আমাদের চিরচেনা পৃথিবী সাম্প্রতিক সময়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বহুমাত্রিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। গনস্বাস্থ্য ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে করোনা মহামারী যে প্রকট সংকট তৈরি করেছে তার রেশ এখনো কাটেনি। এ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে দেড় কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মৃতের সংখ্যা এখনো নিয়মিতভাবে বেড়ে যাচ্ছে। করোনার কারণে সমাজে বৈষম্য ও অসমতা যেন নতুন মাত্রা লাভ করেছে। ধনী গরীবের সম্পদের ব্যবধান অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাজ্যের মোট সম্পদের এক তৃতীয়াংশের মালিকানা রয়েছে মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে। ২০২১ সালে ফর্বস এর বার্ষিক বিলিওনারের তালিকায় রেকর্ড সংখ্যক ২,৭৫৫ জন বিলিওনারের নাম পাওয়া গেছে। তাদের কাছে মোট ১৩.১ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ রয়েছে, এক বছর আগেও যা ছিল ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটটাও বিগত কয়েক দশক জুড়ে গোটা বিশ্ববাসীকে ভোগাচ্ছে। বৈজ্ঞানিকরা সতর্ক করে দিয়ে জানিয়েছেন, পৃথিবীকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বসবাসের উপযোগী রাখতে হলে ২১০০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে যেকোনো মূল্যে ১.৫সেলসিয়াসের মধ্যে থাকতেই হবে। একই দৃষ্টিভঙ্গি গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সর্বশেষ জলবায়ু সম্মেলনেও প্রতিফলিত হয়েছে। এই দুটো প্রকট সংকটের বাইরে, ইউরোপে আবারও যুদ্ধের প্রত্যাবর্তন হয়েছে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের মাধ্যমে। এ যুদ্ধের বদৌলতে আবারও পৃথিবী নতুন করে মৃত্যু, ধ্বংস আর অগনিত বেসামরিক নাগরিকদের বাস্তুচু্যৃতি প্রত্যক্ষ করছে।
প্রতিকূল সময়ে অপরকে সহযোগিতা: জনগণের কল্যাণে কাজ করার দায়বদ্ধতা প্রতিটি সরকারেরই রয়েছে। ধনী ও গরিবের বৈষম্য দূরীকরণেও এর কোনো বিকল্প নেই। যদিও অনেক রাজনীতিবীদই এই প্রাথমিক কাজটা করতেও এখন ব্যর্থ হচ্ছেন। উন্নত গনতান্ত্রিক দেশগুলোতে অন্তত কথা বলা এবং ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে জনগন এখনো কিছুটা সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো, যার অধিকাংশই এখন স্বৈরাচারী শাসক বা গনতন্ত্রের ছদ্মাবরণে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকের অধীনে রয়েছে- সেখানে জনগন অনেক বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে এবং শাসকদের মাধ্যমেও অনেকটা কোনঠাসা হয়ে আছে।
প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন থাকা, আর্থ-সামাজিকভাবে সতর্ক হওয়া এবং নিজেদের অধিকার পূরণে সক্রিয় থাকা। সমাজে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত হলে এবং সকলের জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে মানুষঅর্থবহ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। তবে, এই সুবিচার ও সামাজিক সমতা-ত্যাগ স্বীকার না করে কিংবা কষ্ট না করে পাওয়া যায় না। ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, মানুষকে বরাবরই তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করতে হয়েছে।
প্রতিটি দেশের উন্নয়নের জন্য জনগনের শক্তির উত্থান অপরিহার্য। উন্নত বা উন্নয়নশীল- সবদেশেই নাগরিকদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যে:
১. স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কার্যক্রমে তারা সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হবে যাতে সমাজটি বিকশিত হয় এবং সকলের জন্য উপযোগী একটি সমাজ বিনির্মাণ করা সম্ভব হয়।
২. জনগনকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অর্থাৎ জনগনের সেবকদের ওপর সবসময় নজর রাখতে হবে। যদি নেতারা জনগনের প্রত্যাশিত সেবা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে নেতাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্যেও জনগনকে প্রয়াস চালাতে হবে।
