গত ৯ আগস্ট নিবিড়-নিভৃতে পালিত হয়ে গেল জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস।’ বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক ‘আদিবাসী’ বলতে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়কে বোঝায় যেমন- বেদে সম্প্রদায়। সংবিধানের ২৩ ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা করিবেন।’ ইংরেজি ভাষায় তারা ঊঃযহরপ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। বাংলাদেশে দু’ধরনের এথনিক বা আদিবাসী রয়েছে, যথা- ১. পাহাড়ে অবস্থান করা আদিবাসী ও ২. সমতল ভূমিতে বসবাস করা আদিবাসী। ১. পাহাড়ে অবস্থান করা আদিবাসী : পাহাড় বা দুর্গম এলাকায় বা দুর্গম জঙ্গলে ১৩টি গোষ্ঠী আদিবাসীর বসবাস, যা ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। যথা- ১. চাকমা; ২. মারমা; ৩. ত্রিপুরা; ৪. তনচংগ্যা; ৫. খামি; ৬. ম্রো; ৭. লুসাই; ৮. লুসাই সর্বপ্রাণবাদী; ৯. খিয়াং; ১০. পাংখো; ১১. সাক; ১২. ম্র্রং; ১৩. বম প্রভৃতি। ২. সমতল ভূমিতে নি¤œবর্ণিত ১২টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত আদিবাসী বসবাস করে যথা- ১. গারো; ২. সাঁওতাল; ৩. খাসিয়া; ৪. মনিপুরী; ৫. পাহাড়িয়া; ৬. রাখাইন; ৭. রাজবংশী; ৮. কোচ; ৯. ওঁরাও; ১০. হাজং; ১১. মাহাতো ও ১২. মু-া।
১৯৯১ সালের আদম শুমারি অনুসারে বাংলাদেশে আদিবাসী সংখ্যা ১.২ মিলিয়ন, যা দেশের সমগ্র জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল ১.১৩ শতাংশ। জাতিসঙ্ঘের তথ্য মোতাবেক পৃথিবীতে ৩৭০ মিলিয়ন আদিবাসী রয়েছে। বাংলাদেশে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬ (২) মোতাবেক ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙ্গালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ সংবিধানের ওই নির্দেশনা সম্পর্কে আদিবাসীদের দ্বিমত থাকার কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পাহাড়িদের সশস্ত্র বিরোধ নিরসনের জন্য বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদের সাথে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে আদিবাসীদের পক্ষে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরদাতা সন্তু লারমা বলেছেন, ‘সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করেনি’। শুধু বাংলাদেশ নয়; বরং পৃথিবীব্যাপী নৃগোষ্ঠী আদিবাসীরা নিগৃহীত; সাংবিধানিক অধিকার তো বটেই, অধিকন্তু এ মর্মে জাতিসঙ্ঘ প্রদত্ত ঘোষণা সদস্য রাষ্ট্রগুলো কার্যকর করতে গড়িমসি করছে, যার সিকি ভাগও বাস্তবায়িত হয়নি।’
উল্লেখ্য, আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কিত গ্রাউন্ড ওয়ার্ক ১৯২৩ ও ১৯২৫ সালে শুরু হয়।Maori T.W. Ratana কানাডা ও নিউজিল্যান্ড সরকার কর্তৃক আদিবাসীদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি লঙ্ঘন করার বিষয়টি নিয়ে সর্বপ্রথম League League of Nation এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৮২ সাল থেকে আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর অধিকার সম্পর্কিত বিষয় পুনরায় আলোচনায় উঠে আসে। জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল (Ecosoc) বর্ণিত বিষয়ে খসড়া প্রণয়নের কার্যক্রম শুরু করে। Vienna Declaration and Programme Action in-1993-1993 এ মর্মে কিছু সুপারিশ করে। ১৯৯৪-২০০৬ পর্যন্ত সময় নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা পরীক্ষা নিরীক্ষান্তে জাতিসঙ্ঘ নৃগোষ্ঠীর অধিকার সম্পর্কিত ঘোষণা চুক্তির খসড়া প্রণয়ন করে। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ১৪৪টি রাষ্ট্রের সমর্থন, চারটি রাষ্ট্রের বিরোধিতা ও ১১টি রাষ্ট্রের ভোট প্রদানে অনুপস্থিতিতে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে আদিবাসীদের কল্যাণার্থে ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার নিমিত্তে The Declaration on the Rights of Indigenous Peoples (UNDRIP) অনুমোদন করে hv Legally Non-Binding Resolution হিসেবে গৃহীত হয়। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকাসহ যারা বিরোধিতা করেছিল তারাই ২০১৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে ওই সনদের প্রতি সমর্থন দেয়।
ওই সনদে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে উপজাতিদের প্রথাগত সংস্কৃতি, প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতা, নিজস্ব ভাষা, পরিচিতি, পেশা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। প্রয়োজন ও ব্যবহার্য চাহিদা মোতাবেক ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত প্রথাগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ জোরদার করার অধিকার দেয়া হয়। রাষ্ট্রের সব অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকা-ে আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়াও জনস্রোতের মূল ধারার সাথে সংযুক্ত করে সর্বপ্রকার বৈষম্য দূরীভূত করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ওই সনদে উপজাতিদের উন্নয়ন, বহুমুখী গণতন্ত্র ও বৈষম্য দূরীকরণার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু সরিষায় ভূত থাকার কারণে অর্থাৎ Non-binding Resolution হওয়ায় যে রাষ্ট্রগুলো আদিবাসীদের অধিকার বাস্তবায়ন করছে না, তাদের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘ কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এটিও উপজাতিদের সাথে বিশ্ব সভ্যতার একটি তামাশা, যা সাধারণ নাগরিকদের সাথে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরা প্রতিনিয়ত করে থাকেন। নি¤œবর্ণিত পাঁচটি কারণে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত আদিবাসী অধিকার সনদ (UNDRIP) সম্পূর্ণভাবে কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না।
১. এটি একটি Non-Binding Resolution.
