শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৪ অপরাহ্ন

বাংলাদেশ: নৈতিকভাবে বিকশিত, সুশিক্ষিত ও উদ্যমী প্রজন্মের সন্ধানে

ড: মুহাম্মদ আব্দুল বারী
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৫ জুন, ২০২২
ড: মুহাম্মদ আব্দুল বারী

বাংলাদেশীরা, নির্দিষ্ট করে বললে বাঙ্গালী মুসলিমরা একটা জাতি হিসেবে ঐতিহ্যগতভাবে যোদ্ধা (তুর্কীদের মত) কিংবা বুদ্ধিজীবী (পারস্যবাসীদের মত) কিংবা ব্যবসায়ী (প্রাচীন আরবদের মত) হিসেবে পরিচিত নয়। তাদের পেশা মূলত কৃষি ও পশুপালন যেটি বৃটিশ কলোনীর পূর্বে তুলনামুলক সৎ ও দক্ষ শাসকদের আমলে প্রমানিত হয়েছে।

একজন বাংলাদেশী সে সেক্যুলার কিংবা ইসলামিক অথবা বামপন্থী যাই হোক না কেন, বংশ পরম্পরায় সে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে বেশ কিছু গুনের অধিকারী, যেমন পারিবারিক মূল্যবোধ, আতিথেয়তা, সরলতা ইত্যাদি। তবে তাদের মধ্যে কিছু ক্ষতিকর ব্যক্তিগত ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেমন – গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেও অনেক সময় হালকাভাবে (casually) নেওয়া, শৃঙ্খলাবদ্ধ (disciplined) না হওয়া, অনেক ক্ষেত্রে দৃঢ় সংকল্পশীল না হওয়া, অন্তর্মুখী (introvert) হওয়া, অপরের সফলতায় ঈর্ষা পোষন করা। ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা, জবাবদিহিতাহীন রাজনৈতিক পরিবেশ এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারনে সা¤প্রতিক বছরগুলোতে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে।
ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলাদেশীরা ধর্মীয় ক্ষেত্রে মনোযোগী হিসেবে পরিচিত হলেও তাদের ইসলামী জ্ঞানের তুলনামূলক অভাব এবং দ্বীন চর্চার ক্ষেত্রে কোনটিকে বেশী গুরুত্ব (priority) দিতে হবে (যেমন ফরজ, সুন্নাহ, হালাল, হারাম) তা বুঝার ক্ষেত্রে ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়।তাদের মাঝে কিছু লোক উদ্দেশ্যহীনভাবে রাজনৈতিক আলোচনা কিংবা নিরর্থক আড্ডায় ব্যস্ত থাকা পছন্দ করে। একই জাতিগোষ্ঠী ও একই ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও তারা ধর্মীয় বিশ্বাস ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে অতিরিক্ত বিভক্তির শিকার। এ জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জ্ঞান-নির্ভর ইসলামিক মূল্যবোধ, মজবুত চরিত্র এবং নৈতিকতা ভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার কার্যকর প্রচেষ্টার।
বাংলাদেশের জনগণ ও প্রবাসীদের অনেক স্বল্প ও মধ্য মেয়াদী ভালো কাজের নজির রয়েছে। এই প্রবন্ধে জাতি গঠনের জন্য কিছু সুচিন্তিত ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে দেশপ্রেমের শপথ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশীদের প্রয়োজন তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি, অর্থপূর্ণ আলাপচারিতা, ব্যাপক গবেষণা ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে বলিষ্ঠ ভাবে এগিয়ে যাওয়া।
যথার্থ পদক্ষেপের জন্য কিছু প্রস্তাব:সা¤প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বেশ দৃশ্যমান অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু যদি জনগণের মাঝে উত্তম ব্যক্তিগত ও জাতীয় গুণাবলী গড়ে না ওঠে এবং তাদের অভ্যাসগুলো শক্তিতে পরিবর্তিত না হয়, তবে দীর্ঘমেয়াদে এই অগ্রগতি বজায় রাখা সম্ভব হবে না। প্রত্যেক বিবেকবান ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজকে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের মাঝে চারিত্রিক মজবুতি গঠনের জন্য বাস্তব পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। এই কাজের কোন শর্টকাট রাস্তা নেই। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের পেছনে কাজ করা সবচেয়ে জরুরী, যাতে দীর্ঘ দিনের গড়ে ওঠা বুদ্ধিভিত্তিক স্থবিরতা ও সামাজিক হতাশা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি। জাতির স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের পরিকল্পনার জন্য SWOT বিশ্লেষণ [Strength (শক্তি), Weakness (দুর্বলতা), Opportunity (সম্ভাবনা),Threat (আশঙ্কা)] করে নিচের বিষয়গুলোতে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে:
১। ব্যক্তিগত শৃঙ্খলাবোধ ও স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল গ্রহণ করা:অনেক বাংলাদেশী তাদের দৈনন্দিন জীবনে সঠিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে সচেতন না। যার ফলে সময়োপযোগী ও সঠিক পরিকল্পনার অভাব জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাদের কর্মক্ষমতার উপর মন্দ প্রভাব আনয়ন করে। একইসাথে অন্যান্য জাতির তুলনায় ডায়াবেটিস ও হার্টের সমস্যা এখন জাতিগতভাবে উদ্বেগের বিষয়। এজন্য পরিবর্তনের শুরু করতে হবে একদম গোড়া থেকেঃ স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, খাদ্যাভ্যাস ও লাইফস্টাইলের উন্নয়ন। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন, নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল সকলের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশজুড়ে নারী ও পুরুষ সবার জন্যই স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী। ব্যায়াম ও খেলাধুলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, শুধু সুস্বাস্থ্যের জন্যই নয়, বরং আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মবিশ্বাস অর্জনের জন্যও। বাসায় মা-বাবা, স্কুলে শিক্ষকমন্ডলী ও মসজিদে ইমাম – সকলেরই এই বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
২। ‘দ্রুত ফলাফল’ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা:বাংলাদেশীদেরকে অনেকেই অভিহিত করে ক্ষণস্থায়ী স্মৃতির অধিকারী হিসেবে, যারা সবকিছুতে দ্রুত ফলাফল পেতে চায়। বিজ্ঞজনেরা বলেন যে বাংলাদেশীরা পরবর্তী মাসের জন্য পরিকল্পনা করতে পারে না এবং তাদের উঁচু পর্যায়ের নেতারাও বর্তমান বছরের বাইরে চিন্তা করতে পারে না। স্বল্পমেয়াদী চিন্তাভাবনা, ধৈর্যের ঘাটতি ও শর্টকাটে কাজ করে ফেলার অভ্যাস লোকদেরকে অবাস্তব রকমের দ্রুত ও সহজ ফলাফল কামনা করতে শেখায়। ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেকেই জানে যে দুঃখজনকভাবে কিছু লোকের জন্য প্রতারণা একটি অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি জাতি কিভাবে দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে এসে সততার সাথে সাফল্য লাভ করতে পারে সে বিষয়ে জ্ঞানের প্রয়োজন। নৈতিক শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের জন্য কার্যকরী প্রশিক্ষণ বাসা, স্কুল ও সকল প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করা দরকার।কোনটিকে বেশী প্রাধাণ্য দিতে হবে তা বোঝার এবং বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
৩। ত্বরিত আবেগ ও রাগ:লোকদের মধ্যে আবেগ থাকাটা স্বাভাবিক, কিন্তু অনেক বাংলাদেশীর মাঝে রয়েছে আবেগ ও রাগ এর ক্ষতিকর মিশ্রণ যা একজনের পরিবারে, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে এবং সামাজিক সম্পর্কে ক্ষতি আনতে পারে। রাগ এমন একটি আবেগ, যা সঠিকভাবে পরিচালিত হলে কোন ব্যক্তিকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সহায়তা করবে, কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত রাগ খুবই ভয়ংকর।দুনিয়া সম্পর্কে জ্ঞান, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, জ্ঞান চর্চা, নীরবে ধ্যান ও নামাজ একজন ব্যক্তিকে স্থির করতে পারে এবং নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। রাগ নিয়ন্ত্রণ ও চিন্তার অনুশীলন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হওয়া উচিত যাতে মানুষ হাত ব্যবহারের আগে মস্তিস্ক ব্যবহার করতে শিখে।