পেশা, ধর্ম, গোত্র, জাতীয়তা- প্রভৃতির আলোকে মানুষের অনেকগুলো পরিচয় হতে পারে। যে সমাজ নানা পরিচয়ের সব মানুষকে একসাথে ধারণ করতে পারে সেখানেই ইতিবাচক মূল্যবোধের চাষাবাদ হয় এবং জাতীয় অগ্রগতিও সুনিশ্চিত হয়। এর প্রমাণ সাম্প্রতিককরোনা অতিমারীতে আমরা পেয়েছি কারণ সেই সময়ে একদম সাধারণ মানুষকেও মানবতার কল্যাণে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে দেখা গেছে।
সফল সমাজের বৈশিষ্ট্য:সফল সমাজ মানেই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ, যেখানে বহুমাত্রিক ও বহু পরিচয়ের লোকজন একসাথে বাস করে। এমন একটি সমাজ যেখানে আইনসম্মতভাবেই সকল নাগরিকের জন্য একই ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। সফল সমাজ সবার জন্যই উম্মুক্ত হয়; সেখানে সবাই একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকে।
সফল সমাজ কাঠামোর প্রথম উপকরণটি হলো পারিবারিক মূল্যবোধ। যুব প্রজন্মকে অবশ্যই নৈতিকসম্মতভাবে বড়ো করতে হবে। সন্তানদেরকে পরিবারের মাঝে রেখে সামাজিক একটি জীবন যাপনের সুযোগ দেয়া কিংবা তাদেরকে ভালো মানের শিক্ষা প্রদান করা, সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা কিংবা ইতিবাচক চরিত্র গঠন করার মতো কাজগুলোর দায় শুধু পিতামাতার ওপরই নয় বরং গোটা সমাজের ওপরই বর্তায়।
দ্বিতীয় উপকরণটি হলো সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষগুলোর প্রতি বাড়তি যতœ নেয়া। এই বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বাসের লালন করা জরুরি। যদি কোনো সমাজে বয়স্ক লোকদের কেয়ার হোমসে বা বৃদ্ধ নিবাসে রাখা হয় কিংবা তারা যদি সন্তানদের কাছে অবহেলিত হন, তাহলে সেই সমাজের অবস্থা খুবই শোচনীয় বলেই প্রতীয়মাণ হয়। বয়স্ক লোকেরা যেহেতু এক জীবনে আমাদের জন্যই কষ্ট করেছেন তাই তাদের সম্মান নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে যারা বৃদ্ধ হবেন তাদেরও সম্মান পাওয়ার পথ খুলে যায়।
সফল সমাজের তৃতীয় মানদন্ডটি হলো এই সমাজে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থদের যতœ নেয়া হবে। তাদেরকে সাধ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করা হবে। এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য তার এনএইচএস সেবার কল্যাণে অনেক উন্নত দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। তবে, যে কোনো গনমুখী সেবাকে কার্যকর রাখতে হলে চাই প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা এবং নিরবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক সমর্থন।
সফল সমাজের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে পরিবেশকে সুরক্ষা করা হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলায় তৎপরতা চলমান থাকবে।ইসলাম আমাদের শেখায় যে, মানুষ এই পৃথিবীতে খলিফা হিসেবে এসেছে। খলিফা শুধু সম্মানজনক উপাধি নয়, বরং দায়িত্ববোধেরও বিষয়। তাই সকল মানুষকে বিশেষ করে নেতৃবৃন্দকে নিজেদের অবস্থানের আলোকে পরিবেশের সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
৫ম বৈশিষ্ট্য হলো সামাজিক ও জনজীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অনুশীলণ বৃদ্ধি করা। বাইবেল যেমন প্রতিবেশিদের যতœ নিতে বলে, ইসলামও মুসলিমদের একই শিক্ষা দেয়। মানব সমাজে বর্তমানে এত বেশি সংকটের জন্ম হচ্ছে শুধুমাত্র স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাধারার কারণেই। পাশাপাশি, নানা রকমের ভয় ও আতংক, অজ্ঞতা ও মানুষকে অবমুল্যায়নের কারণে সমাজের শান্তি ও ভারসাম্য অনেকটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
