গণ আন্দোলনের মুখে ফুলবাড়ীর মানুষের সাথে যে ৬ দফা চুক্তি হয়েছিল তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হলেও দেশী ও বিদেশী মুনাফাভোগী একটি গোষ্ঠী এখনো ফুলবাড়ীর কয়লা নিয়ে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে বন, নদী ও পরিবেশ ধ্বংস করে জনবিরোধী, পরিবেশ-বিনাশী কোনো প্রকল্প মেনে নেয়া হবে না। গতকাল ২৬ আগস্ট শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় ফুলবাড়ী শোক দিবসের ১৬তম বর্ষ পালনে আমিন, সালেকিন ও তরিকুলের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্ঘ অর্পণের পর সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব প্রফেসর অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ফুলবাড়ী শাখার আহ্বায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি কেন্দ্রীয় সদস্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাবলু, বাংলাদেশ ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদক মন্ডলির সদস্য মোশাররফ হোসেন নান্নু, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য মোসাদ্দেক হোসেন লাবু, গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য নাজার আহম্মেদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির জেলা সভাপতি মেহেরুল ইসলাম, উপজেলা শাখা তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব জয় প্রকাশ গুপ্ত, সদস্য হামিদুল হক, সদস্য এম এ আব্দুল কাইয়ুম, সিপিবি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এস এম নুরুজ্জামান জামান, বাংলাদেশ ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ উপজেলা শাখার সম্পাদক সঞ্জিত প্রসাদ জিতু, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিকদার প্রমুখ।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ভারতের স্বার্থে রামপাল বিদ্যুৎ, রাশিয়ার স্বার্থে রুপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, জাপানের স্বার্থে মাতারবাড়ী কয়লা প্রকল্পসহ পরিবেশ বিধংসী প্রকল্প বাতিল করতে হবে। কারণ এসব প্রকল্প দিয়ে লুটেরা রাশিয়া, চীনসহ ভারতীয় কোম্পানিগুলো লাভবান হলেও বাংলাদেশের পরিবেশ বিপন্ন হবে, উদ্বাস্ত হবে বাংলাদেশের মানুষ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে গ্যাসের বিশাল মজুদ আছে, সরকার সেদিকে না গিয়ে শুধু কয়লা তোলা নিয়ে ব্যস্ত। সরকার এখন বিদ্যুৎ সংকটের কথা বলে কয়লা উত্তোলন নিয়ে ব্যস্ত, কয়লায় পরিবেশ ধ্বংস হলেও শুধুমাত্র বিদেশী লুটেরা কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের দিকে ঝুঁকছে সরকার। আর এসব পরিবেশ বিধ্বংসী প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ বিপদের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ২০০৬ সালের ২৬ আগস্টের গণআন্দোলনে যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। এদিকে ২৬ আগস্টের ১৬তম বর্ষ পালনে ফুলবাড়ীর বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠনসহ ফুলবাড়ী পৌরসভার মেয়র মাহমুদ আলম লিটনের নেতৃত্বে শোক র্যালি আসাদ স্মৃতিস্তম্ভের শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
এ সময় পৌর মেয়র মোঃ মাহমুদ আলম লিটন তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাথে একাত্ততা প্রকাশ করে বলেন, ‘২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীর আপামর জনসাধারণ একত্রিত হয়ে যে গণআন্দোলনের সূচনা করেছিলেন সেদিনও তিনিসহ তার পরিবার যেমনিভাবে ফুলবাড়ীবাসীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঠিক তেমনিভাবে আগামী দিনগুলোতেও ফুলবাড়ীর উন্নয়ন ও জাতীয় সম্পদ রক্ষার স্বার্থে প্রত্যেকটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনিসহ তার পরিবার ফুলবাড়ীবাসীর পাশে থাকবেন। অপরদিকে আমরা ফুলবাড়বাসীর ব্যানারে সাবেক মেয়র মুরতুজা সরকার মানিকের নেতৃত্বে সকালে শোক র্যালিসহ শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয় এবং উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনির বিরুদ্ধে তিনি শপথবাক্য পাঠ করান।
এছাড়াও দিবসটি উপলক্ষে ফুলবাড়ীর বিভিন্ন সংগঠন, দোকান কর্মচারি ইউনিয়ন, মটর শ্রমিক ইউনিয়ন, ডেকোরেটর শ্রমিক ইউনিয়ন, হোটেল কর্মচারি ইউনিয়নসহ বিভিন্ন অরাজনৈতিক পেশাজীবী সংগঠন পৃথক পৃথক কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করেন।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী কয়লা খনি বাস্তবায়নের প্রস্তাবকারী এশিয়া এনার্জি নামক একটি বহুজাতিক কোম্পানির ফুলবাড়ী অফিস ঘেরাও কর্মসুচি পালন করতে গেলে, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গণমিছিলের ওপর টিয়ারশেল ও গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে ঘটনাস্থলে নিহত হয় সুজাপুর চাঁদপাড়া গ্রামের মকলেছুর রহমানের ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র তরিকুল ইসলাম (২০), বারকোনা গ্রামের আব্দুল হামিদের ছেলে আমিন (১৫) ও উত্তর সাহাবাজপুর গ্রামের সালেকিন (১৭)।
একই ঘটনায় দক্ষিণ সাহাবাজপুর গ্রামের প্রদীপ চন্দ্র, রতনপুর গ্রামের শ্রীমান বাস্কে, সুজাপুর গ্রামের বাবলু রায়সহ চিরতরে পঙ্গু হয় প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ। এরপর ফুলবাড়ীর মানুষ গণআন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে ফুলবাড়ীর উপর দিয়ে বাস, ট্রেন চলাচলসহ সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সারাদেশের সাথে কয়েকদিন বিছিন্ন হয়ে যায় ফুলবাড়ীর যোগাযোগ। ফুলবাড়ীর মানুষের গণ আন্দোলনের মুখে ৩০ আগস্ট তৎকালীন সরকারের প্রতিনিধিদল ফুলবাড়ীবাসীর সাথে একটি বৈঠক করে ৬ দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির ১৫ বছর পেরিয়ে ১৭ বছরে পদার্পণ করলেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি সেই ৬ দফা চুক্তি।