শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৬ অপরাহ্ন

বাউরির দোকানে একদিন

সুস্মিতা নাথ
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন, ২০২২

অতি সাধারণ এক চায়ের দোকান। নাম, ‘বাউরির টি-শপ’। জং-ধরা টিনের সাইনবোর্ডে নামটা মুছে গেলেও লোকের মুখে মুখে সেটা থেকে গেছে। শুধু তাই নয়, নামের উপরে অনেক উপনামও জুটেছে এর। কেউ কেউ একে বলে, ‘বাউরির টি-স্টপ’। বাসস্টপের ধারেই এর অবস্থান বলে এমন নামকরণ। অনেকে আবার নাম দিয়েছে ‘বাউরির টি-চপ’। চায়ের সঙ্গে চপও পাওয়া যায় বলে। মজা করে অনেকে ‘বাউরির টি-শব’ও বলে। রাস্তার পাশের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং ততটাই অপরিচ্ছন্নভাবে তৈরি হয় চা এবং দোকানের সৃষ্টিলগ্ন থেকে ব্যবহৃত কড়াইভর্তি তেলে ভাজা হয় চপ। পাচনতন্ত্রের পচনকে ত্বরান্বিত করা সে খাদ্যদ্রব্য খুব সহজেই কাউকে ডেডবডি বা ‘শব’-এ পরিণত করতে পারে, এমন সুদূরপ্রসারী কল্পনা থেকেই এহেন উপনাম। যদিও পলাশপুরের মানুষের কাছে বাউরির দোকানের আকর্ষণ অন্যত্র। এর গা-ঘেঁষে যে-বুড়ো পিপুল গাছটা আছে, যেটার অনন্ত ছায়ায় কাঠের দুটো বেঞ্চ পেতে রেখেছে বাউরি এবং যেগুলোতে বসলেই নির্ভেজাল আড্ডার নেশা চেপে যায়, সেখানেই রয়েছে সেই দুর্বার আকর্ষণ। সকাল-সন্ধে এখানে জমিয়ে আড্ডা বসে। আর বিশ্বস্ত সেবায়েতের মতো সবাইকে চা জুগিয়ে চলে বাউরি। সঙ্গে কখনও লেড়ো বিস্কুট, চপ, এটা-সেটা।
সকালবেলা ওর দোকানে ভিড় জমান এলাকার বয়োবৃদ্ধরা। বৃদ্ধদের সমস্যাজর্জরিত জীবন। তাঁদের আড্ডার ধরনও আলাদা। অম্বল, বাত, শর্করাবৃদ্ধি, রক্তচাপ ইত্যাদি ছাড়াও আছে হরেক সাংসারিক টানাপোড়েন। কাজের মাসি ছুটি নিয়েছে, বিবাহযোগ্যা কন্যার জন্যে পাত্র পাওয়া যাচ্ছে না, ভাড়াটে ভাল নয়, ছেলে বখে যাচ্ছে ইত্যাদি সমস্যার শেষ নেই। ব্যবসা সামলাতে সামলাতেই বাউরি এঁদের গল্প শোনে।
চালু দোকান বাউরির। স্থানীয়রা ছাড়া পরিযায়ী খরিদ্দারও অনেক। দিনে দুটো দূরগামী বাস ওর দোকানের সামনে থামে।
সেদিন দুপুরে বাস থেকে নামল ঝকঝকে এক যুবক। বয়স বড়জোর আঠাশ-ত্রিশ। হাতে একটা ট্রলি, পিঠে ল্যাপটপের ব্যাগ। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, এ অঞ্চলে সে নতুন। চারদিকে তাকাতে তাকাতে দোকানের দিকে এগিয়ে এল সে। তারপর বাউরিকে একটা চায়ের ফরমায়েশ জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আশপাশে কোনও হোটেল আছে?”
“হোটেল? সে তো আছেই। মেন রোডের দিকে গেলেই পেয়ে যাবেন,” একমুখ হাসি নিয়ে বলে বাউরি। তারপর জিজ্ঞেস করে, “এখানে বুঝি প্রথম এলেন ভাই?”
