সয়াল্যান্ড খ্যাত জেলা লক্ষ্মীপুরে ইলিশের পর ঐতিহ্যবাহী আরও একটি খাবার হলো কাঁচা দুধের তৈরি মহিষের টক দই। সুস্বাদু ও জনপ্রিয়তায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর বেশ সুনাম রয়েছে। যুগ যুগ ধরে সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সবার পছন্দের তালিকায় অন্যতম একটি খাবার এটি। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে উৎপাদন কম হলেও দেশব্যাপী এ দইয়ের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। স্থানীয়ভাবে পরিচিত মহিষা দই দৈনিক ১০ টনেরও বেশি উৎপাদিত হয়। আর বছরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টন মহিষের দই এ জেলায় বেচাকেনা হয়। এ দই উৎপাদনের জন্য প্রায় ৪ হাজার টন দুধ প্রয়োজন। জেলার পশ্চিম ও দক্ষিণের মেঘনা নদীর দ্বীপ চরগুলোর মহিষের বাথান (চারণভূমি) থেকে এ দুধ আসে। বিশেষ করে মেঘারচর, চর আবদুল্লাহ, চর শামছুদ্দিন, কানিবগারচর ও চর কাছিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার বাথান থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। উৎপাদিত এ দই বিক্রি করে বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকা আয় হয় সংশ্লিষ্টদের। দই বিক্রেতা, মহিষের বাথান মালিক ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জেলা শহরের বাসিন্দা চাকরিজীবী আবদুল কাদের মাসুদ, হেলাল উদ্দিন, ব্যবসায়ী রিয়াজ আহমেদ, জামাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুযোগ পেলেই তারা মহিষের দই খাওয়ার জন্য লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট, কাঞ্চনিবাজার, রায়পুরের মোল্লার হাট ও হাজিমারা ছুটে যান। শুধু নিজেরাই নন, বাড়ির জন্যও দই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তারা। দই বিক্রেতা সুমন হোসেন জানান, তিনি জেলার ৫টি উপজেলাতেই পাইকারিভাবে দই বিক্রি করেন। গরুর দুধের দইয়ের চেয়ে মহিষা দই বেশ জনপ্রিয়। জেলার ছোট-বড় প্রায় ৪০টি বাজারে দোকানিরা দই বিক্রি করেন। এর মধ্যে রামগতি উপজেলার মহিষা দই পুরো জেলায় জনপ্রিয়। বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই কথা হয়। এ জেলায় দিনে প্রায় ১০ টনেরও বেশি দই বিক্রি হয়। ১৫০-২০০ টাকা কেজি ধরে দিনে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকার দই বিক্রি করে থাকেন দোকানিরা। এতে বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার দই বিক্রি হয় জেলাতে। দই তৈরির বিষয়ে সুমন হোসেন জানান, চর থেকে দুধ আনার পর কাঁচা দুধ সরাসরি ১ থেকে ২ কেজি ধারণকৃত এক ধরনের পাত্রে ঢালা হয়। পাত্রগুলোকে টালি বলা হয়। টালিতে কাঁচা দুধ রাখার ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর দুধ জমে দধি হয়। প্রতি লিটার দুধে ৯৫০ গ্রাম দধি হয়। এ দধি ফ্রিজিং ছাড়া এক সপ্তাহ পর্যন্ত ভালো থাকে। দধি বসানোর টালিগুলো পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুর থেকে আনা হয়। বর্তমানে সাইজ ভেদে প্রতিটি টালির দাম ১৬ থেকে ২০ টাকা। মহিষা দধি থেকে মাখন, ঘি ও ঘোল বানানো গেলেও লক্ষ্মীপুরে তা তৈরি করা হয় না। দুধ বিক্রেতা আবুল কাশেমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহিষের দুধের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু আগের তুলনায় এখন মহিষের সংখ্যা অনেক কম। মহিষ পালনে মানুষ এখন কম আগ্রহ দেখাচ্ছে। যত বেশি মহিষ পালন হবে দুধও তত বেশি উৎপাদিত হবে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার চরাঞ্চলেই মহিষের উৎপাদন বেশি। মেঘনা নদীর ১২টি দ্বীপ চর মূল ভূখ-ে প্রায় ২০ হাজার মহিষ পালন করা হয়। এর মধ্যে রামগতি উপজেলার বিভিন্ন দ্বীপ চরে ৬ হাজার ৩০০, কমলনগরে ৬ হাজার, সদর উপজেলায় ৫ হাজার ৭০০ এবং রায়পুরে ১ হাজার ২০০সহ জেলায় ২০ হাজার মহিষ পালন করা হয়। তবে স্থানীয় কয়েকজন বাথান মালিক জানান, প্রকৃত পক্ষে সরকারি হিসেবের দ্বিগুণ মহিষ পালন করা হয়। কাদের নামে একজন বাথানি জানান, প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাদের তারা সঠিক হিসেব দেন না। তবে মহিষ মালিক শাহজাহান মাঝি, আবদুস সামাদ ও বাদশা মিয়াসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ৫০ হাজার মহিষ বিভিন্ন চরে পালন করা হয়। এসব মহিষ দুধ ও মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যেই পালন করেন মালিকরা। কমলনগরের তোরাবগঞ্জ বাজারের দই বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন প্রায় ১৭ বছর এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি জানান, বিয়ের অনুষ্ঠানে দই বাধ্যতামূলক। খাবারের শেষ মুহূর্তে ওয়ানটাইম কাপে ২৫০ গ্রাম দই থাকবে। অনেকেই পাতিল হিসেবেও আমাদেরকে অর্ডার করেন। এসব অনুষ্ঠানে গরুর দই অর্ডার খুব কম পাওয়া যায়। তিনি দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০ কেজি দই বিক্রি করেন। দুধের দামের সঙ্গে দইয়ের দাম কম-বেশি হয়। জেলা শহরের এক ডেকোরেটরের প্রধান বাবুর্চি আবুল কালাম বলেন, মহিষের দই কাঁচা দুধে তৈরি করতে হয়। খাবার শেষে এ দই খেতে খুব ভালো লাগে। গরুর দুধের বা গুঁড়ো দুধের মিষ্টি দইয়ের চাহিদা কম। রামগতি, কমলনগর, সদর ও রায়পুরে বিয়ের অনুষ্ঠানে মেহেমানদের জন্য টক দই থাকতেই হবে বাথানের মালিক রামগতি উপজেলার শাখাওয়াত হোসেন মিয়া ও সদরের আবদুল আজিজ জানান, চরাঞ্চলে মানুষের বসবাস বেড়েছে। এ ছাড়া চাষাবাদও বেড়েছে। এতে মহিষের চারণভূমি কমছে। এ জন্য অনেকেই মহিষ পালন ছেড়ে দিচ্ছেন। লক্ষ্মীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. জোবায়ের হোসেন বলেন, মহিষের দই অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু। এ জেলায় প্রতিদিন ১০ টনের বেশি মহিষের দধি উৎপাদন হচ্ছে। দিন দিন এর চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে মহিষ পালন ও দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা খামারি ও বাথান মালিকদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছি।