শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৯ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে নতুন যুদ্ধ

মাসুম খলিলী :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০২২

বাংলাদেশ এখন একটি ক্রান্তিকাল পার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি দেশের মানুষকে ক্রমেই কঠিন অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংশ্লেষ না থাকলে সঙ্কটের অভ্যন্তরীণ দিক সামাল দেয়া খুব কঠিন হয় না। কিন্তু এর ব্যতিক্রম হলে সামাল দেয়া কঠিন।
বাংলাদেশ এখন তিনটি বড় সঙ্কটের মধ্যে। কৌশলগত সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী শক্তির চাপ, অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচন ও গণতন্ত্র চর্চার সঙ্কট। তিনটি ক্ষেত্রেই বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিষয় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও করা হবে। নির্বাচন ও গণতন্ত্র চর্চার প্রসঙ্গও কম-বেশি আলোচিত। এর সাথে কৌশলগত সম্পর্কের বিশেষ সম্পৃক্ততা আছে।
আজকের আলোচনার বিষয় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের দুই পারে যে বিশেষ নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তা নিয়ে। বাংলাদেশের স্থল সীমান্তের দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার। সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সাথে বিরোধের মীমাংসা হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে। এর বাইরে যে বিরোধ তা দেশটির রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া নিয়ে।
বারবার গণহত্যা ও অন্যান্য জাতিগত নিপীড়নের কারণে এক-তৃতীয়াংশ রোহিঙ্গা আগেই বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হয়েছে। আর প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে সর্বশেষ ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে। আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা আগে থেকে বাংলাদেশের আশ্রয়ে ছিল। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ১৭ লাখ রোহিঙ্গা। এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস এমন এক ভূখ- বা রাজ্যে যেটি শত শত বছর ধরে স্বাধীন দেশ ছিল। পরে সামরিক আক্রমণ চালিয়ে বামাররা এটিকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু তা এই অঞ্চলের রাখাইন রোহিঙ্গা নির্বিশেষে কেউই সেভাবে গ্রহণ করেনি। ব্রিটিশ ভারতে এ নিয়ে কোনো সমস্যা না থাকলেও ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করলে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বামাররা অন্যভাবে দেখতে শুরু করে। ’৮০-এর দশকে এসে সামরিক সরকার আইন করে রোহিঙ্গাদের বার্মার অনাগরিক ঘোষণা করে। আর তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
বেইজিং-দিল্লি সংযোগ: রোহিঙ্গা ও রাখাইন ইস্যুর সাথে চীন ও ভারতের সংযোগ তৈরি হয় কৌশলগত কারণে। নানা কারণে বিশ্ব থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন বার্মায় বিনিয়োগ ও অন্যান্য সম্পর্ক নির্মাণে বেইজিং বিশেষ সুবিধা পায়। মিয়ানমার থেকে খনিজ কাঁচামাল সংগ্রহের নেটওয়ার্ক তৈরি এবং বিদ্যুৎ ও অন্যান্য অবকাঠামোতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে চীন। সেই সাথে চীনের অনেকটা একক প্রতিরক্ষা বাজার হয়ে ওঠে মিয়ানমার। চীন বহু জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত মিয়ানমারের সরকারের পাশাপাশি হান ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন উপজাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথেও সমান্তরাল সম্পর্ক গড়ে তোলে। অন্য দিকে ভারত প্রাথমিকভাবে মিয়ানমারের সামরিক সরকারগুলোর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় স্বস্তি বোধ না করলেও পরে গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্র বাছবিচার না করে বর্মি সরকারের সাথে বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি করে। মিয়ানমারের সরকার এককভাবে চীনা নির্ভরতা থেকে কিছুটা বের হয়ে বহুপক্ষীয় নির্ভরতার সুযোগ গ্রহণ করে। আর ভারতের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে ওঠে বৃহত্তর আসামের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে বঙ্গোপসাগরের সংযোগ তৈরি। এ জন্য মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলের সিটওয়ে থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের পালেটোয়া হয়ে আইজল সরাসরি সংযোগের জন্য কালানদান রিভার প্রকল্প গ্রহণ করে।