যুবক স্মিত হেসে সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকাল। তারপর বলল, “আমি ব্যাঙ্কে চাকরি করি। এখানে ট্র্যান্সফার হয়ে এসেছি।”
“আচ্ছা। তা হলে হোটেলেই থাকবেন?”
“হুম, যতক্ষণ না একটা বাড়িভাড়া পাচ্ছি,” চায়ে চুমুক দিয়ে বলল যুবক।
যুবকের কথা শুনে সোমনাথবাবুর কথা মনে পড়ে গেল বাউরির। সোমনাথ রায় বৃদ্ধদের আড্ডার মধ্যমণি। গিন্নিকে নিয়ে বুড়োবুড়ির ছোট্ট সংসার। একমাত্র ছেলে দিল্লিতে থাকে। সম্প্রতি ভদ্রলোক দোতলা তুলেছেন। ইচ্ছে, ওপরের তলায় ভাড়া বসাবেন। এসব কথা সকালে তাঁদের আড্ডা থেকেই সে জেনেছে। তাই উপযাচক হয়েই বলে ওঠে বাউরি, “আপনার ভাড়াবাড়ি চাই?”
“কেন? আপনার সন্ধানে কোনও বাড়ি আছে নাকি?”
“আছে তো। আপনি চাইলে দেখাতে পারি।”
শুনে যুবকও আগ্রহী হয়। একটা বাসস্থান তার দরকার। সেটা যত তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়, ততই মঙ্গল। তা ছাড়া অচেনা অজানা অজ-পাড়াগাঁয়ে কেউ যখন সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, তাকে অবমাননা করা উচিত নয়। সুতরাং বাউরির সঙ্গে বাড়ি দেখতে রওনা হয়ে পড়ল সে।
দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেল সহজেই। যুবকের বাড়িটা পছন্দ হয়েছে। পছন্দমতো ভাড়াটে পেয়ে সোমনাথবাবুও খুশি। আর কাজটা করতে পেরে বাউরিও তৃপ্ত।
সেদিন সন্ধেবেলা উনুনে আগুন দিতে দিতে বাউরি লক্ষ করে, বিজনমাস্টার সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছেন। কী মনে হতে হাতের কাজ থামিয়ে মাথা তুলে বাউরি ডাকে, “ও মাস্টারমশাই, শুনছেন?”
বিজনমাস্টার পেছন ফিরে বলেন, “কিছু বলবি বাউরি?”
বিজনমাস্টারের বয়স বেশি নয়। বড়জোর ষাট-বাষট্টি। মেয়ের বিয়ে নিয়ে খুব চিন্তিত থাকেন ইদানীং। বিস্তর খোঁজাখুঁজি করছেন, কিন্তু উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পাচ্ছেন না। সকালের আড্ডাতেও তাঁর মুখ থেকে শুধু একই দুর্ভাবনার কথা শোনা যায়।
বাউরি ফিসফিসিয়ে বলে, “আজ্ঞে, ভুল হলে ক্ষমা করবেন মাস্টারমশাই। একটা প্রস্তাব ছিল।”
“কী প্রস্তাব, বল না,” কপালে ভাঁজ ফেলে বলেন বিজনমাস্টার।
“আজ্ঞে, সোনাদিদিমণির জন্যে এক পাত্রের সন্ধান পেয়েছি।”
“পাত্রের সন্ধান! তুই কোথায় পেলি?” স্বাভাবিকভাবেই অবাক ও উৎসুক মাস্টারমশাই।
বাউরি তখন নবাগত যুবকের কথা সবিস্তারে জানায় তাঁকে।
পলকেই বিজনমাস্টারের চোখে আশার আলো খেলে যায়। ছেলেটি সম্পর্কে যতটুকু জানা গেল, তাতে তো ভালই মনে হচ্ছে। ব্যাঙ্কের চাকরি। বদলি হয়ে এসেছে যখন, তখন নির্ঘাত অফিসার পদেই আছে। বাকিটা সোমনাথবাবুর বাড়িতে গিয়ে ছেলেটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বোঝা যাবে। বাউরিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিজনমাস্টার আর কালবিলম্ব করলেন না। উঠে দাঁড়ালেন। ইচ্ছে, এখনই একবার সোমনাথবাবুর বাড়ি যাবেন।
বিজনমাস্টার বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই দোকানে আসেন দীপক দাশ। বাউরিকে এককাপ চা দিতে বলে উদাস হয়ে বসে থাকেন বেঞ্চে। বাউরি চা দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “দাদার শরীর ঠিক আছে তো?”