মুসলিমদের জন্য চ্যালেঞ্জসমূহ:মুসলিমরা এখন অনেকক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে। নিজেদের দেশের শাসন ক্ষমতা কিংবা নাগরিক দায়িত্ব- কোনোটাই বর্তমানে তাদের হাতে নেই। রাজনীতির হিসেব কষলে গোটা মুসলিম বিশ্ব জুড়ে একটি হতাশাজনক ছবিই যেন ভেসে ওঠে। অনেক মুসলিম দেশই স্বৈরাচারী শাসক দ্বারা শাসিত হচ্ছে আর সেখানকার সুশীল সমাজও ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে আছে। ঔপনিবেসিকতা থেকে মুক্তি পাওয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ কিংবা পশ্চিমের মুসলিম সংখ্যালঘু দেশ- সবখানেই এখন সর্বাগ্রে প্রয়োজন হলো জনসেবার সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি উন্নত সমাজ কাঠামো বিনির্মাণে চেষ্টা করা। পাশাপাশি, নৈতিকবোধ সম্পন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উত্থানও কাম্য। আমাদের প্রচুর পরিমাণ সমাজসেবক প্রয়োজন যারা মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে।
একইসাথে মুসলিম প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও মসজিদগুলো উচিত সবাইকে নিয়ে কাজ করার মধ্য দিয়ে একটি মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। দান-সাদাকায় মুসলিমদের যে সক্রিয় ভূমিকা তার ওপর ভিত্তি করেও জন সম্পৃক্ততা ও জনসেবামূলক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করা উচিত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বৃটেনসহ অনেক দেশেই নাইন-এলিভেন পরবর্তী সময়ে মুসলিমদের সাদামাটা নাগরিক কর্মকান্ডকেও নেতিবাচকভাবে চিত্রায়িত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত অনাস্থা ও অবিশ্বাস যেন আমাদের কাউকেই সৎ ও কল্যাণমূলক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে না পারে সেই প্রচেষ্টাও সবসময় অব্যহত থাকা উচিত।
বই পাঠ ও প্রজন্মকে উৎসাহত করা: ৮ম শতকে মুসলিমদের উত্থান শুরু হয়ে পরবর্তী ৬শ বছর পর্যন্ত তা অব্যহত ছিল। মুসলিমদের এই উত্থানের নেপথ্যে ছিল পড়াশুনার প্রতি তাদের অদম্য আকর্ষণ। তৎকালীন সময়ে মুসলিমরা জ্ঞানের জগতে সক্রিয় পদচারণা চালিয়েছিল। তখনো পর্যন্ত বই হাতেই লিখতে ও কপি করতে হতো। অথচ সেই কঠিন সময়েও মুসলিমরা নানাস্থানে বিশেষ করে মসজিদ ও শিক্ষাকেন্দ্রের পাশে পাঠাগার স্থাপন করেছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিখাতে মুসলিমদের উন্নতি ও একের পর এক আবিস্কার ও জ্ঞানের বৈপ্লবিক উত্থানের কারণে মুসলিমরা তখন বিজ্ঞান, চিত্রকলা, চিকিৎসা ও দর্শনসহ সব ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রাখতে সক্ষম হয়। মুসলিমদের এই জ্ঞানের ওপর ভর করেই পরবর্তীতে পশ্চিমা ইউরোপে রেনেসাঁ ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব সংঘটিত হয়।
পরিতাপের বিষয় হলো, ইউরোপীয়ানরা জ্ঞানের সন্ধান পাওয়ার পর নতুন শক্তিতে বলীয়াণ হয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলো তখন সাহসিকতার অভাব, রাজনৈতিক দুর্বলতা আর বিভেদ-বিভাজনের জেরে মুসলিম বিশ্ব ক্রমান্বয়ে দুর্বল ও অকার্যকর হয়ে পড়ছিল। মঙ্গলদের অতর্কিত আক্রমন মুসলিম বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক মেরুদন্ড ভেঙে দেয়। অগনিত জ্ঞান ও পাঠ কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যায়। শতশত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। এই মঙ্গলদের অনেকেই পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে। এর কয়েক বছর পর অটোম্যানদেরও উত্থান হয়। এরপরও মুসলিমরা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকলাঙ্গতা আর সামাজিক-রাজনৈতিক অচলায়তন থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেনি।