৪। গুজব ছড়ানোর অভ্যাস ত্যাগ করা:অনর্থক পরচর্চা ও সত্যতা না জেনে গুজব ছড়ানো অনেকের জন্য বিনোদনের বস্তু। সত্যতা যাচাই না করে গুজব বিশ্বাস করা পরিবার ও সমাজে অনেক সমস্যা তৈরী করে। আল্লাহ তাআলা মু’মিনদের আদেশ করেছেন অনির্ভরযোগ্য উৎস থেকে কোন সংবাদ আসলে আগে তা যাচাই করে দেখতে (আল কুরআনঃ ৪৯:৬)। যারা সহজেই গুজব বিশ্বাস করে ও প্রচার করে বেড়ায়, তারা দুর্বল বিচার-বিবেচনার অধিকারী হয় এবং তাদের পক্ষে জীবনে মারাত্মক ভুল করার সম্ভাবনা থাকে। মিথ্যা সংবাদের এই যুগে, যেকোন তথ্য বারবার যাচাই করে নেওয়া উচিত। বিচক্ষণতা ও সাধারণ বুদ্ধি থাকা জরুরী, বিশেষ করে যদি কোন সংবাদের মাঝে ভীতি অথবা শত্রুতা ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। মা বাবার উচিত তাদের সন্তানকে শিক্ষা প্রদান করা যাতে তারা বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা ও ধৈর্যের মাধ্যমে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে শিখে।
৫। হিংসাকে সফল প্রতিযোগিতায় রূপান্তরিত করা:অপরের পার্থিব সাফল্যে হিংসা করা একটি ধ্বংসাত্মক অভ্যাস যেটি অজ্ঞতা ও জীবন সম্পর্কে সংকীর্ন বোধের জন্য তৈরী হয়। এটি অন্তরের প্রশান্তি ধ্বংস করে এবং লোকদের মাঝে শত্রুতা তৈরী করে। অন্তরের হিংসাকে গঠনমূলক প্রতিযোগিতায় রূপান্তর করে সমাজে মঙ্গল আনয়ন করা কাম্য। শিশুদেরকে ছোটবেলা থেকে ভাগ্যের উপর বিশ্বাস (ক্বদর) এবং আল্লাহর উপর আস্থা (তাওয়াক্কুল) শেখাতে হবে, একইসাথে এগুলোকে বাস্তব জীবনে ব্যবহার করতে উৎসাহিত করতে হবে যাতে জীবনে সফলতা অর্জন করা যায়।
৬। অন্তর্মুখী স্বভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে: চারিত্রিকভাবে দুর্বল লোকেরা তাদের হীনমন্যতা ও মুর্খতা অহংকার দিয়ে ঢাকতে চায়। বাংলাদেশীরা সাধারণত ভালো নেতৃত্বের অধীনে সুশৃঙ্খল ও কাঠামোবদ্ধ পরিবেশ পেলে কাজে উন্নতি করতে পারে। এর থেকে বোঝা যায় যে মা-বাবা ও শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্ব হলো শিশুকে সামাজিক ও জীবনধর্মী দক্ষতা অর্জন করতে শেখানো, শুধুমাত্র উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন নয়। ঔপনিবেশিক আমলের বৃটিশ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আনন্দের বিষয় হলো সা¤প্রতিক সময়ে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। বৃহৎ পরিসরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করার সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আরো অভিজ্ঞতা প্রয়োজন যাতে তারা আরো উন্নতি লাভ করতে পারে।
মানুষকে এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যে নিজের বেঁচে থাকার তাগিদে সে প্রবৃত্তিগতভাবে নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। কিন্তু আধুনিক আত্মকেন্দ্রিক সমাজে ‘আমি সবার আগে’ মনোভাব একটি ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে মানুষকে পরিবার, কর্মক্ষেত্র ও সামাজিক মেলামেশায় নানা ধরণের আপস-রফা করতে হয়। এই পৃথিবীতে অন্যের উপর নির্ভরশীলতা একটি প্রয়োজনীয়তা, অলস ইচ্ছা নয়। মানুষের সফলতা নির্ভর করে ব্যক্তিগত গুণাবলীকে কাজে লাগানো এবং অপরের সাথে সেতুবন্ধনের মাধ্যমে সম্মিলিত লক্ষ্য অর্জনের উপর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় দলগত খেলার কথা যেখানে সফলতা কেবল একজন খেলোয়াড়ের দক্ষতার উপর নয়, বরং সকলের সমন্বয় ও সহায়তার উপর নির্ভর করে। সফল দেশসমূহে আমরা দেখি ব্যক্তি স্বার্থের উপর দলের স্বার্থ, আর তার উপরে জাতীয় স্বার্থ।
