সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৩০ পূর্বাহ্ন

শ্রীলংকার সংকট অচিরেই দূর হবে কি ?

ড. মাহবুব উল্লাহ্
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০২২

গত কয়েক দিনে শ্রীলংকা পরিস্থিতি নতুন রূপ ধারণ করেছে। দেশটিতে গত কয়েক মাসে বিশাল এক পরিবর্তন হয়ে গেছে অথবা বলা যায় হওয়ার পথে। যেসব কারণে দেশটি সংকটের কবলে পড়েছে সেসব দেখে বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনীতিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, বাংলাদেশেও শ্রীলংকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে শ্রীলংকার পরিস্থিতির তুলনা হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে শ্রীলংকার মতো ঘটনাবলি না ঘটে, ততক্ষণ পর্যন্ত শাসক দলের সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর বিতর্ক চলতেই থাকবে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ নিয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু শ্রীলংকার পরিস্থিতিটা ভালো করে বোঝা দরকার এবং এ নিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ করা জরুরি। শ্রীলংকা পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক সপ্তাহ আগে এই কলামেই আমি লিখেছি। সেই লেখায় বলা হয়েছে, শ্রীলংকার সংকটটি প্রধানত অর্থনৈতিক। শ্রীলংকা পর্যটন থেকে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করত। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, শ্রীলংকার একটি নামকরা হোটেলে সন্ত্রাসবাদীরা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। এ বিস্ফোরণে প্রায় ২০০ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে। ফলে পর্যটকরা ভাবতে শুরু করে পর্যটনের জন্য শ্রীলংকা নিরাপদ গন্তব্য নয়। শ্রীলংকায় পর্যটকদের যাওয়া আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে পরিস্থিতিতে কোনো রকম পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।
সন্ত্রাসী হামলার পাশাপাশি এলো করোনা মহামারির হামলা। করোনা মহামারিও শ্রীলংকার অর্থনীতি এবং নাগরিকদের মানসিক স্বস্তির ওপর বিরাট আঘাত হেনেছে। শ্রীলংকার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে কাগজ আমদানি করতে না পারার ফলে স্কুল-কলেজে পরীক্ষা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। শুধু কাগজই নয়, বিদেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। শ্রীলংকায় খাদ্য সংকটও আছে। রাজাপাকসের সরকার দেশে বায়োফার্মিং চালু করতে যাওয়ায় খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১০-১৫ শতাংশ কমে গেছে। দোকানে পাউরুটি পাওয়া যাচ্ছে না। নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন চলছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে। শ্রীলংকার প্রধান রপ্তানি ফসল চায়ের উৎপাদনও ভয়াবহভাবে হ্রাস পেয়েছে। আজ শ্রীলংকায় যে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তার মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। অনেক কিছু নেই-এর দেশ শ্রীলংকাকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। লাগাতার জনবিক্ষোভে যে কোনো প্রয়োজনীয় নীতি বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। রনিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
গত সপ্তাহে ‘চলো চলো কলম্বো চলো’ স্লোগান দিয়ে রাজধানীর বাইরের এলাকা থেকে শতসহস্র বিক্ষোভকারী বাস বোঝাই করে কলম্বো এসে পৌঁছেছে। তারা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে হামলা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনেও হামলা হয়েছে। এসব বিক্ষোভ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সরকারি বাসভবনে হামলা চলাকালে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে কয়েক লাখ সিংহলি মুদ্রা পাওয়া গেছে। এই মুদ্রার মধ্যে ডলার ছিল না। পর্যবেক্ষকরা অর্থ উদ্ধারের ঘটনাকে আমলে নিচ্ছেন না। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে এখন কোথায় অবস্থান করছেন, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে নৌবাহিনী তার দৈহিক নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা বোঝা যায়। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে বলে গুজব উঠেছিল। কিন্তু ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সেদেশে কোনো শরণার্থী যায়নি।
