দেশে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কলেজ বলতে মূলত ব্রিটিশ আমলে স্থাপন করা কলেজগুলোকেই বোঝায়। একসময় এসব কলেজ গোটা পূর্ববঙ্গের শিক্ষা, গবেষণা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা আন্দোলনে। কলেজগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছেন বরেণ্য অনেক ব্যক্তিত্ব। কালের পরিক্রমায় এসব কলেজের সে জৌলুস আর নেই। লেখাপড়ার মান কমেছে। শিক্ষকের সংকট প্রকট। সুযোগ নেই গবেষণার। অপর্যাপ্ত অবকাঠামোয় শিক্ষার মৌলিক সুবিধাগুলোও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
মোটা দাগে ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা কলেজগুলোর প্রায় সবক’টিতেই এখন কমবেশি এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। আবার পুরনো কলেজগুলোর এ জৌলুসহীনতার কালে নতুনগুলোও সে শূন্যস্থান পূরণ করতে পারছে না। এর পেছনেও সেই শিক্ষক ও অবকাঠামোর সংকটের মতো বিষয়গুলোকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের প্রাচীনতম কলেজগুলোর অধিকাংশই উনিশ শতকে প্রতিষ্ঠিত। ১৮৪১ সালে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে ঢাকা কলেজ। এরপর দেশের অন্যান্য স্থানে গড়ে তোলা কলেজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলো কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ, বরিশালের ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, সিলেটের মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজ, খুলনার ব্রজলাল (বিএল) কলেজ, রাজশাহী সরকারি কলেজ, রংপুরের কারমাইকেল কলেজ, পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ও নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ। এসব কলেজ একসময় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দিয়েছে। হয়ে উঠেছিল স্থানীয় ঐতিহ্যের অংশ। প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশও ছিল সময়ের বিচারে মানসম্মত। যদিও সময়ের পরিক্রমায় কলেজগুলোর বর্ণিল অতীত এখন অনেকটাই বিবর্ণ।
বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও অবকাঠামোর মতো শিক্ষার মৌলিক সুবিধাগুলোও খুবই অপ্রতুল। সরকারি হিসাবেই পুরনো এসব কলেজে শতাধিক শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন একজন করে। কোনো কোনোটিতে একেকজন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী সংখ্যা দেড় শতাধিক। নতুন করে গড়ে ওঠা কলেজগুলোয় এ ধরনের সংকট আরো বেশি।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, অপরিকল্পনা ও অবহেলায় একদিকে যেমন পুরনো কলেজগুলো তাদের মান হারিয়েছে, অন্যদিকে একই কারণে নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোও গড়ে উঠেছে দুর্বল ব্যবস্থাপনায়। পর্যাপ্ত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষ নেতৃত্ব ও জনবলের অভাব গোটা কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থাকেই মানহীন করে তুলছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, সুনাম ধরে রাখার কথা বলতে গেলে শুধু কলেজ নয়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছে না। এর মানে এই নয় যে কোনো গুণগত কাজই হচ্ছে না। আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু অর্জন থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা ও গবেষণায় অর্জন অনেক কম। একসময় কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কিংবা বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের মতো পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোর যে জৌলুস ছিল, সেটি যে এখন নেই তা স্পষ্ট। আসলে নতুন-পুরনো সব প্রতিষ্ঠানেই সংকট রয়েছে। এর অনেক কারণ রয়েছে। আমার মতে, অন্যতম কারণ হলো শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা। আমাদের দেশে কলেজ শিক্ষার সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক যোগ করে রাখা হয়েছে। যদিও সেটি স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের দিকে তাকালে দুরবস্থার চিত্র উঠে আসবে।