অন্য দিকে বেইজিং মালাক্কার ঝুঁকিপূর্ণ প্রণালী পরিহার করে বিকল্প জ্বালানি রোড হিসেবে বেছে নেয় রাখাইন উপকূলের কিউকফিউ থেকে চীনের ইউনান পর্যন্ত সরাসরি জ্বালানি পাইপলাইন স্থাপন প্রকল্প। এ পাইপলাইন ঘিরে অর্থনৈতিক জোন তৈরির পরিকল্পনাও সাজায় বেইজিং। এই পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের পথে। ভারত ও চীন উভয়েই রাখাইন রাজ্যের ওপর দিয়ে অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একসময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। বাংলাদেশের সাথে দুই দেশেরই অতি ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক থাকলেও কোনো দেশই রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরানোর ব্যাপারে বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। অধিকন্তু বৈশ্বিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই দুই দেশ হয় সরাসরি বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, নয়তো ভোট দানে বিরত থেকেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এটি স্পষ্ট হয় যে, দুই দেশেরই প্রধান কৌশলগত মিত্র হলো মিয়ানমার, এর পরে বাংলাদেশের অবস্থান।
রাশিয়ান সংযোগ:গণতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে মিয়ানমারে বারবার সামরিক শাসন এলেও এর প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য তৎপরতা ছিল না সে দেশের জনগণের। এবার সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরের পরিস্থিতি ছিল ব্যতিক্রম। নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী সু চির সরকারকে ২০২১ সালের শুরুর দিকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার পর প্রথমে গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে। জান্তা সরকার সহিংসভাবে এই গণপ্রতিরোধ দমনের চেষ্টা করলে বিচ্ছিন্নতাকামী অঞ্চলগুলোকে কেন্দ্র করে বিকল্প মিলিশিয়া বাহিনী ও নির্বাচিত এমপিদের নিয়ে বেসামরিক বিকল্প জাতীয় ঐক্য সরকার গঠন করা হয়। জনসমর্থিত এই সশস্ত্র প্রতিরোধ জান্তা সরকারকে বড় সঙ্কটে ফেলে। চীন বা ভারতের সহযোগিতা না পেলেও পশ্চিমা দেশগুলোর গোপন সহযোগিতায় বিরোধীদের সামরিক প্রতিরোধ জান্তা সরকারের জন্য ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর চীনা প্রভাবের কাছে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়া ভারত জান্তা সরকারের সাথে রাশিয়ার বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে বলে মনে করা হয়। ভারত এখন রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে তৈরি ব্রহ্ম মিসাইল দিচ্ছে মিয়ানমারকে।
এর আগে চীন বাংলাদেশকে সাবমেরিন দেয়ার পর ভারতও মিয়ানমারকে একটি সাবমেরিন দেয়। ভারত এখন রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে তৈরি সমরাস্ত্রের রফতানি বাজার খুঁজছে। সম্ভবত মিয়ানমার সেই বাজারের অংশ। অবশ্য এর ভিন্ন ব্যাখ্যাও রয়েছে। এই ব্যাখ্যামতে, মিয়ানমারের অভ্যুত্থান এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এই দুই দেশকে আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। রাশিয়া মিয়ানমারের জান্তাকে কূটনৈতিকভাবে এবং অস্ত্র দিয়ে সমর্থন করছে। তারা এখন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক আরো জোরদারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুই দেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াতে সরাসরি ব্যাংকিং ও ফিন্যান্স চ্যানেল তৈরি করছে। এ সময় রাশিয়ান জ্বালানি কিনেছে মিয়ানমার।
