গাঢ় রঙের লাল গালিচায় মিশকে আম্বরমিশ্রিত সুবাসিত চাদরের যে কোমলতার আবির্ভাব ও সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয় তাতে অপূর্ব চিত্রের মখমলি পরশে দৃষ্টি স্থির হয়ে রয়; অনুরূপভাবে খুশবুমিশ্রিত মখমলি আবেশে সৃষ্টিকর্তা দু’টি প্রাণের বন্ধনে যে নিয়ামত দান করেছেন নিশ্চয়ই তা দাম্পত্য জীবনের সুখের মাঝে নিহিত। হৃদয়ের এ আবেগ পবিত্রতার অনুভব, মখমলি ভালোবাসার প্রেমময় সুখের জীবন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো- তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য সঙ্গী জোড়া সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করো এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তাভাবনা করে।’ (সূরা র্আ রুম-২১)
স্বামী মানেই স্ত্রীর সুরক্ষাবেষ্টনী, মূলত পরিবারের প্রধান দায়িত্ব স্বামীর। একজন মুসলিম স্বামী দায়িত্বশীল ও আত্মমর্যাদাশীল। প্রকৃতপক্ষে একজন মুসলিম স্বামী গায়রতে পরিপূর্ণ তখনই হয় যখন তিনি নিজের স্ত্রীকে অন্য পুরুষদের থেকে উত্তমভাবে হিফাজত করতে পারেন। প্রয়োজনে নিজে বেশি পরিশ্রম করে, বেশি ঘাম ঝরায়। মুসলিম স্বামী গায়রতসম্পন্ন পুরুষ, এটি নিয়ামত, দুনিয়ার বুকে এক টুকরো জান্নাত।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পুরুষরা নারীদের প্রতি দায়িত্বশীল, যেহেতু আল্লাহ একের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং তারা তাদের সম্পদ হতে ব্যয়ও করে।’ (সূরা আন নিসা-৩৪) মানবসভ্যতার ইতিহাসের প্রথম এবং প্রধান ঘনিষ্ঠতম ও শক্তিশালী সম্পর্ক আল্লাহ এভাবে জুড়ে দিয়েছেন, করেছেন মধুরতর। আমাদের অজানা নয় কন্যাশিশু ইসলামে রহমত ও বরকতের। আরশিল আজিম তথাপি নারীকে বিয়ের মাধ্যমে আরো অধিক সম্মানের আসনে সমাসীন করেছেন। শরহে বেকায়াতে রয়েছে- ‘স্বামী স্ত্রীকে থাকার জন্য যে কক্ষ দেবেন, সে কক্ষে স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া (স্বামী ব্যতীত) কেউই প্রবেশ করতে পারবেন না, এমনকি স্বামীর মা-বাবা, ভাইবোনও নন। স্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনে এই কক্ষে তিনি তালা ব্যবহার করতে পারেন, স্ত্রীর ব্যক্তিগত বা গোপনীয় বিষয়ে স্বামী ছাড়া কেউ নাক গলাতে পারবে না। স্ত্রীর স্যুটকেস, ট্রাঙ্ক ও আলমারি স্বামী ছাড়া কেউ তল্লাশি করতে পারবে না। কোনো স্ত্রীর চলাফেরা বা আচরণ শ্বশুর-শাশুড়ির অপছন্দ হলে তাকে আলাদা বাড়ি বা ঘর করে দিতে হবে।’ একজন মুসলিমাহকে স্ত্রী হিসেবে আল্লাহ রানীর মর্যাদা দিয়েছেন।
দাম্পত্য জীবনে রয়েছে নানান বিচিত্র ও বিভ্রান্তিকর অলিগলি, রয়েছে স্বামী-স্ত্রীর নিজস্ব একক মনস্তত্ত্ব। একে অপরের সুবিধা-অসুবিধা বোঝার মধ্যে হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়। সুখী দাম্পত্য জীবনের মূল চাবি- বিশ্বাস, আশা, ভালোবাসা ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সম্মান। সন্দেহ পরিহার করা দাম্পত্য রসায়ন স্মুথ রাখার অন্যতম বিষয়। আল্লাহ বলেন, হে মুমিনরা, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাকো। নিশ্চয় কোনো কোনো অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গিবত করো না।’ (সূরা হুজুরাত-১২) যে পরিবারে সন্দেহের রোগ বাসা বাঁধে সেখানে সুখের আশা করা বৃথা। যেকোনো বিষয়ে পরস্পরে বোঝাপড়া ও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা বুদ্ধিদীপ্ত কাজ।
সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে, আখিরাতের সাক্ষাতের প্রতি আশাবাদী হতে হবে, প্রতিনিয়ত অন্তহীন ভালোবাসায় অবগাহন করতে হবে এবং একজনের প্রতি অপরজনের সম্মান থাকতে হবে। অসম্মান প্রদর্শনের পর ভালোবাসা সফেদ থাকে না, অনেক ক্ষেত্রে তা হয়ে যায় মূল্যহীন। দাম্পত্য জীবনের একটি বড় চাহিদার নাম- ‘একে অপরের পিতামাতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, বিয়ে দুটো হৃদয়ের সাথে সাথে দুটো পরিবারেও মেলবন্ধন।’ তাই সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য একে অপরের পরিবারের প্রতি দয়াদ্র হওয়ার বিকল্প নেই। যাদের হৃদয়কে আল্লাহ একত্রে বেঁধে দিয়েছেন এবং করেছেন এককে অন্যের পোশাকস্বরূপ। সৃষ্টিগতভাবেই মহান আল্লাহ যে সম্পর্কটাকে একে অপরের সহায়ক ও পরিপূরক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের উচিত সে সম্পর্কের জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানানো। এ সম্পর্ক নিছক কোনো সম্পর্ক নয়, বরং এ সম্পর্ক নিয়ামত। এ সম্পর্ক উত্তম রিজিক। এ সম্পর্ক সুকুনের।