তিনি আরো বলেন, অনেকেই জাতীয়করণের দাবি জানাচ্ছেন। আমরাও চাই, জাতীয়করণ হোক। কিন্তু জাতীয়করণ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে তা নয়। সরকারি কলেজগুলোয়ও শিক্ষক ও অবকাঠামো সংকট কম নয়। আমার মতে, আমাদের কলেজ শিক্ষার মানোন্নয়ন বিষয়ে লক্ষ্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সেটি অর্জনে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রকাশিত শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে কলেজ রয়েছে চার হাজার ৬৯৯টি। এর মধ্যে সরকারি কলেজের সংখ্যা মাত্র ৬৭১। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কলেজ রয়েছে ৩ হাজার ৯৪৫টি। এছাড়া অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত রয়েছে আরো ৮৩টি কলেজ। দেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকারী এসব কলেজের অধিকাংশই ১৯৭১ সালের পর অর্থাৎ বাংলাদেশ অধ্যায়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ব্যানবেইসের হিসাবে, ৩ হাজার ৬২৮টি কলেজই গড়ে উঠেছে গত পাঁচ দশকে। এর আগে ১৯৪৭-৭১ সময়কালে গড়ে উঠেছিল ৮৩১টি। আর ব্রিটিশ ১৯৪৭-এর আগে দেশে কলেজ ছিল ২৪০টি।
প্রাচীন কলেজগুলোর অন্যতম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ যাত্রা করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ১৮৯৯ সালে। শুরু থেকেই দেশের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে কলেজটি। প্রথিতযশা লেখক, গবেষক, রাজনীতিকসহ বহু গুণীজনের জন্ম দেয়া এ বিদ্যাপীঠের অতীত ঐতিহ্য এখন অনেকটাই ম্লান। নানা সংকটে ব্যাহত হয়েছে কলেজটির মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম। একই কথা প্রযোজ্য ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলেট এমসি কলেজ, ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বরিশাল বিএম কলেজ, ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, ১৯০২ সালে গড়ে তোলা খুলনার সরকারি বিএল কলেজের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও। ঐতিহ্যবাহী এসব কলেজ সরকারীকরণ করা হলেও এগুলোর পুরনো জৌলুস আর ফিরিয়ে আনা যায়নি। একসময় দেশে ভালো কলেজ বলতে ঐতিহ্যবাহী এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই বোঝাত।
ব্যানবেইসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্বাধীনতার আগে দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কলেজই সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হতো। যদিও বাংলাদেশ অধ্যায়ে এসে কলেজ ব্যবস্থাপনায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্রমান্বয়ে কমেছে। ১৯৭১ সালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কলেজের সংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশের বেশি, যা বর্তমানে এসে ১০ শতাংশে ঠেকেছে।
মানসম্মত শিক্ষার অভাবে কলেজ গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতার বিষয়টিও এখন বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। গত বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ গ্র্যাজুয়েটদের ওপর একটি জরিপ চালায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা শ্রমশক্তিতে কতটুকু অবদান রাখছেন, তা জানতে দৈবচয়নের ভিত্তিতে দেশের ৫৪টি সরকারি ও বেসরকারি কলেজের ২০১৭ সালে অনার্স (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষ হওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর সেলফোনে জরিপটি করা হয়েছিল।
জরিপের ফলে দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ বেকার থাকছেন। জরিপে ১ হাজার ৬৩৯ জন শিক্ষার্থী, ২০২ জন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ২৩৩ জন চাকরিজীবীর মতামত নেয়া হয়। এতে দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশই (৬৬ শতাংশ) বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এছাড়া ৩ শতাংশ নিজ উদ্যোগে কিছু করছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর অভিযোগ, স্নাতক শেষ করে চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে তারা শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পান না। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি খোঁজার সুবিধা রয়েছে বলে জানিয়েছেন মাত্র ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, পুরনো কলেজগুলোর মানোন্নয়নে সরকার শতবর্ষী ১৬টি কলেজ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এছাড়া অন্য কলেজগুলোয়ও বিভিন্ন উন্নয়নকাজ চলমান রয়েছে। শিক্ষক সংকটের বিষয়টি একদিনে সমাধান করার বিষয় নয়। পদ সৃষ্টি থেকে শুরু করে অনেকগুলো প্রক্রিয়া রয়েছে। তবে ক্রমান্বয়ে কলেজ শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।-বণিকবার্তা