সামরিক জান্তা বনাম আরাকান আর্মি: আরাকানে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইনদের সর্বাধিক জনপ্রিয় রাজনৈতিক ও প্রতিরোধ আন্দোলন হলো আরাকান আর্মি। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির বিশ মাস পর, আরাকানে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অবনতি ঘটছে। এখন মনে হচ্ছে চুক্তির উভয় পক্ষই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মি তাদের সামরিক কৌশল ও রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু করেছে। গত ২২ জুনের একটি ঘটনা এ ব্যাপারে বিশেষভাবে হাইলাইট করা হচ্ছে। এ দিন সামরিক রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল- এসএসির সৈন্যরা আরাকানের প্রাচীন রাজধানী এবং সবচেয়ে সঙ্ঘাত-সংবেদনশীল একটি এলাকা ম্রাউক-উ-এর ‘গোয়েন্দা ও তদন্ত বিভাগ’ থেকে তিনজন সরকারি কর্মীকে গ্রেফতার করার প্রতিক্রিয়ায় ৩০ জন স্থানীয় রাখাইনকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনা দু’পক্ষের সমঝোতার ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। এর আগে আরাকান আর্মি প্রতিষ্ঠার ১২তম বার্ষিকীতে জেনারেল তাওয়ান মারত নাইং বলেছেন, ইউএলএ-আরাকান আর্মি চায় না বেসামরিক অমান্য আন্দোলন এবং অন্যান্য সামরিকবিরোধী গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন আরাকানে সক্রিয় হোক। কারণ সংগঠনটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে এর নিজস্ব ‘রাখিতার পথ’ অনুসরণ করে। প্রকৃতপক্ষে, ‘রাখিতার পথ’ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা বা দলিল নেই। কিন্তু ইউএলএ-আরাকান আর্মির নেতৃত্বের সাক্ষাৎকার এবং বক্তৃতার ওপর ভিত্তি করে, এটি ‘চিন্তার এমন একটি উপায় হিসেবে এটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যা শুধুই আরাকানের জনগণের জাতীয় স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে’ তৈরি। এই দর্শনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, ইউএলএ-আরাকান আর্মির নেতৃত্ব এসএসির অভ্যুত্থানের পরে আরাকানের রাজনীতিকে নতুনভাবে গঠন করতে শুরু করে। সেই সময়, তারা মনে করেছিল, যুদ্ধবিরতি অনুসরণ করে তাদের কৌশল আরো সামনে এগিয়ে নেয়া যাবে।
কিন্তু জেনারেল তাওয়ান মারত নাইং-এর সাম্প্রতিক বক্তৃতায় একবারেই ভিন্ন সুর শোনা যায়। দুই মাস আগে আরাকান আর্মির প্রতিষ্ঠার ১৩তম বার্ষিকীতে বক্তৃতায় তিনি বলেন: ‘কমরেডগণ, যখন নির্দেশ দেয়া হবে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকুন’।
রোহিঙ্গা সঙ্কট : পুরনো চ্যালেঞ্জ ও নতুন প্রশ্ন: আরাকানের যেকোনো উন্নয়নে রোহিঙ্গা ইস্যুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। গত ২১ জুন, ইউএলএ এক বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পুনরাবৃত্তি এড়াতে জনগণকে সতর্ক করে এবং এ জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষ-এসএসিকে অভিযুক্ত করে। এর মধ্যে রয়েছে মংডু শহরে দুই জাতিগত রাখাইন শিক্ষকের অপহরণ, যাদের এক সপ্তাহ পরে সীমান্তের বাংলাদেশের দিকে ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয় এবং পাউকতাউ শহরে এক তরুণ রোহিঙ্গাকে মারধরের ঘটনা। পরে ইউএলএ-আরাকান আর্মি নেতা জেনারেল তাওয়ান মারত নাইং আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে অপহরণের জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, এটি আরাকানের সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সংহতি এবং আস্থা-নির্মাণের প্রচেষ্টার জন্য একটি গুরুতর ক্ষতি ছিল। বিশেষত যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী তাদের ঘরে ফিরে আসতে চায় তাদের জন্য এটি বিরাট ক্ষতি ডেকে এনেছে। ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রথম রাউন্ডের পর থেকে পরিস্থিতি অবশ্য অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় অংশ আজ বিশ্বাস করে যে, তারা রাখাইন রাজ্যে আরেকটি সহিংসতা ঘটতে দিতে পারে না। যদি ঘটে তবে তাতে শুধু সামরিক জান্তাই উপকৃত হবে। সামরিক জান্তা বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির জন্য ‘বিভক্ত কর এবং শাসন কর’ কৌশল পছন্দ করে।