রাসূল সা: বলেছেন, ‘নারীরা পুরুষের অর্ধাংশ।’ (আবু দাউদ) অশ্লীলতার যুগে জীবনসঙ্গীর প্রতি ভালোবাসা অনুভব এমন একটি সৌভাগ্য, যা অধিকতর পবিত্র ও পরম সুন্দর। এ গুণের অধিকারী তারাই যারা নিজের দৃষ্টি হিফাজতের সম্মান অর্জন করে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। পবিত্র হৃদয়ের বন্ধন পৌঁছে দেয় প্রশান্তির এমন ফোয়ারায়, যেথায় অনাবিল শ্রবণে শান্তি, পরিতৃপ্তি নির্গত হতে থাকে। এ পরিতৃপ্তিতে রয়েছে হৃদয় ও চোখের সুকুন। প্রকৃতপক্ষে নিজের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার যে অনুভব, স্বামীর চোখের কোণে স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে যে প্রেমময় হাসি- এর চেয়ে অধিক সৌন্দর্য ও তৃপ্তি আর কোথাও নেই। এ যেন সদ্য ফোটা গোলাপের মিষ্টি সুবাস। এ যেন বৃষ্টির সিক্ততা। এ যেন রোদ্দুরের ঝলকানো হাসি। সুবহান আল্লাহ। আর এ হাসির ফলে স্ত্রীর হৃদয়রাজ্য জয় করা স্বামী তো প্রকৃতই শ্রেষ্ঠ, প্রকৃতই চরিত্রবান। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম, তোমাদের মধ্যে যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম; আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ (তিরমিজি-৩৮৯২)
স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের শিকড় অনেক গভীরে, এর বিস্তৃতি অনেক দূর ব্যাপ্ত, একে অপরের আত্মার যে সম্পর্ক, সূরা বাকারার ১৮৭ নং আয়াতটি এর সাথে খুব চমৎকারভাবে তুলনাযোগ্য। আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।’
দাম্পত্য জীবন তখন হয় বেলির শুভ্রতায় সুবাসিত যখন একজন অন্যজনের তাহাজ্জুদের অ্যালার্ম হওয়া যায়। আপনি যদি আপনার জীবনসঙ্গীর সাথে একাধারে তাহাজ্জুদে রত থাকেন তবে বিশ্বাস করুন এ যাবৎকালের সবচেয়ে সুখী দম্পতি আপনারা। রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ রহম করুন এমন পুরুষ ব্যক্তির প্রতি, যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে উঠে, অতঃপর সালাত আদায় করে ও সে তার স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয়, তার পর সেও সালাত আদায় করে; অতঃপর সে (স্ত্রী) যদি ঘুম থেকে উঠতে আপত্তি করে, তাহলে তার মুখম-লের ওপর হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে দেয়। আর আল্লাহ রহম করুন এমন নারীর প্রতি, যে রাতে ঘুম থেকে ওঠে, অতঃপর সালাত আদায় করে এবং সে তার স্বামীকে জাগিয়ে দেয়, তারপর সেও সালাত আদায় করে; অতঃপর সে (স্বামী) যদি ঘুম থেকে উঠতে আপত্তি করে, তাহলে তার মুখম-লের ওপর হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে দেয়।’ (আবু দাউদ-১৩০৮) কি অনন্য একটি হাদিস, হৃদয় প্রশান্ত করা একটি হাদিস। এই দম্পতির সন্তান-সন্ততির বেড়ে ওঠার সাথে কি আয়েশা রা:,খালিদ রা:,আবদুল্লাহ বিন ওমর রা:, ইমাম বুখারি রহ: কিংবা সালাউদ্দীন আইয়ুবি রহ:-এর মতো সন্তানদের বেড়ে ওঠার সাথে পার্থক্য থাকতে পারে? পিতামাতার চালচলন, অভ্যাস এসব কিছু সন্তানকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। তাই উম্মাহর সম্পদ হিসেবে সন্তানকে গড়ে তোলার জন্য প্রথমে প্রত্যেক পিতামাতার উচিত নিজেদের বাস্তবিক অর্থেই উম্মাহর কল্যাণে রব্বের তরে বিলিয়ে দেয়া, সিরাতের অনুসরণ করা।
মখমলি এ সম্পর্কটি পার্থিব ও বস্তুগত কিংবা চতুষ্পদ জন্তুর প্রবৃত্তির মতো কোনো সম্পর্ক নয়; বরং তা হলো আত্মীক ও সম্মানজনক একটি সম্পর্ক। আর যখন এ সম্পর্কটি নির্ভেজাল ও যথাযথ হবে, তখন তা মৃত্যুর পর পরকালীন জীবন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে।
আল্লাহ সুবহানাহু বলেন, ‘স্থায়ী জান্নাত, তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতামাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকাজ করেছে তারাও।’ (সূরা আর-রাদ-২৩) আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মিলিত হওয়া যে দুই হৃদয় একে অন্যের প্রতি সন্তুষ্ট আল্লাহ সুবহানাহু তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন, তাদের দুনিয়া ও আখিরাত হোক পরম সুখের! লেখক : শিক্ষার্থী, আল কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