শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১৯ অপরাহ্ন

স্বপ্নের সুইৎজারল্যান্ড

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০২২

ইটালি থেকে গ্লোবাস গেটওয়ের বাসে চড়ে আমাদের পথচলা শুরু হল উত্তরের অভিমুখে, সুইৎজারল্যান্ডের দিকে। সেখানে প্রবেশের জন্য আল্পস পর্বত পেরোতে হবে। ইটালির মিলান হয়ে বেশ কিছুটা চলার পর সুইৎজারল্যান্ডে প্রবেশ করলাম। আরও কিছু পর বাস গিয়ে থামল একেবারে লুগানো লেকের ধারে। লুগানো একটি গ্লেসিয়াল লেক। ইটালিয়ান ভাষায় ‘লাগো ডি লুগানো’। বহুদিন আগে এটি একটি গ্লেসিয়ার ছিল। বর্তমানে এটি এক জলাশয়, যার বেশির ভাগটা সুইৎজারল্যান্ডে, বাকিটা ইটালিতে। জীবনে প্রথম গ্লেসিয়াল লেক দেখলাম। এর আগে হিমবাহের ছবি দেখেছি কেবল ভূগোল বইয়ে।
সর্বাঙ্গে শিহরন, প্রকৃতির কোলে নিজেকে সমর্পণ আর সেই সঙ্গে নিজের চোখকে সার্থক করতে লুগানো পরিক্রমা শুরু করি। ছবি আর কত তোলা যায়! প্রতিটা অ্যাঙ্গল থেকেই একই সৌন্দর্য, তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করতে থাকি। লুগানো লেকের ধারে পা রেখেই মনে হল, এ যেন কাশ্মীর। ডাল লেকের ছবি দেখে এমনই লেগেছিল। এখানে পিছনে সুইস আল্পস, ওপরে নীল আকাশ। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন লুগানোর ধার। সবুজ গাছগাছালি আর রংবেরঙের ফুলে ভরা। লেকে চরে বেড়াচ্ছে প্রচুর রাজহাঁস। উন্নত গ্রীবা দুলিয়ে আমাদের যেন স্বাগত জানাল তারা। মনের সুখে লেকের জল থেকে মাছ খাওয়ায় কিছুটা হলেও ভাটা পড়ল তাদের। একসঙ্গে বহু পর্যটক বাস থেকে তাদের সামনে নেমেছে। ছবি তুলছে। অতএব তাদের নিরবচ্ছিন্ন শান্তির ইকো-সিস্টেম চৌপাট সেই মুহূর্তে। লুগানো লেকের অনতিদূরে রাস্তায় নেমেই চিরপরিচিত ট্রামের দেখা পেলাম। যেন পুরনো কলকাতা। সেখানে মানুষ কত আনন্দে ট্রামে চড়ছে। আর আমরা কিনা সেই ট্রামগাড়িকে তুলে দিচ্ছি।
আমাদের দেশ যেমন রাজ্যে বিভক্ত, ঠিক তেমনই এদেশ রাজ্যের সমতুল্য ক্যান্টনে বিভক্ত। লেক লুগানো দেখে দেশটার আর-এক ক্যান্টন লুসার্ন-এ যাওয়ার কথা আমাদের। সুইৎজারল্যান্ডের নিজস্ব কোনও ভাষা নেই। ফরাসি, ইটালিয়ান ও জার্মান ভাষায় কথা বলে এদেশের মানুষ। ছোট থেকে শুনে এসেছি সুইস কটন, সুইস ছুরি-কাঁচি, সুইস ক্লকের প্রিসিশনের কথা। সেসবের সঙ্গে সুইস রোল এবং অনবদ্য সুইস চকোলেটের স্বাদ নেওয়ার আশায় মনটা ছটফট করে উঠল। সুইৎজারল্যান্ডের ঠিক মাঝখানে লুসার্ন। নদী আর লেক নিয়ে সুইস আল্পস পর্বতের কোলে ছবির মতো সুন্দর শহর। মুগ্ধতার পারদ চড়তেই থাকল। লুসার্নে পৌঁছেই রিউস নদীর ধারে গিয়ে হাজির হলাম। রিউস এবং আরেÍ এই দুই নদীর সঙ্গমস্থল ব্রাগ-এ এসে জুটেছে আর-এক নদী, লিম্মাট। মানে ত্রিবেণী সঙ্গম। এই স্থানটিকে ‘ওয়াটার কাস্?