হজের প্রস্তুতির আলোচনা এলেই সাধারণত আমাদের মাথায় আসে তার বৈষয়িক প্রস্তুতির কথা। টাকা-পয়সা ও মালপত্র গোছানো। পাসপোর্ট-ভিসাসহ যাবতীয় কাগজপত্র তৈরি ও সংগ্রহ। অবশ্যই এগুলো হজের প্রস্তুতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে এর সঙ্গে অতীব প্রয়োজন হলো তার রুহানি বা আত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণও। হজের বরকত, ফলাফল ও প্রাণ অর্জিত হওয়ার জন্য আবশ্যক হলো দীর্ঘ সময় থেকেই পূর্বপ্রস্তুতি। এ প্রস্তুতি পর্বে যদি কয়েক বছরও লেগে যায় তাহলেও অধৈর্যের কিছু নেই। যেন এ হাদিসের অন্তর্ভুক্ত হতে না হয়। হাদিস শরিফে এসেছে, আমার উম্মতের মধ্যে এমন একটি যুগ আসবে যখন ধনীরা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে হজ করবে, মধ্যবিত্তরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে, দরিদ্ররা ভিক্ষাবৃত্তির উদ্দেশ্যে এবং আলেমরা লোক দেখানোর লক্ষ্যে। ’ (তারিখে বাগদাদ ১০/২৯৫, আলফিরদাউস-দায়লামি : হাদিস নং ৮৬৮৯, হাদিসটির সূত্র দুর্বল)
তাকওয়া ও খোদাভীতির প্রস্তুতি: হজের প্রস্তুতি কী? অন্তরে ঈমানের শক্তি বৃদ্ধি করা। ঈমানের স্বাদ অনুভূত হওয়া। আর অন্তরে জাগ্রত করা আল্লাহ ও রাসুলের ভালোবাসার উত্তাপ, আগ্রহ ও উদ্দীপনা। আর নফসকে নিয়ন্ত্রণ, মুজাহাদা ও কোরবানির জজবা তৈরি হওয়া। এক কথায় তাকওয়া ও খোদাভীতির পাথেয়। এটিই হলো হজের আসল পাথেয়। হজের সফরে কদমে কদমে এই পাথেয়র কমতি অনুভূত হবে, আর তার প্রতিকার কোনো বৈষয়িক সরঞ্জাম দ্বারা হবে না। বরং এর জন্য আত্মিক পাথেয়র প্রয়োজন হবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হজের সময় নির্দিষ্ট মাসসমূহ। অতএব এই মাসসমূহে যে নিজের ওপর হজ আরোপ করে নিল, তার জন্য হজে অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। তোমরা যেসব ভালো কাজ করো, আল্লাহ তা জানেন। আর পাথেয় গ্রহণ করো, নিশ্চয়ই উত্তম পাথেয় হলো তাকওয়া। আর হে বুদ্ধিমানরা, তোমরা আমাকে ভয় করো। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৭) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসির (রহ.) লেখেন, ‘এ আয়াতে হজের বৈষয়িক পাথেয় অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আত্মিক পাথেয় অর্জনের প্রতিও উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং আত্মিক পাথেয় অর্জনকেই বেশি কল্যাণকর বলে অভিহিত করা হয়েছে। ’ (তাফসিরে ইবনে কাসির ১/৫৪৮)
আনাস (রা.) বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর কাছে এসে বললে, হে আল্লাহর রাসুল! আমি সফরের ইচ্ছা করেছি, আপনি আমাকে কিছু পাথেয় দান করুন। নবী করিম (সা.) বলেন, আল্লাহ তোমাকে তাকওয়ার পাথেয় দান করুন! লোকটি বলল, আরো কিছু দান করুন। নবী (সা.) বললেন, আর তোমার গুনাহ ক্ষমা করুন! লোকটি বলল, আমার মা-বাবা আপনার ওপর উৎসর্গ হোন, আপনি আমাকে আরো কিছু দান করুন। নবী (সা.) বলেন, আর আল্লাহ তোমার জন্য সর্বত্র কল্যাণকর বিষয়াদি সহজ করে দিন! (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৪৪)
তীব্র পিপাসা প্রয়োজন: হজের সফরে এ কথা অন্তরে জাগ্রত রাখতে হবে যে এটি আল্লাহর ভালোবাসার পরীক্ষার সময়। হজের নিয়তের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা অন্তরে জাগ্রত করতে হবে। এমনকি ভালোবাসার পিপাসা তীব্র থেকে তীব্রতর করার চেষ্টা করতে হবে। কেননা পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলাকে তো দেখা সম্ভব নয়, তবে তাঁর সাক্ষাতের পিপাসা মেটানোর সর্বোত্তম উপায় হলো তাঁর ঘরের জিয়ারত। তাই সাক্ষাতের পিপাসা যত তীব্র হবে, সাক্ষাৎ তত মধুর ও ফলদায়ক হবে।
তাই আসুন, আমরা হজের বৈষয়িক প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে রুহানি তৈয়ারিও অর্জনের জন্য চেষ্টা করি। আর এ তৈয়ারির সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ও সহজ পথ হলো হজে যাওয়ার আগে কিছুদিন হলেও এমন কোনো পরিবেশে সময় কাটানো যার প্রভাবে ঈমানি অনুভূতি অন্তরে জাগ্রত হয়, আল্লাহ ও রাসুলের মহব্বত লাভ হয়। কোনো মুত্তাকি আলেম ও আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির সংস্রব অর্জনের মাধ্যমে হোক, অথবা দাওয়াত ও তাবলিগে সময় কাটানোর মাধ্যমে হোক। আশা করি, এগুলো হজের সফরের বরকতকে শতগুণ বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে, ইনশাআল্লাহ!
সূত্র: আলী মিয়া নদভি (রহ.)-এর বয়ান অবলম্বনে