সংবিধান সংস্কারে এই তিনটি দলের দেয়া মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মোট ৭০টি প্রস্তাবের মধ্যে সংবিধানের ১৫০ (২) অনুচ্ছেদ বাতিল করাসহ মাত্র চারটি প্রস্তাবে তিনটি দলের দেয়া মতামতে মিল রয়েছে। মহান স্বাধীনতা সম্পর্কে সংবিধানে সন্নিবেশিত ‘আওয়ামী বয়ান’ বিলুপ্তে সম্পূর্ণ একমত বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি। সংবিধান সংস্কার কমিশনের দেয়া প্রস্তাবনাগুলোর ওপর এই তিন দলের মতামত পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
কমিশনের স্প্রেডশিটের সর্বশেষ ‘বিবিধ’ কলামে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানতে চেয়ে বলা হয়েছে- ‘সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০(২) বিলুপ্ত, এবং এ সংশ্লিষ্ট ৫ম, ৬ষ্ঠ এবং ৭ম তফসিল সংবিধানে না রাখা।’ এর উত্তরে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি ‘একমত’ পোষণ করেছে।
বর্তমান সংবিধানের ১৫০ (২) এ বলা হয়েছে- ‘১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখ হইতে ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে এই সংবিধান প্রবর্তন হইবার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ষষ্ঠ তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম এবং সপ্তম তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হইল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক ভাষণ ও দলিল।’ বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি এই অনুচ্ছেদের বিলুপ্তিতে একমত জানিয়েছে।
সংবিধান সংস্কারে এই তিনটি দলের দেয়া মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মোট ৭০টি প্রস্তাবের মধ্যে সংবিধানের ১৫০ (২) অনুচ্ছেদ বাতিল করাসহ মাত্র চারটি প্রস্তাবে তিনটি দলের দেয়া মতামতে মিল রয়েছে। এর মধ্যে ‘‘বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬ (২) নি¤েœাক্তভাবে ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবেন হিসেবে ‘প্রতিপ্রস্থাপন করা’, এ বিষয়ে তিনটি দলই ‘একমত’ অপশনে টিক চিহ্ন দিয়েছে। স্প্রেডশিটে দেয়া ‘সংবিধান সংশোধনী’ ও ‘নির্বাহী বিভাগ’ এই দুইটি বিষয় সংক্রান্ত কলামে দুইটি একই ধরনের প্রস্তাবে- ‘রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচারণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে। নি¤œকক্ষ অভিশংসন প্রস্তাবটি পাস করার পর তা উচ্চকক্ষে যাবে এবং সেখানে শুনানির মাধ্যমে অভিসংশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে’ তিনটি দল ‘একমত’ অপশনে টিক দিয়েছে।
কমিশনের ৭০টি প্রস্তাবের মধ্যে তিনটি দলের দেয়া মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিএনপি ১২টি প্রস্তাবে, জামায়াতে ইসলামী ৩১টি প্রস্তাবে এবং এনসিপি ৪৫টি প্রস্তাবে ‘একমত’ হয়েছে।
জানা গেছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনবে। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যেসব প্রস্তাবে একমত হয়েছে, সেগুলো অগ্রাধিকার দেয়া হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যেসব প্রস্তাবে নীতিগতভাবে একমত কিংবা আংশিক একমত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। যদি আলোচনার মাধ্যমে মতৈক্যে পৌঁছা সম্ভব হয়, সে ক্ষেত্রে কমিশন প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
কমিশন থেকে মোট ১৬৬টি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ ৭০টি, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে সুপারিশ ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত সুপারিশ ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত সুপারিশ ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত সুপারিশ ২০টি।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশ সংস্কারের জন্য গঠিত ছয়টি কমিশন গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদনগুলো সরকারের কাছে জমা দেয়।
আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এই ছয়টি কমিশনের সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সাথে আলোচনা এবং পদক্ষেপ সুপারিশের উদ্দেশ্যে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি এবং আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়।
কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন- বদিউল আলম মজুমদার, আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক এবং ইফতেখারুজ্জামান। এই কমিশনের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ছয় মাস।
জানা গেছে, রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতৈক্যকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এসব নিয়ে প্রতিটি দলের সাথে একাধিকবার আলোচনায় বসতে পারে কমিশন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ কিছু দিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন সম্ভব। বাংলাদেশে এর আগেও অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। নির্বাচিত সংসদ পরবর্তীতে সেটির অনুমোদন দিয়েছে।’ তবে বিএনপি সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবনাগুলোর বেশ কিছু মতামতে জাতীয় সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের কথা উল্লেখ করেছে ।-উৎস: দৈনিক নয়াদিগন্ত