১৫ থেকে ২০ শতক জায়গার উপর একটি খেলার মাঠ। এই মাঠের দুই পাশে রয়েছে দুইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও একটি ধর্মীয় স্থাপনা (মাজার)। সম্প্রতি এই মাঠ চিরে তৈরী করা হয়েছে আট ফিট প্রশস্তের পাকা সড়ক। ওই সড়ক দিয়ে এখন চলাচল করছে বিভিন্ন যানবাহন। এ যেন শহরের কোন এক গলি পথ। এ সড়ক নির্মাণের ফলে ওই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭ শতাধিক শিক্ষার্থীর জীবনের ঝুঁকি তৈরী হয়েছে।
জানাগেছে, শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার কুড়িকাহনিয়া বাজারের পাশেই ব্রিট্রিশ শাসনামলে (১৯৩৮ সাল) প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী কুড়িকাহনীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুড়িকাহনিয়া সাউথ কুরুয়া উচ্চ বিদ্যালয়। দুইটি প্রতিষ্ঠানের একর একর জায়গা থাকার পরেও মালিকানা দ্বন্দের কারণে বর্তমানে ওই মাঠ এখন ৩ থেকে ৪ কাঠায় পোঁছেছে। তার উপর সম্প্রতি ওই খেলার মাঠ চিরে তৈরী করা হয় পাকা সড়ক। যে সড়ক দিয়ে প্রতিদিন ট্রলি, অটো, সিএনজি, মোটরসাইকেল, রিক্সা, বাইসাইকেল সহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করছে। ফলে কোমলমতি শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা তাদের একমাত্র খেলার মাঠে আর খেলতে পারছে না। খেলাধুলার অভাবে শিশুরা অমনযোগী হয়ে পড়ছে পড়াশুনায়। হীনমন্যতায় ভোগার পাশাপাশি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। মাঠের অভাবে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে বিদ্যালয়ের খেলাধুলার অধিকার থেকে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভালোভাবে গড়ে তোলার জন্য খেলার মাঠ তৈরির দাবি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক জানান, মাঠের অভাবে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হয় না। টিফিন কিংবা অন্য বিরতির সময় তারা শ্রেণীকক্ষে বসেই সময় পার করে। বিক্ষিপ্ত ও বিছিন্ন ভাবে শ্রণিকক্ষে জাতীয় সঙ্গীত-শপথ বাক্য পাঠ করানো হলেও খেলাধুলা ও শরীরচর্চা হয়না। এতে করে অন্যান্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রমে পিছিয়ে পড়ছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
এলাকাবাসী ও অভিভাবকরা জানায়, শিক্ষার্থীদের খেলার মাঠ দখল করে সড়ক নির্মানের ফলে খেলার মাঠ ছোট হয়ে এসেছে। স্কুলের সামনে পাকা সড়কের কারণে শিশু শিক্ষার্থীরা দুর্ঘটনার কবলে পড়বে এমন আশঙ্কা করছেন অনেক অভিভাবক। তাদের দাবি, সড়ক হোক স্কুলের দক্ষিণ দিক দিয়ে, মাঠের ভিতর দিয়ে নয়। বেশ কয়েকজন অভিভাবক বলেন, ওই সড়ক পাকা করার সময় স্থানীয় জনগন বাধা দিলে মাঠের উপর সড়ক নির্মান বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে। তবে অদৃশ্য শক্তির ইশারায় আবার শুরু হয় ওই খেলার মাঠের উপর দিয়ে সড়ক তৈরী এবং ওই সড়কের নিমার্নও শেষ করা হয়।
স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার মো. মুস্তফা বলেন, দুই স্কুলের মাঝখান দিয়ে সব সময় বিভিন্ন যানবাহন যাতায়াত করায় যে কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমার দুইটা বাচ্চা ওই স্কুলে পড়াশুনা করে। মাঠের মাঝখান দিয়ে পাকা সড়ক থাকায় আমি সব সময় চিন্তায় থাকি কখন যেন আমার বাচ্চা গুলো দুর্ঘটনার কবলে পরে।
এ বিষয়ে কুড়িকাহনিয়া সাউথ কুরুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রিয়া ইসলাম বলেন, মাঠ না থাকায় আমরা বিদ্যালয়ে এসে কোন প্রকার খেলাধুলা ও শরীর চর্চা করতে পারিনা। এতে আমাদের পড়াশুনায় মন বসেনা। টিফিন হলে ক্লাসে বসে থাকি। ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র মিনাল মিয়া বলেন, ক্লাস চলাকালিন সময়ে ওই সড়ক দিয়ে ট্রলি, অটোরিক্সা, সিএসজি, মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহনের শব্দে ক্লাসে স্যারের কথা ভালো ভাবে বুঝতে পারিনা। অনেক সময় উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে স্কুলের মাঠ দিয়ে বিভিন্ন যানবাহন যাতায়াত করায় আমাদের পড়ালেখার সমস্যা হয়। ৮ম শ্রেণীর ছাত্র রায়হান মিয়া বলেন, আমরা যখন সকালে প্যারেড করি তখন দুইপাশে অনেক যানবাহন জমে যায়, যার জন্য এখন স্কুলে পিটি-প্যারেড হয়না।
উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশিদ জানান, ঘটনাটি স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিকে অবগত করা হয়েছে। মাঠের মাঝখান দিয়ে সড়ক নির্মাণ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার বিঘ্ন ঘটাসহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি এবং বিদ্যালয়ের সুন্দর্য নষ্ট হয়েছে বলেও তিনি স্বীকার করেন। এছাড়াও সড়কটি তৈরির সময় তিনি দ্বায়িত্বে ছিলেন না বলেও জানান।
এ ব্যাপারে কুড়িকাহনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মর্জিনা খাতুন মুঠোফোনে বলেন, মাঠের অভাবে বিদ্যালয়ে পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা ব্যহত হচ্ছে। এমনকি আমাদের বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযাগিতাও করতে হয় দায়সারা ভাবে। অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের মাঠে যা মাটেও কাম্য নয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে স্কুলের মাঠ তৈরিসহ ওই সড়ক অপসারনের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেন তিনি।
স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি (এডহক) মো. জিয়াউর রহমান মানিক বলেন, এই সড়কটি আমার দ্বায়িত্ব গ্রহনের আগে তৈরি করা হয়েছে। তবে কোমলমতি এই শিশুদের খেলার মাঠ দেয়া আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। ওই সময় স্থানীয় প্রভাবশালীদের মধ্যস্থতায় সড়কটি তৈরি করা হয়েছে বিধায় সাধারণ জনগনের বাঁধা দেয়ার মতো পরিবেশ ছিলোনা। তবে স্কুলের জন্য একটি ৪তলা বিশিষ্ট নতুন ভবন তৈরি হওয়ায় পুরাতন ভবন ভেঙ্গে মাঠ তৈরি করা যেতে পারে এবং মাঠের মাঝখান থেকে ওই সড়ক সরিয়ে মাঠের শেষ প্রান্ত দিয়ে দেয়াল তৈরি করে শিশুদের নিরাপদ করা যেতে পারে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ খান নুন বলেন, দুইটি স্কুল এক সাথে হওয়ার পরেও স্কুলের মাঠ আগে থেকেই ছোট। আবার দুইটি স্কুলেরই নতুন করে আলাদা আলাদা ভবন তৈরি করে মাঠকে আরও ছোট করা হয়েছে তার উপর আবার পাকা সড়ক তৈরী হয়েছে। এতে ছেলে-মেয়েরা সহশিক্ষার অংশ হিসেবে, পিটি- প্যারেড, শারীরিক কসরত ও খেলাধুলা করতে পারছেনা। তবে সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের পুরাতন বিল্ডিং ও বিএডিসির একটি পরিত্যক্ত ভবন ভেঙ্গে স্কুলের পিছন দিয়ে একটি বিকল্প সড়ক তৈরি করে শিশুদের নিরাপদ করা যেতে পারে বলেও তিনি জানান।
উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার মোশারফ হোসাইন শিশুদের সমস্যা ও ঝুঁকির কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা বিষয়টি আগেই অবগত হয়েছি। এ ব্যাপারে আমরা উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবগত করবো এবং বিষয়টি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে জানানোও হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই আমাদের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ থাকুক। এর জন্য তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা কামনা করেন।
এব্যাপারে শ্রীবরদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডিএম শহিদুল ইসলাম বলেন, এ সড়ক দিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ চলাচল করে এবং ম্যাপে সড়ক থাকায় আমরা চাইলেও সেই সময় সড়ক তৈরিতে বাঁধা দিতে পারিনি। তবে ওই সড়ক পাকাকরণের ফলে শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচ্ছে বলেও তিনি স্বীকার করেন। তবে পুরাতন বিল্ডিং ভেঙ্গে মাঠ বড় করে মাঠের মাঝখান থেকে সড়কটি সরাতে সহযোগীতার কথাও তিনি বলেন। তিনি আরও বলেন, সরকারী স্থাপনা ভাঙ্গার একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন রয়েছে। আমরা বিষয়টি আলোচনা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহন করবো।