আমি মার্কসিস্ট ছিলাম। এ বিশ্বাস থেকে সরে আসার পিছনে সামগ্রিকভাবে ধর্মগ্রন্থই যে মূল কারণ তা আমি বলবো না। তবে ধর্মগ্রন্থ একটা বিরাট ব্যাপার ছিলো। আমি রক্ষণশীল ধর্মের পরিবার থেকে এসেছি। খুব ছোট সময়ে আমার মধ্যে ধর্ম-প্রবণতা ছিলো। তবে ব্যাপারটা সহসাই ঘটেনি। পড়াশুনার মধ্য দিয়েই ঘটেছে। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে জন্মেছি। এশহরে তৎকালীন কম্যুনিস্টদের একটা লাইব্রেরি ছিলো ‘লালমোহন পাঠাগার’,সেই পাঠাগারেই আমি বস্তুতান্ত্রিক জগৎ সম্পর্কে একটা ধর্ম-দৃষ্টিভঙ্গীর বাইরেও যে একটা অন্য দৃষ্টিভঙ্গী আছে সেটার সাথে পরিচিত হই। তখন আমার বয়স কম ছিলো।
ক্লাস এইট নাইনে পড়ি। কবিতা লিখতে শুরু করি ক্লাস সেভেন থেকে। কবি হিসেবে আমি কখনো খুব সিরিয়াসলি আমার সমাজতান্ত্রিক ধারণা কাজে লাগাতে পেরেছি তা আমি বলবো না। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসের প্রতিফলন খানিকটা হয়েছে, সোনালি কাবিন এবং আমার প্রথম দিককার কবিতা। রোমান্টিক চিন্তা চেতনার মধ্য দিয়েই ঘটেছে। আমি কবিতা করে তোলার চেষ্টা করেছি। যদিও আমাদের পরিবার ধর্মীয় ও রক্ষণশীল, তবে বাবা-চাচারা কাব্যচর্চা সঙ্গীত চর্চা তাদেও যৌবন কালে শুরু করেছিলেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় বক্তৃতা করতে গেলে ফার্সি বয়াত আবৃত্তি করতেন। তাদের নিকট থেকেই কাব্যপাঠের যে রীতি থেকে গেছে তা পরবর্তী প্রজন্ম গ্রহণ করেছে। রবীন্দ্রনাথের বই আমি ছোট সময়েই আমার বাড়িতে দেখেছি এবং যখন নজরুলকে নিয়ে বাংলায় হইচই পড়ে গেলো তখন নজরুলের অগ্নিবীণা আমি বাড়িতে দেখেছি।
সওগাত, মাহে নও এসব পত্রিকা আমাদের বাড়িতে আসতো। একটা সাহিত্যের পরিবেশ আমাদের বাড়িতে ছিলো। আমি একজন কবি এবং বিশ্বাসী কবি। আমাকে অনেকে প্রশ্ন করে একজন কবি হয়ে ধর্মের গন্ডিতে বাঁধা পারা পড়লে আন্তর্জাতিকতাবোধ অর্জন করা কি সম্ভব? তাদেও উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য পরিষ্কার- আমার বিশ্বাস এক্ষেত্রে কোন বাঁধা নয়। পৃথিবীতে এখন প্রায় দেড়শত কোটি মুসলমান বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। এটা আন্তর্জাতিকতার বাধা কী করে হতে পারে? এত বড় একটা বিশ্বাস এত বড় করে ছড়িয়ে আছে, এটার একটা মূল্য তোমাকে দিতেই হবে। আমি মনে করি, এটাও এক ধরনের আন্তর্জাতিকতা। আমি একজন মুসলমান, মরক্কোতে একজন মুসলমান আমার মতো, কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন মুসলমান আছে এটাওতো পরস্পরকে জানার একটা আন্তর্জাতিকতা।এরমানে এই নয় আমার আন্তর্জাতিকতাবোধ কেবল মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি মুসলমান আমার লেখায় আমার দেখা মানবসমাজ সভ্যতার কথা আমি লেখেছি। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পবিত্র বাণী । যে কোন ধর্মবর্ণেও মানুষ যদি মাত্র একবার পবিত্র কোরআন শরীফ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করেন তাহলে তিনি উপলদ্ধি করবেন এ গ্রন্থ তার সাথে কথা বলছে, তার কথাই বলছে, এ পবিত্র গ্রন্থ কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠির কল্যাণের জন্য নয় গোটা মানব জাতির জন্য নাযিল করেছেন বিশ্ব জাহানের ¯্রষ্টা আল্লাহতায়ালা। এ গ্রন্থের কোথাও বলা হয়নি “ও আরব। ও বাঙালী।” সব সময় বলা হয়েছে মানব সভ্যতা বা মানব সমাজ। নাস্তিক অবিশ্বাসীদের কথা আমি বলতে পারবো না। তবে একজন বিশ্বাসী মানুষ যখন এ পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করেন, তখন তার কাছে মনে হয়, মনে হবে বাইরে থেকে কেউ বলছে এটা আমার বোধ, অবিশ্বাসীদের মনে নাও হতে পারে। মোটামুটি একজন পড়ুয়া লোক হিসেবে যখন আমি পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠ করেছি মনে হয়েছে কমান্ড-এর মতো বলছে। এটা না কোনো কবিতা না কোনো ভাষাগত আর্টের বই। এটার যেন কেমন একটা আলাদা ভয়েস। যখনই বলা হচ্ছে বাইরে থেকে বলা হচ্ছে, একটু উঁচু জায়গা থেকে বলা হচ্ছে। যেমন,আকাশ সম্পর্কে যখন বলা হচ্ছে তখন বলছে না ‘একটি আকাশ’, যখনই বলা হচ্ছে মনে হচ্ছে যেন অনেকগুলো আকাশ। আমি এই পবিত্র গ্রন্থ পড়েই তো মুসলমান।
এ পবিত্র গ্রন্থটি নিজেই এতটা আন্তর্জাতিক যে কোনো জাতরেখা মানছে না, কোনো দেয়াল স্বীকার করছে না এবং সমস্ত জাতিগত সম্প্রদায়গতদেয়াল ভেঙে ফেলার বিপ্লবী আহবান জানাচ্ছে। মানবসমাজের যে-গতি যে-কালে মানব সমাজ পদচারণা করে চলে আসছে তার মোড়ে মোড়ে পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলো তাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছে। কোনো সময় কোনো রাসুলের উপর একটি পুরো গ্রন্থ এসেছে,আবার কোনো নবীর উপর একটি পুরো ধর্মগ্রন্থ আসেনি, হয়তো কয়েকটা মাত্র নির্দেশ এসেছে।
নবী রাসুল (আঃ)গণ আল্লাহর প্রদর্শিত পন্থায় মানব সমাজকে একটা সভ্যতার দিকে নিয়ে এসেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে মানব জাতির জন্য নাযিল করেছেন সর্বশেষ পবিত্রগ্রন্থ আল কোরআন। এ পবিত্র গ্রন্থ এমন এক সমাজে নাযিল হয়েছে, যেখানে মানুষ একেবারে পশুস্তরে ছিলো।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) অক্ষর-জ্ঞানহীন একজন পবিত্র মানুষ, তাঁর ওপর উপর এটা নাজিল করা হয়েছে পবিত্র কোরআন। শ্রুতিধর হিসেবে তিনি পবিত্র কালাম ধরেছেন এবং তা মানুষের কাছে বিবৃত করেছেন।পবিত্র কোরআনের প্রথম বাণী : “ইকরা বিসমে রাব্বিকা আল্লাযি অর্থাৎ আল্লাহর নামে পাঠ করো।” আর কোনো ধর্মগ্রন্থ পাঠের এমন নির্দেশ দেয়নি। কারণ পাঠের শুরু হয়েছে সামন্ততন্ত্রের ধ্বংসের পর যখন ধনবাদের উত্থান ঘটেছে। কোরআন এই নির্দেশের মাধ্যমে সচেতনভাবে ধনতন্ত্রকে নাকচ করেছে। পবিত্র কোরআন সুদকে হারাম ঘোষণা করেছে। কারণ সুদ ছাড়া ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদ দাঁড়াতে পারে না। ( ২৩ জানুয়ারি ২০১১) লেখক: দেশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