জনগণের চরিত্র গঠন হলো প্রধাণ কাজ:সফলতা অর্জনের জন্য একটি দেশের ও জাতির প্রয়োজন কার্যকর সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব। সাফল্য অর্জন ও অব্যাহত রাখার জন্য জনগণের মাঝে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ নৈতিক চরিত্রের (আখলাক) বিকাশ ঘটানো দরকার। একটি দেশের নেতৃত্বের মাঝে তাদের জনগণের অবস্থা প্রতিফলিত হয়, এবং এর উল্টোটাও সত্য। জনগণ তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগ সমাজকে তখনই দেয় যখন সমাজ একজন ব্যক্তির প্রতিভার মূল্যায়ন করে।
অলস অঙ্গুলি দেখিয়ে সমাজের উন্নতি করা যাবে না। আজ কিছু উদ্যমী লোক দরকার যারা সক্রিয়ভাবে সমাজে ভালো পরিবর্তনের বীজ বপন করবে এবং অপরকেও উৎসাহিত করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ইতিহাসের অন্যান্য সফল সংস্কারকরা জনগণের সেবকের দৃষ্টান্ত। তাদের অনেকেই বহু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কিন্তু এরপরেও নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি, অদম্য সাহস ও বাস্তবধর্মী স্বপ্ন নিয়ে অটল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সমাজে সংস্কারমূলক পরিবর্তন কেবল আশাবাদী কল্পনা ও চিন্তা দিয়ে আসে না, বরং এর জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, আত্মত্যাগ, অধ্যাবসায় এবং সর্বোপরি কর্মদক্ষতা। “আল্লাহ তোমাদের উপর আদেশ করেছেন যাতে তোমরা সব কাজ চমৎকার ও যথাযথভাবে করো।” (সহীহ মুসলিম)
যদিও বাংলাদেশ একই জাতিগোষ্ঠী ও ভাষাভাষীর দেশ, কিন্তু এখন এটি অনেক ভাগে বিভক্ত। বিভাজন ও দলাদলি দেশকে দুর্বল করে ফেলেছে। না বুঝে ধর্ম পালনের কারনে অনেক লোক ধর্মের সত্যিকার শিক্ষা সম্পর্কেও অজ্ঞ। যার ফলে ধর্মীয় শিক্ষা যেমন আদব, আখলাক, নম্রতা, অন্যের প্রতি সম্মান প্রদান ইত্যাদি অনেক কমে গিয়েছে। মানুষের মাঝে বৈচিত্রতা ও বিভিন্নতা একটি সহজাত বিষয়, কিন্তু বিদ্বেষপূর্ণ দলাদলি মানব-সৃষ্ট। উন্নত ও সভ্য মানুষেরা জানে কিভাবে জাতীয় স্বার্থের খাতিরে তাদের বিভিন্নতাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলতে হয়।
বাংলাদেশের এখন দরকার হতাশা দূর করে নিজেদের মাঝে জ্ঞানচর্চা, চরিত্র গঠন ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করা যাতে দেশপ্রেমের উদ্যম নিয়ে জাতিগঠন সহজ হয়। এই উর্বর ভূমির এখন প্রয়োজন এমন এক প্রজন্ম যারা হবে অত্যন্ত নিবেদিত, উচ্চাভিলাষী ও নৈতিকভাবে মজবুত, পরিবর্তন আনয়নকারী, যাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা আছে মানুষের জীবনের পরিবর্তন ঘটানোর এবং আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি করার।
নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে আরবরা স্বল্প সময়ের মাঝে গহীন বর্বরতার মাঝ থেকে বেরিয়ে এসে জ্ঞান, উত্তম চরিত্র ও সাহসিকতার দ্বারা নিজেদেরকে মানবতার শিক্ষক হিসেবে রূপান্তরিত করেছিল। আধুনিক সময়েও কতিপয় জাতি কেবল এক প্রজন্মের মাঝেই নিজেদের অবস্থার উন্নতি করেছে। জাপান উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মেইজী সংস্কারের মাধ্যমে শুধুমাত্র নতুন প্রজন্মের শিক্ষার উপর জোড় দিয়ে অনেক বিশাল উন্নতি করেছিল। আর চীন নিজের জনগণের কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ দিয়ে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার দ্বারা আমাদের চোখের সামনেই পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
