বীকৃত ১২৯ বছর বয়সী ‘নারায়ণগঞ্জ ক্লাব’। বর্তমানে এ ক্লাবের সদস্য হতে ব্যয় করতে হচ্ছে ৩০ লাখ টাকা।
অভিজাত ক্লাবের সদস্যপদের চাহিদার কারণে এ খাতকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর মধ্যস্থতাকারীও তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যপদ বিক্রি ও হস্তান্তরের বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন এমন একাধিক মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে কথা বলা হয়। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তারা বলেন, দেশের বৃহৎ করপোরেটগুলোর অনেক কর্ণধার কোটি টাকার বিনিময়ে হলেও গুলশান কিংবা ঢাকা ক্লাবের একটি সদস্যপদ কেনার জন্য ঘুরছেন। এ কারণে অন্য অভিজাত ক্লাবগুলোর সদস্যপদের দাম বেড়ে গেছে। ভবিষ্যতে ওই ক্লাবগুলোর সদস্যপদও আরো বেশি মূল্যে বিক্রি হবে, এ বিশ্বাস থেকে অনেকে নতুন ক্লাবগুলোর পাঁচ-সাতটি সদস্যপদও কিনে রাখছেন। কালো টাকা বিনিয়োগের অন্যতম একটি উৎসও হয়ে উঠেছে অভিজাত ক্লাবের সদস্যপদ।-বণিকবার্তা