মহান আল্লাহর অশেষ দয়া যে, তিনি বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনার মধ্যে মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র শাবান মাস দান করেছেন। শাবান মাস হচ্ছে মাহে রমজানের আগমনী বার্তা। হিজরি চন্দ্রবর্ষের অষ্টম মাস হলো ‘শাবান’ মাস। এ মাস বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ। হিজরতের দেড় বছর পর পূর্বতন কিবলা ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা বা ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’-এর পরিবর্তে মক্কা শরিফের মসজিদুল হারাম তথা খানায়ে কাবা তথা কাবা শরিফ কিবলা হিসেবে ঘোষিত ও নির্ধারিত হয় এই শাবান মাসেই। তাই শাবান মাস একদিকে যেমন মুসলিম স্বাতন্ত্র্য ও ইসলামী ঐক্যের মাস, অন্য দিকে তেমনি কাবাকেন্দ্রিক মুসলিম জাতীয়তা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হওয়ার মাস।
আরবি এ মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআজজম’ অর্থ- মহান শাবান মাস। রাসূলুল্লøাহ সা: শাবান মাসে সবচেয়ে বেশি নফল ইবাদত করতেন। ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, রজব আল্লøাহ তায়ালার মাস, শাবান নবীজী সা:-এর মাস, রমজান হলো উম্মতের মাস। রজব মাসে ইবাদতের মাধ্যমে মনের ভূমি কর্ষণ করা, শাবান মাসে আরো বেশি ইবাদতের মাধ্যমে মনের জমিতে বীজ বপন করা, রমজান মাসে সর্বাধিক ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে সফলতার ফসল ঘরে তোলা হয়। মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশনাসংবলিত অসাধারণ আয়াতটি এ মাসেই অবতীর্ণ হয়। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা নবীজী সা:-এর প্রতি পরিপূর্ণ রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতাগণ নবীজী সা:-এর জন্য রহমত কামনা করেন; হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করো এবং যথাযথভাবে সালাম পেশ করো।’ (সূরা আহজাব-৫৬)। রাসূলুল্লøাহ সা: রজব ও শাবান মাসব্যাপী এ দোয়া বেশি বেশি পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিøগ না রমাদান’। অর্থাৎ- ‘হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন; রমজান আমাদের নসিব করুন।’ (মুসনাদে আহমাদ, প্রথম খ–২৫৯, শুআবুল ইমান, বায়হাকি-৩ : ৩৭৫)
শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত ১৫ তারিখের রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। শবেবরাত কথাটি ফারসি। শব মানে রাত, বারাআত মানে মুক্তি; শবেবরাত অর্থ মুক্তির রাত। শবেবরাতের আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’ তথা মুক্তির রজনী। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এটি শবেবরাত নামেই সমধিক পরিচিত। এ রাতে ইবাদত করা ও দিনে রোজা রাখা সুন্নত।
বছরব্যাপী প্রতি সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা সুন্নাত। প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বিদের নফল রোজাও রয়েছে। মাসের ১, ১০, ২০, ২৯ ও ৩০ তারিখে রয়েছে নফল রোজা। এ ছাড়া কোনো সময় ও দিন-তারিখ নির্ধারণ ছাড়া যত বেশি সম্ভব নফল ইবাদত করা যায়, তা করা উচিত। সাথে সাথে এ বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে, যেন কোনো ফরজ ওয়াজিব ছুটে না যায় এবং কোনো হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ সংঘটিত না হয়। নফল ইবাদত করা অপেক্ষা নিষেধ থেকে বেঁচে থাকা অধিক গুরুত্ববহ। রাসূলুল্লøাহ সা: প্রায় সব রজব মাসে ১০টি নফল রোজা রাখতেন এবং শাবান মাসে ২০টি নফল রোজা রাখতেন। রমজানে পূর্ণ মাস ফরজ রোজা। নবীজী সা: রমজান ছাড়া বছরের সবচেয়ে বেশি শাবান মাসেই নফল নামাজ, নফল রোজা ও নফল ইবাদত-বন্দেগি করতেন।
রমজান মাসের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসের তারিখের হিসাব রাখা বিশেষ জরুরি একটি সুন্নাত আমল। হাদিস শরিফে নবীজী সা: বলেন, ‘তোমরা রমজানের জন্য শাবানের চাঁদের হিসাব রাখো।’ (সিলসিলাতুস সহিহাহ, আলবানি, খ–২, পৃষ্ঠা-১০৩) সম্ভব হলে নতুন চাঁদ দেখা সুন্নাত, চাঁদ দেখে নতুন চাঁদের দোয়া পড়াও সুন্নাত; চান্দ্র মাসের তারিখের হিসাব রাখা ফরজে কিফায়া। কারণ, ইসলামী বিধিবিধানগুলো চাঁদের তারিখের সাথে সম্পর্কিত। (আল বাদায়েউস সানায়ে)
শাবান মাসে করণীয় আমল-১. বেশি বেশি রোজা রাখা। হজরত উসামা বিন যায়েদ রা: রাসূল সা:কে জিজ্ঞাসা করলেন, শাবান মাসে আপনাকে যত রোজা রাখতে দেখি, আপনি কেন এ মাসে এত বেশি রোজা রাখেন? রাসূলুল্লøাহ সা: বললেন, ‘এটি এমন একটি মাস যা রজব এবং রমজানের মতো গুরুত্বপূর্ণ দু’টি মাসের মধ্যে পড়ে। আর বেশির ভাগ মানুষ এ মাসটি সম্পর্কে গাফেল থাকে। অর্থাৎ- এ মাসটি সম্পর্কে তারা বেখবর থাকে, উদাসীন থাকে। যার ফলে তারা ভালো আমল করে না। তারা ভাবে যে, রমজান তো আছেই।’ (নাসায়ি)
২. বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবে তাবেয়িন এবং প্রসিদ্ধ ইমামগণ শাবান মাস এলেই বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করতেন।
৩. বেশি বেশি সাদাকাহ (দান-সহযোগিতা) করা। অনুরূপভাবে সালফে সালেহিনগণ এ মাসজুড়ে বেশি বেশি দান-সাদাকাহ করে রমজানের দান-সাদাকার অভ্যাস নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলতেন। যাতে রমজানজুড়ে দান-সাদাকায় অতিবাহিত করা যায়। আবার গরিব অসহায়দের রমজানের কষ্ট দূর করা যায়।
৪. বেশি বেশি ইসতিগফার করা। রমজানে রহমত বরকত মাগফিরাত ও নাজাতের জন্য শাবান মাস থেকেই সালফে সালেহিনগণ বেশি বেশি ইসতিগফার করতেন। যা মানুষকে রমজানজুড়ে আমলে উদ্যোগী করে তোলে। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, শাবান মাসজুড়ে নিজেদের ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত রাখা।