ল অফ সুইৎজারল্যান্ড’ বলা হয়। এরপর সব নদী মিলে জার্মানির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সোজা রাইন নদীতে গিয়ে মিশেছে ও সেখান থেকে নর্থ সি-তে গিয়ে পুরোপুরি তাদের আত্মসমর্পণ। লুসার্ন হল এদেশের অন্যতম বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট। এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্য হল লুসার্ন লেক, মাউন্ট পিলাটুস এবং চতুর্দশ শতাব্দে রিউস নদীর ওপর নির্মিত কাঠের সেতুÍ চ্যাপেল ব্রিজ বা ওদের ভাষায় কধঢ়বষষনৎহৃপশব। এটি ইউরোপের প্রাচীনতম ঢাকা কাঠের সেতু। এর বৈশিষ্ট্য হল, এর ভেতরে কিছু অনবদ্য পেন্টিং আছে। লুসার্নে নদীর ওপর এমন তিনটি কাঠের ফুটব্রিজ আছে। সপ্তদশ শতাব্দের শিল্পীদের শিল্পকর্মে সমৃদ্ধ এমন ফুটব্রিজ ইউরোপের আর কোথাও নেই। ব্রিজের মধ্যে পা রেখে চলার পথে পথচারীরা অনায়াসে চোখ রাখতে পারেন ত্রিকোণ এই ব্রিজের মাথায়। যেখানে অঙ্কিত আছে সুন্দর চিত্রকর্ম। এদেশে গুছিয়ে গড়ে উঠেছে পরিপাটি এক পর্যটনশিল্প। সুইসরা জানে সব কিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখে কীভাবে ট্যুরিস্টকে টেনে আনতে হয়। পঞ্চদশ শতাব্দে নির্মিত ঐতিহাসিক এক ক্লক টাওয়ার লুসার্নের আর-এক অনবদ্য দর্শনীয় বস্তু। রিউস নদীর তীরে এখনও দৃশ্যমান ঘড়িস্তম্ভটির চারদিকে একদা ছিল মধ্যযুগীয় প্রাচীর এবং ন’টি স্তম্ভ। আজ সেগুলি নেই, পড়ে আছে শুধুমাত্র ক্লক টাওয়ারটি। এই ক্লক টাওয়ার কেবলমাত্র প্রতিরক্ষার জন্য নির্মিত হয়নি। লুসার্নের মানুষ ও নাবিকদের সঠিক সময় জানানোও ছিল এর উদ্দেশ্য। গির্জার ঘণ্টার এক মিনিট আগে বাজত এই ঘড়ি। তাই বুঝি সুইস ঘড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এদেশের মানুষের কাছে সময়ের দাম এবং পাঙ্কচুয়ালিটি মজ্জাগত হয়ে গেছে তাদের যাপনের সঙ্গে। এবার আমাদের দ্রষ্টব্য লায়ন মনুমেন্ট। লুসার্নের অন্যতম বিখ্যাত স্থাপত্য এই সিংহমূর্তি। ফরাসি বিপ্লবের সময় ছ’শোরও বেশি সুইস দেহরক্ষী শহিদ হয়েছিলেন। তাঁদের স্মরণে এই স্থাপত্যটি নির্মিত হয়। আহত এই সিংহ তাঁদের প্রতি শোকজ্ঞাপনের প্রতীক। মার্ক টোয়েনের ভাষায়, Ôthe most mournful and moving piece of stone in the worldÕ| এর পাদদেশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার পালা এখন।   পরদিন সকালে আমাদের অভিযান মাউন্ট পিলাটুসের মাথায় চড়া। লেক লুসার্ন থেকে যাত্রা শুরু। ট্রেনে করে ৬৮০০ ফিট উঁচুতে পিলাটুস পর্বতের মাথায় যাওয়ার ব্যবস্থা। তার পর সেখান থেকে রোপওয়ে বা কেব্?ল কারে করে পাহাড় থেকে নামা হবে। আল্পস পর্বতের গায়ে এই অভিনব রেলপথ পৃথিবীর সর্বোচ্চ ফিউনিকিউলার রেলওয়ে ট্র্যাক। রেলের টিকিট কাটা হল। ওদের ভাষায় এই স্টেশনের নাম Alpnachstad| সেখান থেকে পর্বতশিখরে গিয়ে ট্রেন আমাদের নামাবে Pilatuskulm-এ।
মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক অসাধারণ নিদর্শন এই ঐতিহাসিক রেলপথ। পুরো রেলপথের দৈর্ঘ্য ৪.৬ কিলোমিটার। একের পর এক পাহাড়ের গায়ে কাটা সুড়ঙ্গ পেরোতে পেরোতে যাওয়া। শম্বুকের ন্যায় গুটিগুটি চলে ট্রেন। এই ফিউনিকিউলার রেলওয়ে চালিত হয় এক অন্যরকম প্রযুক্তিগত কৌশলে। অতটা খাড়াই পাহাড়ের গায়ে সাধারণ রেলপথে ট্রেন চললে তো গড়িয়ে যাবে, তাই বিশেষ দাঁত সম্বলিত চাকা বা কগহুইলস (গিয়ারযুক্ত চাকা)-এর সাহায্যে ট্রেনটি উঠতে থাকে পাহাড়ের গা বেয়ে। ট্র্যাকের সঙ্গে ওই বিশেষ ধরনের চাকার ঘর্ষণের ফলে ট্রেনটি গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এ অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। ট্রেনে বসে আল্পস ও তার আশপাশ দেখতে দেখতে কোথায় যেন নিমেষের মধ্যে