ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়েবসাইটে ‘ঢাকা নগর কর্তৃপক্ষের ইতিহাস’ অংশের তথ্যমতে, মধ্য যুগে ঢাকা ছিল বিশ্বের ১২তম শ্রেষ্ঠ নগরী। পুঁজিবাদের জনক এডামস স্মিথও নাকি ঢাকা তথা বাংলাকে প্রাচুর্যময় মনে করতেন। তবে ঢাকা বর্তমানে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য নগরীর শীর্ষে। পরিবেশ দূষণে নাকাল নগর জীবন। শুধু পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, এতে অর্থনীতিও ব্যাপক প্রভাবিত হচ্ছে। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক তথ্যমতে, বাংলাদেশ প্রতি বছর মোট জিডিপির ৩-৪ শতাংশ হারায় শুধু পরিবেশ দূষণের ফলে।
পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন মাত্রা থকলেও বায়ুদূষণ নগরবাসী ও চিন্তাশীলদের একটু বিপাকে ফেলেছে বলতেই হয়। গ্রিন পিস সাউথ এশিয়া অ্যান্ড সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২০ সালে প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছে শুধু বায়ুদূষণে। একই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৯৩ হাজার শিশুর অপমৃত্যুর জন্য দায়ী এ বায়ুদূষণ। পরিসংখ্যান হয়তো সবসময় সঠিক অবস্থা তুলে ধরে না। তার পরও নগরবাসী যে বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে চায়, তা সত্য। কিন্তু কীভাবে? পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ইটভাটার কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি কয়লার ব্যবহার ও পুরনো প্রযুক্তি এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। বর্তমানে আমরা যদি এ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি যেমন বায়োগ্যাস ব্যবহার করতে পারি, তবে এ পরিস্থিতির কিছুটা হলেও লাঘব হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বায়োগ্যাস কি ইটভাটায় ব্যবহার করা যাবে? যদি ব্যবহার করা যায়, তাহলে আমাদের কি সে দক্ষতা রয়েছে?
সম্প্রতি ২০১৮ সালে ‘বায়োগ্যাস ক্লে ব্রিক কিল্ন বার্নার’ শিরোনামে আমেরিকান জার্নাল অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে ইথিওপিয়ায়। ওই গবেষণার আলোকে ৩ হাজার ৯৪টি ইট তৈরি করতে সময় লেগেছে দুদিন।
এ পরিমাণ ইট তৈরি করতে চারটি বায়োগ্যাস প্লান্ট ব্যবহূত হয়েছে। প্রতিটি বায়োগ্যাস প্লান্টের আকার ছিল ২৯ দশমিক ৩৮ ঘনমিটার। সেই হিসেবে দুদিনে মোট প্রায় ৬ হাজার ঘনমিটার বায়োগ্যাস ব্যবহূত হয়েছে। গবেষকরা উল্লেখ করেন, যদি বায়োগ্যাস তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পাওয়া যায়, তাহলে এ বায়োগ্যাস প্রযুক্তি ইটভাটাসহ অন্যান্য শিল্পেও বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
এখন প্রশ্ন হলো, দেশে বায়োগ্যাস ইটভাটায় ব্যবহার করা সম্ভব কিনা? যেহেতু পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এ প্রযুক্তির সফল ব্যবহার হয়েছে, সেহেতু এটি বাংলাদেশেও সম্ভব। তবে বাংলাদেশে ইটভাটায় বায়োগ্যাসের ব্যবহার নিয়ে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো প্রকাশিত গবেষণা নেই। উল্লেখ করা প্রয়োজন, দেশে এখনো বায়োগ্যাস গৃহস্থালির জ্বালানি হিসেবেই ব্যবহূত হয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত শিল্পে এ প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য তেমন ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়নি। তবে বিভিন্ন শিল্পে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এ গ্যাসের ব্যবহারের ওপর বিভিন্ন গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। সেসব গবেষণায় বায়োগ্যাসের বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেমনÍ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বায়ো-সিএনজির সম্ভাব্যতা নিয়ে ‘জার্নাল অব রিনিউএবল এনার্জি’ একটি গবেষণা প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়, দেশে বৃহৎ আকারের বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনে অদক্ষতা, অর্থায়ন একটি বড় বাধা। ২০১৩ সালে কৃষি যন্ত্রাংশ যেমনÍশ্যালো টিউবওয়েল, ডিপ টিউবওয়েল যন্ত্রাংশে বায়োগ্যাসের ব্যবহার নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। ওই গবেষণার আলোকে দেশের ডিজেল ও বিদ্যুচ্চালিত ক্ষুদ্র কৃষি যন্ত্রাংশ বায়োগ্যাস দ্বারা প্রতিস্থাপন সম্ভব।
সুতরাং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গবেষাণা দ্বারা এটা প্রমাণ করা সম্ভব, বায়োগ্যাস ইটভাটাসহ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্পে পরিবেশবান্ধব বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। বায়োগ্যাস তৈরির প্রধান কাঁচামাল বিভিন্ন পচনশীল বর্জ্য পদার্থ যেমনÍগোবর, গৃহস্থালির আবর্জনা প্রভৃতি। এ বর্জ্য পদার্থের সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে জানা যায়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ড্রাফট ন্যাশনাল ইনট্রিগ্রেটেড লাইভস্টক ম্যানিউর ম্যানেজমেন্ট-২০১৫ থেকে। ওই প্রকাশনা অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৭৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন ঘনফুট বায়োগ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব, যা ৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন টন কয়লার জ্বালানি মানের সমান। এখানে উল্লেখ করা হয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অদক্ষতার জন্য এ প্রযুক্তির সফল ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। এ মুহূর্তে বর্জ্য ব্যস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা এ খাতের সম্ভাবনাকে আরো বাড়িয়ে দেবে। সংক্ষেপে বললে, বায়োগ্যাসকে শিল্পে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে হলে বর্জ্য পদার্থের যথাযথ ব্যবহার, দক্ষ জনবল তৈরি করা গেলে বায়ুদূষণ রোধ সম্ভব। মো. জোবায়ের হোসেন, গবেষক