তবে এটা স্বীকার করা প্রয়োজন যে, রাখাইন রাজ্যে দুই সম্প্রদায়ের পুনর্মিলন সম্পন্ন হয়নি আর আরাকানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের মধ্যে এখনো কোনো সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়নি। যদিও আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করে নেয়ার কথা জানিয়েছে। আরাকানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের সুপারিশমালায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর সাথে সাথে অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিকে আনুষ্ঠানিকীকরণের পরামর্শ দেয়া হয়। সুপারিশগুলোতে এসএসি, ইউএলএ ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক সৃষ্টির ওপর ভিত্তি করে একটি শান্তি ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানানোর কথা বলা হয়। তবে এ ধরনের সংবেদনশীল কর্মসূচি বাস্তবায়নে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। আরাকানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পুনরাবৃত্তি এড়ানোর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সেখানে এখনো অনেক ভিন্নমত বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির ধ্যান-ধারণায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে এবং রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলার জন্য ন্যাশনাল ইউনিটি সরকার এনইউজি একটি নীতি ঘোষণা করেছে, যেখানে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই মতকে ইউএলএ-আরাকান আর্মি তাদের মত বা আরাকানের রাখাইন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার মত হিসেবে বিবেচনা করে না। রোহিঙ্গা ইস্যু পরিচালনায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য এসএসি ও জাতীয় ঐক্য সরকারের নেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকলেও, ইউএলএ-আরাকান আর্মি আরাকান রাজ্যে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থন সৃষ্টিতে অনেক বেশি মনোযোগী। রোহিঙ্গা ও অন্যান্য আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সমাধান প্রশ্নে এসএসি, এনইউজি ও ইউএলএ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। সংক্ষেপে বলা যায়, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে বিভিন্ন কুশীলবদের মধ্যে সহযোগিতা এবং প্রতিযোগী স্বার্থের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রয়োজন হবে। কাজটি মোটেও সহজ হবে না।
আরাকানে আরেকটি যুদ্ধের সম্ভাবনা: আরাকানে সশস্ত্র সঙ্ঘাত আবার শুরু হওয়ার সম্ভাবনা এবং এটি কিভাবে ঘটতে পারে তা এই মুহূর্তে অনুমান করা কঠিন। রাজনীতি বাদ দিয়ে, যুদ্ধবিরতিতে উভয় পক্ষকে বিবেচনা করতে হবে এমন অন্যান্য কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। এই কারণে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী যুদ্ধের সাথে নতুন পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস এবং দেশের অন্যান্য এলাকা যেখানে যুদ্ধবিরতি নেই এমন অংশে আরাকানের বিশেষ চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে অন্যান্য সামরিক বিরোধী আন্দোলনকে সমন্বয় করা খুব কঠিন। মোট কথা, সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং ইউএলএ-আরাকান আর্মি উভয় পক্ষের নেতাই মনে করতে পারেন যে, এই সময়ে আরাকানে প্রকাশ্য সঙ্ঘাতে ফিরে এসে তাদের লাভের চেয়ে হারানোর আরো বেশি কিছু আছে।
যদি যুদ্ধ শুরু হয়, এইউএলএ-আরাকান আর্মি অন্ততপক্ষে উত্তর রাখাইন রাজ্যের কিছু শহুরে এলাকা এবং মূল যোগাযোগের চ্যানেলগুলোকে ‘জয় ও নিয়ন্ত্রণ’ করার চেষ্টা করবে, আর সামরিক পক্ষ পরিচিত কৌশলগুলোতে ফিরে আসবে। গ্রামীণ ও পার্বত্য এলাকায় আরাকান আর্মির দুর্গের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করতে পারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তবে বর্তমান অচলাবস্থায়, উভয় পক্ষের এই উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের সীমিত ক্ষমতা রয়েছে বলে মনে হয়। এই ধরনের বাস্তবতা ইঙ্গিত দেয় যে, আরাকানে যুদ্ধে প্রত্যাবর্তন শেষ পর্যন্ত মধ্য মিয়ানমারে জান্তা ও জান্তাবিরোধী শক্তি আর আন্তর্জাতিক সীমান্তের আশপাশের বিভিন্ন জাতিগত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পরিবর্তিত সামরিক পেন্ডুলাম দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে। মিয়ানমার বর্তমানে গৃহযুদ্ধের একটি গভীর অবস্থায় রয়েছে, যেখানে আরাকান এখন পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম ছিল। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এর মধ্যে জান্তা এবং আরাকান আর্মির মধ্যে কোনো সশস্ত্র সংঘর্ষ হবে না। ২০১৮-২০-এর মধ্যে তীব্র লড়াইয়ের মতো নতুন যুদ্ধেও অনেক প্রাণ ও সম্পত্তি ধ্বংস হতে পারে। যুদ্ধক্ষেত্রগুলো প্রধান শহর এবং গ্রামগুলোর আরো কাছাকাছি হবে, বিশেষ করে উত্তর রাখাইন রাজ্যে।