হারিয়ে গেলাম আমরা। আলপাইন বনরাজি আর সবুজ আল্পসের কোলে চড়ে এক যাত্রী-বোঝাই ট্রেন ধুঁকতে ধুঁকতে উঠছে তো উঠছেই, মাউন্ট পিলাটুসের মাথায়। শেষে যুদ্ধজয়ের হাসি নিয়ে যাত্রীরা সবাই নামতে লাগলেন পিলাটুসের মাথায় রেল স্টেশনে। সেখানে পাহাড়ের মাথায়, ওই ৬৮০০ ফুট উঁচুতে এক কাফেটেরিয়ায় বসে এবার কফি খাওয়ার পালা। ওপর থেকে লুসার্ন লেকটিকে একলহমায় দেখে নেওয়া গেল আবারও। লেকের রূপ সামানাসামনি একরকম। এখন উঁচু পাহাড়ের মাথার ওপর থেকে সবুজ আলপাইন বনানী-বেষ্টিত লেকটি যেন আরও সুন্দর বলে মনে হল। সেই সঙ্গে ইতিউতি সাদায়-কালোয়, বলিষ্ঠ, পাহাড়ি সুইস গরু। নির্জন পাহাড়ের গায়ে গরুগুলি আপনমনে সবুজ ঘাস খুঁটে খাচ্ছে। তাদের গলায় ঘণ্টা বাঁধা। এই নিরালা পরিবেশে তাদের ঘণ্টাগুলি এক অপূর্ব বাদ্যের সৃষ্টি করছে। বড় মিঠে সেই পাহাড়ি ধুন। যেন মাউন্টেন সোনাটা। সেই টুংটাং শুনতে শুনতে ধূমায়িত কফির স্বাদ নেওয়া আর তার পর নির্দিষ্ট সময়ে রোপওয়ের কিউতে দাঁড়িয়ে কেব্?ল কারে অবতরণ পিলাটুসের মাথা থেকে। আবারও খুব কাছ থেকে পিলাটুস তথা আল্পসকে বিদায় জানাতে জানাতে নেমে এলাম দড়ির ওপর দিয়ে।
লুসার্নে নেমে এসে এক সুইস বেকারিতে গিয়ে স্যান্ডউইইচ আর সুইস চকোলেট সহযোগে উদরপূর্তি করলাম। তার পর শুরু হল শপিংপর্ব। সারি সারি ঘড়ির দোকান, ক্রেতাকে আকর্ষণ করবেই। নানা ধরনের ঘড়ি আর তাদের শ্রুতিমধুর শব্দ শুনেও চক্ষুকর্ণের সুখ। সেও এক বিরল অভিজ্ঞতা। এদেশে না-এলে জানতাম না। সুইস ঘড়ির দোকানে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিখ্যাত কুকু ক্লক কিনছে সকলে। তবে সুইৎজারল্যান্ডে জিনিসপত্রের খুব দাম। তাই আমাদের গাইড জেনিন-এর কথামতো জার্মানিতেই কেনা হয়ে গেছিল এই সুইস কুকু ক্লক। তখন কি আর বুঝেছিলাম, সস্তার কুকু ক্লক বেইমানি করবে! কলকাতায় এসে সেই ঘড়ির মধ্য থেকে কাঠের জানলা খুলে কুকু পাখি তিন-চারদিন তার কলকাকলিতে বাড়িঘর মুখর করে রাখল। তার পর একদিন জন্মের মতো জানলার পাল্লা দড়াম করে বন্ধ করে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হল তার। ভাগ্যিস কলকাতায় এমন তুখোড় মেক্যানিক আছেন যাঁরা সারিয়ে দেন সেই সুইস ঘড়ি। একটা দিন শুধুই সস্তার সুইস চকোলেট দিয়ে লাঞ্চ সেরেছিলাম, একটা সুইস স্যুভেনির কিনব বলে। পোরসিলেনের একটা ছোট্ট সুইস ফ্লাওয়ার ভাস আজও আমার কিউরিয়ো কালেকশন আলো করে আছে, সুইৎজারল্যান্ডের মেমেন্টো হিসেবে। ওকে দেখে মন শান্ত হয় আমার। সুউচ্চ পর্বত আর সুনীল জলাশয়ের ঘেরাটোপে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুটো স্মরণীয় দিন মনে পড়ে। সে যেন এক রূপকথার দেশ। বসনে, ভূষণে, আহারে, বিহারে সব ক্ষেত্রেই ইউরোপের আর পাঁচটা শহরের মতোই লুসার্নে সুইস জীবনযাপনের সোশ্যাল কোশেন্টও যেন সদাই উত্তুঙ্গ। বাড়িঘরের বাইরের রং, জানলায় লেসের দুধসাদা পর্দা, উইন্ডো-পেনে সার দিয়ে রঙিন ফুলগাছ, ঝকঝকে পথঘাট, রেস্তরাঁয় হইহই। বড় সুসংবদ্ধ, শৈল্পিক আর সাজানো-গোছানো শহর। অবশ্য মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় কি আর ভেতরের সব রহস্য উন্মোচিত হয়? দিনের পর দিন, বছরের পর না-থাকলে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com