২০১৯ সালে ভুক্তভোগী মেধাবী কলেজছাত্রী যখন স্কুলে পড়ত তখন থেকেই রাস্তায় ইভটিজিং ও ভয়ভীতি দেখিয়ে হয়রানি করতেন অপহরণকারী আবু জার গিফারী ওরফে গাফফার (৩৫)। শুধু ইভটিজিংয়েই থেমে থাকেননি গাফফার। পরে ভুক্তভোগী মেয়ের পরিবারকে বিয়ের জন্য বিভিন্নভাবে চাপ ও হুমকি দিতেন। মেয়ের পরিবার বিয়েতে অস্বীকৃতি জানালে গাফফার অপহরণ করে বিয়ে করার হুমকি দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ মার্চ ঝিনাইদহ আদালত চত্বরে অপহরণের পরিকল্পনা করেন। পরে ৫ মার্চ ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার একটি রাস্তা থেকে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে মাইক্রোবাসে অপহরণ করেন।
র্যাব জানায়, অপহরণের পর মেয়েটিকে ৩০ ঘণ্টা আটকে রেখে চারটি জেলায় ঘুরিয়ে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন অপহরণকারী গাফফার। বিয়েতে অস্বীকৃতি জানালে মেয়েটিকে অ্যাসিড দিয়ে মুখ ঝলসে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। যাতে পরে মেয়েটির বিয়ে না হয়। অপহরণের পর ভুক্তভোগীর বাবা ঝিনাইদহ সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গাফফারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার পর র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-৬ ও র্যাব-৪ এর যৌথ অভিযানে মানিকগঞ্জের সদর থানা এলাকা থেকে অপহরণ চক্রের মূল পরিকল্পনাকারী আবু জার গিফারী ওরফে গাফফারকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় অপহরণ চক্রের সঙ্গে জড়িত গাফফারের দুই সহকারী রাজবাড়ীর সাব্বির হোসেন (২২) ও হাফিজুর রহমানকে (৪৬) গ্রেফতার করে র্যাব। তাদের কাছ থেকে এক কৌটা অ্যাসিডসদৃশ বস্তু, তিনটি দেশীয় ধারালো অস্ত্র ও মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
র্যাব জানায়, গ্রেফতার গাফফার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করার পর আইন পেশায় যুক্ত হন। আইন পেশায় যুক্ত থেকেও তিনি বেআইনি কাজ করেন। গতকাল সোমবার (৭ মার্চ) দুপুরে কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব জানান র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, অপহৃত শিক্ষার্থী অত্যন্ত মেধাবী। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। পরে এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পায়। তিনি যশোর বোর্ডে মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ২০১৯ সাল থেকে গাফফার মেয়েটিকে ইভটিজিং ও ভয়ভীতি দেখিয়ে হয়রানি করতেন। মেয়েটি তার যন্ত্রণায় প্রাইভেট ও স্কুলে যেতে পারত না। একসময় মেয়েটি একা বের হওয়া বন্ধ করে দেয়, সে তার বাবা ও বান্ধবীদের সঙ্গে স্কুল-প্রাইভেটে যেত।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি জানান, গত ৫ মার্চ বিকেলে ভিকটিম ও তার এক সহপাঠী প্রাইভেট শেষে রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় গাফফার শৈলকূপার একটি রাস্তা থেকে ওই শিক্ষার্থীকে মাইক্রোবাসে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভিকটিমের বাবা বাদী হয়ে ঝিনাইদহ সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এ ঘটনায় দেশব্যাপী জনরোষের তৈরি হয়। মেধাবী ছাত্রীর পাশে দাঁড়ায় তার সহপাঠীরা। রোববার ঝিনাইদহ শহরব্যাপী সারাদিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করে। ঘটনায় তার সহপাঠীদের আহাজারি ও বাবার আর্তনাদ দেশবাসীকে আবেগাপ্লুত করে। গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে মর্মান্তিক এ ঘটনা প্রচার ও প্রকাশিত হয়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাবার আর্তনাদ শিরোনামে ঘটনাটি একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ফলে র্যাব এ ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে ও জড়িতদের গ্রেফতারের ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় আজ সোমবার (৭ মার্চ) ভোরে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-৪ ও র্যাব-৬ এর যৌথ অভিযানে মানিকগঞ্জ সদর এলাকা থেকে অপহরণ মামলার প্রধান আসামি ও মূল পরিকল্পনাকারী আবু জার গিফারী গাফফারসহ তার দুজন সহকারীকে গ্রেফতার করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার গাফফার অপহরণ সম্পর্কে জানায়, ভিকটিম একজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। সম্প্রতি এসএসসিতে খুব ভালো ফলাফল করায় গ্রেফতার গাফফার ধারণা করে যে ভিকটিম তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মূলত এ কারণেই সে ভিকটিমকে অপহরণের পরিকল্পনা করে। ঘটনার দুদিন আগে ঝিনাইদহ কোর্ট সংলগ্ন এলাকায় সমমনাদের নিয়ে অপহরণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে গাফফার। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভিকটিমকে প্রাইভেট পড়ে বাসায় যাওয়ার পথে রাস্তা থেকে অপহরণ করে। এরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য সে ভিকটিমকে প্রথমে রাজবাড়ীতে তার এক নিকটাত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে তার দুই সহযোগীকে পরিবর্তন করে নতুন দুই সহযোগীসহ ভিকটিমকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ঢাকায় আশ্রয় না পেয়ে মাইক্রোবাসে ভিকটিমকে সিলেটে নিয়ে যায়। সিলেটে মেয়েটির অবস্থান পরিবার জেনে যাওয়ায় সেখান থেকে পুনরায় তাকে নিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এর মধ্যে গাফফার ভিকটিমকে অ্যাসিড ও দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে ভয়ভীতি দেখায়; যাতে সে কোনো প্রকার চিৎকার বা আওয়াজ না করে। এরপর মানিকগঞ্জ থেকে ভিকটিমকে উদ্ধার ও আসামিদের গ্রেফতার করা হয়। গাফফারের বিরুদ্ধে ঝিনাইদহের বিভিন্ন থানায় বিভিন্ন অপরাধে একাধিক মামলা আছে। মেয়েটিকে অপহরণ করে চারটি জেলায় ৩০ ঘণ্টা ঘোরানোর পরও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কেন তাদের ধরতে পারলো না? এমন প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মঈন জানান, অপহরণের পর মামলা কিংবা কোনো অভিযোগ না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। পরে মামলার পর র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে অভিযান চালিয়ে অপহৃত মেয়েটিকে উদ্ধার ও অপহরণ চক্রের মূলহোতাসহ তিনজনকে গ্রেফতারে সক্ষম হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রেফতার গাফফার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি আইন পেশায় যুক্ত হন। আইন পেশায় যুক্ত থেকেও বেআইনি কাজ করেছেন। মেয়েটিকে জোর করে গাড়িতে তোলার সময় স্থানীয় ৮-১০ জন অহপরণের ঘটনাটি দেখলেও তারা সেখানে কোনো বাধা প্রদান করেনি। এ ঘটনায় র্যাবের এই কর্মকর্তা ধিক্কার জানিয়ে বলেন, স্থানীয়দের উচিত ছিল সেখানে তাদের বাধা দেওয়া। এতে মেয়েটিকে অপহরণের সুযোগ পেত না গাফফার। অভিযুক্ত গাফফার ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক বলে জানা গেছে।