পূর্বের সমাজ নির্মাণকারীদের মত, তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী এবং অন্যান্য নেতৃস্থানীয়দের বাংলাদেশী জনগণের মাঝে নি¤œ থেকে শুরু করে উর্ধ্বমুখী জাতিগঠনের কার্যক্রম শুরু করতে হবে চারটি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে – মানসম্মত শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি, উদ্যোগ গ্রহণ ও চরিত্র গঠন। এখন থেকে আমাদের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত শিক্ষা ও চরিত্র গঠন – পরিবার ও সমাজের মাঝে, মফস্বল ও শহরে। মা-বাবা ও শিক্ষকদের পক্ষ থেকে নৈতিকতা ভিত্তিক শিক্ষা অবশ্যই নতুন প্রজন্মের নৈতিক চরিত্রকে উন্নত করবে যার ফলশ্রুতিতে শৈশবকাল থেকেই তাদের মাঝে সামাজিক ও জীবনমুখী দক্ষতার বিকাশ ঘটবে। আত্মবিশ্বাস, উদ্যোক্তাসুলভ মানসিকতা এবং বিস্তৃত চিন্তাচেতনার অধিকারী হওয়া এর স্বাভাবিক ফলাফল।
যখন সচেতন সমাজসেবকরা ভালো উদ্যোগের সূচনা করে, কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়া, তখন অন্যান্য নীতিবান ব্যক্তিরা অনুপ্রাণিত হয় এবং তাদের সাথে অংশ নিতে উৎসাহিত হয় অথবা নিজেরাই উপযোগী উদ্যোগ শুরু করে। ছোট ছোট সাফল্য থেকে এভাবে বড় সাফল্য অর্জিত হয় এবং সমাজে এক গতির সঞ্চার হয়। এভাবে অনেকগুলো বিন্দু একত্রে মিলিত হয়ে উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবর্তনের বীজ রোপিত হবে।
উপসংহার: এখনই সময় যাতে যখন আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি আমাদের জাতিগত পরিচয় (বাংলাদেশী), ভাষাগত পরিচয় (বাঙ্গালী) এবং ধর্মীয় পরিচয় (মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান)। এখনই সময় কঠোর পরিশ্রম করার যখন আমরা এই দেশকে সম্ভাবনাময় ও সমৃদ্ধশীল হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। এখনই সময় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাজ করার যাতে তারা গড়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী, চরিত্রবান ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে। এখনই সময় যাতে স্কুল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময় ব্যয় করে টিচিং স্কিল ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য যাতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম সমাজের জন্য বোঝা না হয়ে জাতি গঠনের সৈনিক হতে পারে। এটা কারও কাছে কল্পনাধর্মী মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবেই ঘর, স্কুল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে সমাজের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে এটা খুবই সম্ভব। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত যাতে আমরা এ ভালো কাজের স্রোতের সাথে অংশ নিতে পারি এবং এমন ফলাফল অর্জন করতে পারি যা হবে সকল অংশের সম্মিলিত সমষ্টির থেকেও বেশী।
এখনই সময় বাংলাদেশীদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার যাতে অতীত ও বর্তমান থেকে শিক্ষা নিয়ে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় যা লাগবে তা অর্জন করতে পারি। বিবেকবান ও সক্রিয় বাংলাদেশীদের তাই কিছু দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করা উচিতঃ
১। প্রত্যেক বাংলাদেশীকে শুধু অক্ষরজ্ঞানসম্পন্নই নয়, বরং শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের সমসাময়িক জ্ঞান ও পুরো বিশ্ব সম্পর্কে সম্যক ধারনা দিতে হবে।
২। শিশুদের চরিত্র গঠনের জন্য ধর্মীয় মূল্যবোধ ও প্রচলিত নৈতিক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নিতে হবে।
৩। সকলের মাঝে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে; শিক্ষিত নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক কর্মীদের একত্রে ইতিবাচক কাজ করতে হবে – নাগরিক হিসেবে, রাজনৈতিক শত্রু হিসেবে নয় – যাতে সকলের জন্য এই বাসভূমিকে আরো উচ্চ সারিতে উন্নীত করা যায়। লেখক: ড: মুহাম্মদ আব্দুল বারী, শিক্ষাবিদ। অনুবাদ: মীর মুহাম্মাদ আমিনুজ্জামান




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com