অবশ্য শোনা যাচ্ছে, গোতাবায়ে মালদ্বীপে পালিয়ে গেছেন। শ্রীলংকার নেতৃত্ব ভুলভ্রান্তি করে থাকতে পারে, কিন্তু তারা আত্মমর্যাদাবোধে সচেতন। শ্রীলংকা ভূ-রাজনৈতিকভাবে একটি স্পর্শকাতর এলাকার দেশ। শ্রীলংকার নেতৃত্ব এমন কোনো আচরণ করতে চাইবেন না, যাতে তারা বিশেষ কোনো দেশের স্বার্থসিদ্ধি করছেন বলে প্রতীয়মান হয়। শ্রীলংকায় যে আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলনে দৃশ্যত কোনো রাজনৈতিক দলের সংস্রব নেই। বলা হচ্ছে, আন্দোলনটি একান্তভাবেই জনতার। রাজনৈতিক আলোচনায় সাধারণ মানুষের ভূমিকা বড় করে দেখা হয়। তবে কোনো রাজনৈতিক সংগ্রাম নেতৃত্ব ছাড়া চলতে পারে না। শ্রীলংকার বিরোধীদলীয় রাজনীতিকরা এই আন্দোলনে উৎসাহ দেখিয়েছেন বলে বোঝা যাচ্ছে না। আমার কাছে মনে হয়েছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরে অবস্থানকারী সাধারণ মানুষ যেভাবে দাবি-দাওয়া উত্থাপন করছেন এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কর্মসূচি দিচ্ছেন, তা থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায়-কোনো একটি গোষ্ঠী সু-কৌশলে জনগণকে ব্যবহার করছে। মিসরে যখন তাহরির স্কয়ারে হোসনি মোবারকের দীর্ঘদিনের একনায়কত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছিল, তাতে দেখা গেছে দেশটির কোনো রাজনৈতিক দল এ অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত হয়নি।
মুসলিম ব্রাদারহুড মিসরের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসাবে সক্রিয় ছিল। তারা কৌশলগত কারণে এ আন্দোলনের সামনে এসে দাঁড়ায়নি। কিন্তু তাদের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কৌশলী সম্পর্ক ছিল। আন্দোলন চলাকালে আশ্চর্যজনকভাবে শোনা গিয়েছিল, তাহরির স্কয়ারের অভ্যুত্থানে যেসব তরুণ নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বেশ কয়েক বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল এবং কীভাবে ডিজিটাল গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে আন্দোলন গড়ে তোলা যায় সে ব্যাপারেও তারা মূল্যবান প্রশিক্ষণ দিয়েছিল।
হোসনি মোবারক ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেন। মিসরে একটি নির্বাচন হলো। এই নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের অন্যতম নেতা ড. মোহাম্মদ মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট হলেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারলেন না। তার পরিবর্তে ক্ষমতায় এলেন সেনাপ্রধান আবুল ফাত্তাহ সিসি। প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হলো। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগের মূল বিষয়টি ছিল ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামীদের বৈষয়িক সাহায্য প্রদান। মুরসি কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেন। আবুল ফাত্তাহ সিসি হয়তো হোসনি মোবারকের মতো দীর্ঘদিনের জন্য মিসরের শাসনক্ষমতায় বহাল থাকবেন। শ্রীলংকায় জনতার নামে এবং জনতার দ্বারা যে আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে, সেই আন্দোলন-সংগ্রামের অচিহ্নিত নেতৃত্ব যদি কোনোভাবে কোনো বৈদেশিক শক্তির ছত্রছায়ায় থাকে, তাহলে শ্রীলংকার জনগণের সংকট মোচন হবে না। আমরা আশা করব, শ্রীলংকার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য যাদের দায়ভার আছে, তাদের বিচার জনগণ করবে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে। শ্রীলংকার রাজনৈতিক দলগুলো একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনে সম্মত হয়েছে। সেই সরকারে রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন দলের প্রধান কুশীলবরা হয়তো স্থান পাবেন না। কিন্তু এ দলের চিন্তাভাবনার সঙ্গে শ্রীলংকার কট্টরপন্থি বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের বন্ধন খুব মজবুত। আশা করা যায়, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে শ্রীলংকার সংসদের বৈঠক বসবে। সে বৈঠকে সংকটকালীন নেতৃত্বের নির্বাচন হবে। এই নেতৃত্বের কাজ হবে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। শ্রীলংকার সামরিক বাহিনী এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ অবস্থানেই রয়েছে। তারা আন্দোলনকারী জনতার ওপর গুলি চালাতে রাজি নয়। দেশের এই কঠিন সংকটে সামরিক বাহিনীর ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আশা করা যায়, জাতীয় দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলো গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। শ্রীলংকার নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ধীরেসুস্থে পা ফেলছে।
অতীতে রাজীব গান্ধীর শাসনামলে ভারত শ্রীলংকায় ইন্ডিয়ান পিস কিপিং ফোর্স পাঠিয়েছিল। তারা শ্রীলংকায় এক ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতের সামরিক বাহিনীর অনেক সৈন্য নিহত হয়। রাজীব গান্ধী নিজেও তামিল বিদ্রোহীদের হাতে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। এ কারণে ভারত অভিজ্ঞতার নিরিখে পদক্ষেপ ফেলছে। তবে দিল্লি শ্রীলংকার জনগণকে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে। এ মুহূর্তে শ্রীলংকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কূটনৈতিকভাবে প্রাধান্য পাচ্ছে। আইএমএফের বেইল আউট প্রোগ্রাম নিয়ে কথা চলছে। সংকটটি যেহেতু অর্থনীতি থেকে উৎসারিত, সেহেতু আইএমএফের বেইল আউট প্রোগ্রামটি খুবই প্রাসঙ্গিক। আইএমএফের কাছ থেকে যে সহায়তা আসবে তার পরিমাণ ও শর্ত নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভূমিকা থাকবে। শ্রীলংকার ভৌগোলিক অবস্থান দেশটির জন্য একদিকে বিশাল সম্পদ এবং অন্যদিকে বিশাল বিপদও বটে। লেখক: ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com