বর্তমানে মুসলিমদের সার্বিক অবস্থান ভীষণই নৈরাজ্যকর। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু। সুশাসন নেই বললেই চলে। মানব সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে মুসলিমদের প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতাও কমে এসেছে। নাইন-এলিভেন পরবর্তী সময়ে মুসলিমদের অনেক ঐতিহাসিক ভূখন্ডেই যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক ব্যর্থতাও এখন অনিবার্য বাস্তবতা। মুসলিমদের সোনালী যুগের প্রত্যাবর্তনে হয়তো আরো কিছুটা সময় লাগবে। তবে, আপাতত মুসলিমদের উচিত পরবর্তী প্রজন্মকে, তাদের চিন্তাধারাকে ভালোভাবে গড়ে তোলা। তাদের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস ছড়িয়ে দেয়া এবং চরিত্র সংশোধন করা। তৃণমূল নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসা উচিত। বাড়িতে পিতামাতাকে, স্কুলে শিক্ষকদেরকে এবং মসজিদে ইমামদের সক্রিয় করা উচিত এবং জনসেবামূলক কাজেও তাদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
নাগরিক শক্তি সংহত করা:সমঝদার মুসলিমরা তাদের দুটো প্রধান দায়িত্ব সম্পর্কে বরাবরই সচেতন থাকে। একটি হলো তাদের স্বজাতি তথা কওমের প্রতি দায়িত্ব পালন আর আরেকটি হলো উম্মাহ’র প্রতি দায়িত্ব পালন। এই দুটো দায়িত্ব আবার পরস্পরের পরিপূরক। নানা চ্যালেঞ্জ থাকা স্বত্বেও বৃটেনে আমাদের সুশীল সমাজ এখন অনেকটাই সক্রিয় ও কার্যকর। নানামুখী জনকল্যাণমূল কাজে মুসলিমদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এখন দেখার বিষয় আমরা তৃণমূলের কতটা গভীরে এই জনসম্পৃক্ত মানসিকতা প্রবেশ করাতে পারি এবং অন্যদের সাথেও কতটা ইনসাফ করতে পারি। সোনালী যুগে মুসলিমরা অনেকটা ধর্মীয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই অপরের সেবা করতো। মুসলিমদের এই অসাধারণ মানসিকতার কারণেই নানা চিন্তাধারার মানুষের মাঝে সম্পর্কও তৈরি হয়েছিল।
বর্তমান সময়ে যেভাবে ব্যক্তিতন্ত্রবাদ, ভোগবাদ আর দম্ভ বেড়ে চলেছে, তার মোকাবেলায় মানবিক, সহানুভূতিশীল ও যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে, জাতীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও সেবামুখী মুসলিমদের এখন খুব বেশি প্রয়োজন। নেতার প্রাথমিক দায়িত্ব জনগনের সেবা করা- এ কথাটি কথা ও কাজে আমাদের রাসূল সা. প্রমাণ করে গেছেন। সেবামুখী নেতৃত্ব মানেই হলো, নেতৃত্বের পদের সুবিধা না নেয়া, বিনয়ী হওয়া এবং কোনো রকমের আনুকূল্য পাওয়ার লোভে নয় বরং স্বতস্ফুর্তভাবে সমাজের অভাবী মানুষগুলোকে সাহায্য করা। এই মানসিকতা নিয়ে নেতৃত্ব দিতে পারলে অনেক দুনিয়াবি সমস্যার যেমন সমাধান হয় তেমনি আধ্যাত্মিক পুরস্কারও লাভ করা যায়। একটি জাতি তখনই নিজের পায়ে দাঁড়ায় যখন সেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকে, সুশীল সমাজও সক্রিয় থাকে এবং ধর্মীয় নেতারাও নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় তৎপর থাকে।
উপসংহার:সমাজের সিংহভাগ মানুষ যদি ভালোও হয় তারপরও নাগরিক দায়িত্ববোধের চর্চা না থাকলে সেই সমাজে অনাচার বাড়তেই থাকে। পরিবর্তন এমনিতেই আসেনা। পরিবর্তনের জন্য সচেতন নাগরিকদেরকে সক্রিয় হতে হয়, কন্ঠ উচ্চকিত করতে হয়। মূলধারার মিডিয়ার ওপরও সামাজিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হয় যাতে তারা সঠিক তথ্য সরবরাহ করে, কোনো ব্যক্তি, রাজনৈতিক দলকে অন্ধভাবে সমর্থন না করে। একটি সমাজের সফল হওয়ার প্রধান উপায় হলো এর বহুমাত্রিকতা। সমাজে ভয়, কুসংস্কার কিংবা বর্ণবিদ্বেষের লক্ষন দেখা দিলে তাৎক্ষনিকভাবে তা প্রতিহত করতে হবে। সমাজ ও প্রশাসনের তরফ থেকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো সমন্বিত অবস্থান নেয়ার মধ্য দিয়ে সর্বস্তরে সমতাকে প্রতিষ্ঠিত করা। সমাজের প্রতিটি খাতে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজকে উন্নত করার চেষ্টা আমাদের চালাতে হবে। অপরের সুখ দু:খের সাথী হতে হবে। সাধ্যনুযায়ী অপরকে সাহায্য করতে হবে। সক্রিয় ও সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
“সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।” (সুরা আল মায়েদাহ: আয়াত ২) লেখক: ড. মুহাম্মাদ আব্দুল বারী একজন শিক্ষাবীদ, প্যারেন্টিং বিশেষজ্ঞ এবং লেখক।