আজ পর্যন্ত আরাকান আর্মি বেশ কয়েকটি ফ্রন্ট-লাইন এলাকায় সামরিক ও পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার করছে, যখন সামরিক কর্তৃপক্ষ পানাঘান জাউকটাও ম্রাউক-ইউ টাউনশিপের মতো জাতীয়তাবাদী শক্ত ঘাঁটিতে আরাকান আর্মিকে সমর্থন করার জন্য সন্দেহভাজন বেসামরিক ব্যক্তিদের গ্রেফতার করছে। অতি সম্প্রতি মংডু শহরে ১৪ জন পুলিশ ও সৈন্যকে বন্দী করা হয়েছে। কারেন রাজ্যে ছয়জন সদস্যকে হত্যার ‘প্রতিশোধমূলক’ আক্রমণে আরাকান আর্মির হাতে কয়েকজন নিহত হয়েছে।
অনেকেরই আশঙ্কা যে, সামরিক কর্তৃপক্ষ বা আরাকান আর্মির স্বার্থের সাথে মানানসই হোক বা না হোক, উন্মুক্ত যুদ্ধে ফিরে আসার ঘড়ি এখন টিকটিক করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে, শুধু একটি দেশ আছে যারা আরাকানের অপ্রত্যাশিত ও পরিবর্তনশীল গতিশীলতা পরিচালনা করতে পারে: সেটি হলো চীন। চীনা কর্মকর্তাদের মিয়ানমারের রাজনৈতিক বিভাজনের সব পক্ষের সাথে সম্পর্ক রয়েছে।নতুন সম্ভাবনা ও আশঙ্কা: অস্থির মিয়ানমারে কিছু নতুন সম্ভাবনার বিষয় যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে আশঙ্কার দিকও। চীন সম্ভবত এই অঞ্চলে অস্থির পরিস্থিতির রাশ টেনে ধরতে চায়। তেমন একটি বার্তা চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং ই-এর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের সময় দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সাম্প্রতিক সময় বেইজিং জান্তা সরকারকে একতরফা সমর্থন জোগানোর পরিবর্তে সমঝোতা ও নির্বাচনের কথা বলতে শুরু করেছে। বিরোধী পক্ষের সাথে নতুন যোগাযোগও সৃষ্টি করছে। বেইজিং আসলে এই অঞ্চলে ঠিক কিভাবে শান্তি ও স্থিতি আনতে চায় তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা করা কঠিন।
তবে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন, আরাকান অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন ও সেখানে জান্তা সরকারের কর্তৃত্ব সীমিত করার মাধ্যমে সমাধানের কথা ভাবলে তা ইতিবাচক হতে পারে। এর বিপরীতে আশঙ্কার দিকটি হলো, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সাথে রাশিয়ার সামরিক সংযোগ। বৈশ্বিক গণমাধ্যমের খবর অনুসারে রাশিয়া উন্মুক্তভাবে মিয়ানমারকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। এসইউ-৩০ জঙ্গিবিমান, আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাসহ নানা ধরনের কৌশলগত সমরাস্ত্র এমনকি পারমাণবিক প্রযুক্তি সহায়তা দানেরও খবর পাওয়া যাচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো মিয়ানমারে রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের খবর। এর একটি প্রধান কারণ হতে পারে আরাকানে যুদ্ধবিরতি ভেঙে গিয়ে জান্তা সরকারের সাথে আরাকান আর্মির লড়াই শুরু হওয়ার সম্ভাবনা। এটি বাস্তবে ঘটলে এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের নিরাপত্তার ওপর। বাংলাদেশের সামরিক প্রস্তুতি মিয়ানমারের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে। দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের অদূরে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি ঘটলে সেটি এই অঞ্চলের পুরো ভারসাম্য বাংলাদেশের প্রতিকূলে নিয়ে যেতে পারে। বিশ্ব ফোরামে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিরোধে শুধু রাশিয়াই নয় চীন-ভারতও নেইপিডোকে সমর্থন করেছে। কেবল পশ্চিমা দেশগুলো আর ওআইসি ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। বর্তমান সঙ্কট সময়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা নীতিনির্ধারকদের জন্য এটি গভীর ভাবনার বিষয় হতে পারে। ইমেইল: mrkmmb@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com