দীপক লম্বা শ্বাস ফেলে বলেন, “হ্যাঁ রে, শরীর ঠিকই আছে, কিন্তু ছেলেটাকে নিয়ে বড় চিন্তায় আছি।”
“ওইটুকু তো ছেলে আপনার, ওকে নিয়ে কিসের এত চিন্তা দাদা?”
দীপক বলেন, “আর বলিস না, ছেলেটার জন্যে কোনও মাস্টার পাচ্ছি না। অঙ্কে বড্ড কাঁচা ও। এ বছর মাধ্যমিক দেবে, অথচ কী যে করবে, কে জানে!
“কেন দাদা, অনেকেই তো বাসে চেপে শহরে টিউশন পড়তে যায় দেখি।”
“সে যায় ঠিকই। কিন্তু আমার ছেলেটা বড় রুগ্?ণ। আসা-যাওয়ার ধকলই সইতে পারবে না। অথচ কাছাকাছি কোনও মাস্টারও নেই। মহা সমস্যায় পড়েছি।”
পলকেই যুবকের কথা মনে এল বাউরির। বলল, “আমি একজনের কথা বলতে পারি, এখানে নতুন এসেছে। তবে জানি না, সে পড়াতে পারবে কি না।”
বাউরির দিকে তাকালেন দাশবাবু। বাউরি বলে, “সোমনাথখুড়োর নতুন ভাড়াটে দাদা। নাম, সৌমেন। সৌমেন চ্যাটার্জি। আজই এসেছে। ছেলেটার বিস্তর পড়াশোনা। সোমনাথখুড়োকে যখন বলছিল, তখন শুনছিলাম। তবে আমি তো অতসত বুঝি না, আপনি একবার খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।”
দীপক দাশ যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছেন। আর দেরি না-করে তখনই রওনা দেন সোমনাথবাবুর বাড়িতে।
সন্ধেবেলায় বাউরির দোকানে খুব ভিড়। পলাশপুরে ওর দোকানের চপ বিখ্যাত। দিনেই সব প্রস্তুত করে রাখে বাউরি। বেসন গুলে, চপের মশলা বানিয়ে, বিস্কুটের গুঁড়ো মাখিয়ে রাখে। সন্ধেতে শুধু অর্ডার অনুযায়ী ছাঁকা তেলে গরম গরম ভেজে দেয়।
গানের ক্লাস সেরে ফেরার পথে বাউরির দোকানে এল সোনালি। বিজনমাস্টারের মেয়ে। ভিড়ের ফাঁক দিয়ে বাউরিকে চপের অর্ডারটা দিতেই সোনালির চোখ পড়ল সৌমেনের দিকে। দোকানের এক কোণে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল সৌমেন।
একে এলাকায় নতুন, তার ওপর সুপুরুষ, ছিমছামÍ নজরকাড়া চেহারা। সোনালিরও নজর আটকে গেল। আড়চোখে সৌমেনকে দেখে সে। একবার চোখাচোখি হতেই সোনালি অপ্রস্তুত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিল। ততক্ষণে ঠোঙায় চপ ভরে বিটনুন, শসা, পেঁয়াজকুঁচি ছড়িয়ে এগিয়ে ধরেছে বাউরি। দোকান থেকে বেরনোর সময় আরও একবার তাকাল সোনালি। এবারও চোখে চোখ ধাক্কা খেল। সৌমেন যেন একদৃষ্টে ওকেই দেখছিল। দু’গালে গোলাপি আভা ও ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি নিয়ে দ্রুত বাড়ির পথে এগোয় সোনালি।
বাউরির দোকানের একদিনের ইতিবৃত্ত এখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু সৌমেনের মনের অবস্থা না-জানালে গল্প অসমাপ্ত থাকবে। উপসংহারটুকুর জন্য সৌমেনের ডায়েরির পাতায় চোখ রাখতে হবে:
‘পলাশপুরে আজ আমার প্রথম দিন। খোদ কলকাতা থেকে একেবারে অজ-পাড়াগাঁয়ে বদলি। মনটা এমনিতেই দমে ছিল। উপরন্তু এখানকার লোকগুলো বড্ড গায়ে-পড়া ও কৌতূহলী স্বভাবের। আসতে না-আসতেই বিজন ব্যানার্জি নামে একজন এসে আলাপ জমালেন। আলাপ তো নয়, রীতিমতো ইন্টারভিউ যাকে বলে। বংশপরিচয়, আদিবাড়ি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, এমনকী আমার বাবারও নাড়িনক্ষত্র নিয়ে প্রশ্ন করে ছেড়েছেন। এবং একইসঙ্গে চলেছে নিজের কন্যারতœটির গুণকীর্তন। যেন পরিচিত হতে আসা নয়, পাত্র দেখতে আসা। অসহ্য লাগছিল।
ঘণ্টাখানেক বোর করে তিনি চলে যেতেই এলেন এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর বাবা। তিনিও এক আজব লোক। কথা নেই বার্তা নেই, প্রথম পরিচয়েই তাঁর ছেলেকে পড়ানোর জন্যে চেপে ধরলেন। কী অদ্ভুত জায়গা রে বাবা!
তবে মন্দের ভাল, আসামাত্রই একটা ভাল ঘর পেয়ে গেছি। বাড়িওয়ালাও মন্দ ঠেকেছে না। এজন্য অবশ্যই চায়ের দোকানের ভদ্রলোকের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। সন্ধেবেলা সেই দোকানেই একবার গিয়েছিলাম। খুব ভিড় ছিল তখন। আশপাশের লোকজন আমাকে এমনভাবে দেখছিল, যেন কোনও আজব জন্তু আমি! যেন চিড়িয়াখানার খাঁচা ভেঙে পালিয়ে এসেছি।
কী আর করা যায়? চাকরির দায়। আগামী দু’-তিন বছর যেহেতু এই নির্বাসনই বরাদ্দ, অগত্যা মানিয়ে নেওয়া ছাড়া পথ নেই। ভাবছি, মাধ্যমিকের ছাত্রটিকে পড়াব। নইলে অফিস-শেষে এই অজ-পাড়াগাঁয়ে সময় কাটবে কী করে?
অবশ্য একটা ভাল খবরও আছে। শত অন্ধকারেও একটা আলোর ঝিলিক দেখতে পেয়েছি। এই আলোটুকুর জন্যে আমি পলাশপুর কেন, জাহান্নামেও থাকতে রাজি। দেখলাম ওই চায়ের দোকানেই। চপ কিনতে এসেছিল। গোলাপি শরীরে গোলাপি সালোয়ার। টানা টানা বাদামি চোখ। কী কটাক্ষ সে চোখে! তেমনই তার কণ্ঠস্বর! এমনভাবে চপ চাইল… যেন সেতার বাজাল কেউ। আ-হা! মনে হচ্ছিল চাকরি ছেড়ে চপের দোকানই খুলি। সে-ও আমাকে দেখছিল, যেমন করে পকেটমার সন্দেহে সাবধানী চোখে কেউ কারও দিকে তাকায়, ঠিক সেভাবেই। দু’বার চোখে চোখও পড়ে গেল। কিন্তু ওটুকুই। পরিচয় হয়নি। নাম জানি না। কোথায় থাকে সে-ও অজানা। কিন্তু ছোট জায়গা, ঠিক খুঁজে নেব আমি। আপাতত সেই চপ-বিলাসিনীর নাম দিলাম ঝিলিক। স্বজনবন্ধু বর্জিত পাড়াগাঁয়ের জীবনে এখন সে-ই আমার একমাত্র আশার ঝিলিক।’
পাঠক, বুঝতেই পারছেন, এখানেই কাহিনি শেষ নয়, বরং নতুন এক কাহিনির ভূমিকা এটা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com