২. আদিবাসীরা রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃত জাতি বা রাষ্ট্র নয়।
৩. এ কারণে তারা International Court of Justice-এর শরণাপন্ন হতে পারে না।
৪. সনদ কার্যকর করতে সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর উদাসীনতা।
৫. আদিবাসীদের সংখ্যা অনেক নগণ্য বিধায় তারা অধিকার আদায়ে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না।
উল্লেখ্য, জাতিগত পরিচিতি কোনো প্রদত্ত বা পূর্বনির্ধারিত বিষয় নয় বরং মানব সমাজ সৃষ্ট, যা এক গোষ্ঠী থেকে অন্য গোষ্ঠীর পার্থক্য ও স্বাতন্ত্র্যের ইঙ্গিতবহ। যাই হোক, এ আপাত স্বাভাবিক এবং সামাজিক ক্রিয়ার একটি নেতিবাচক রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে, যার উদ্ভব জাতিরাষ্ট্রের উত্থান থেকে যা জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার বৌদ্ধিক প্রভাবজনিত সমপ্রকৃতির জনসংখ্যার ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু বেশির ভাগ মানব সমাজ বহুবিধ প্রকৃতির, সেহেতু লক্ষ করা যায়- আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রভাবশালী গোষ্ঠী অনেকটা অন্যায্যভাবে বা ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে তুলে ধরে এবং অন্য জনগোষ্ঠীগুলোকে ‘এথনিক’ উপজাতি, নৃগোষ্ঠী, আদিবাসী ইত্যাদি নামে অধঃস্তন পর্যায়ভুক্ত করে। যাই হোক, জাতি ও এথনিক শব্দ দুটোর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ দুই শ্রেণীর মধ্যে খুব কম পার্থক্যই বিদ্যমান। আরো প্রতিভাত হবে যে, এ সব ধারণা প্রাকৃতিকভাবে প্রদত্ত নয়, বরঞ্চ মানবসৃষ্ট। হধঃরড়হ শব্দের উদ্ভব ল্যাটিন হধংপর শব্দ থেকে, যার অর্থ জন্ম নেয়া। সাধারণভাবে এতে বোঝানো হয় এমন এক মানবগোষ্ঠী, যাদের জন্মগত সাদৃশ্য রয়েছে এবং এ গোষ্ঠী একটি পরিবার থেকে বৃহৎ হলেও একটি ক্ল্যান (clan) বা গোত্র থেকে ক্ষুদ্রতর। শুরুতে এটি হীন অর্থে ব্যবহৃত হতো। রোমে একে বিদেশী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হতো, যারা একটি ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে আগত ছিল, তবে ভিনদেশী হওয়ার কারণে তাদের মর্যাদা রোমান নাগরিকদের নিচে ছিল।
একইভাবে এথনিক শব্দটিও শুরুতে হীন অর্থবোধক ছিল। এটি গ্রিক শব্দ বঃযহরশড়ং থেকে উদ্ভূত, যা কয়েকটি পরিচয় নির্দেশ করত, যেমন- ক. খ্রিষ্টধর্মের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন জাতি অর্থাৎ হিদেন ও প্যাগানগণ, খ. একই রীতি ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন গোত্র বা বৃহৎ গোষ্ঠীগুলো এবং গ. আদিম সংস্কৃতিসম্পন্ন গোষ্ঠীগুলো। এভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, উপরিউক্ত দুটি শব্দ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সমরূপতা ও অধঃস্তন অবস্থান সম্পর্কে ইঙ্গিত করত। কিন্তু অধিক গুরুত্বের সাথে এটি অন্য গোষ্ঠীর বৈসাদৃশ্য তুলে ধরত। জাতি শব্দটির অর্থের ক্ষেত্রে অবশ্য পরিবর্তন এসেছে এবং এ পর্যায়ে এর হীন অর্থেরও অবলুপ্তি ঘটেছে। এর বর্তমান রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ফরাসি বিপ্লব থেকে উৎসারিত হয়েছে। বিপ্লবীদের জন্য জাতি ছিল বাস্তব এক রাজনৈতিক শ্রেণীবিশেষ। এবি সাইয়েস (অননব ঝরবু’বং) বলেন, জাতি হচ্ছে এক সম্মিলিত গোষ্ঠী, যারা একই সাধারণ আইনের আওতায় বসবাস করে এবং একই আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করে। (সূত্র : বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রথম খ-)
জাতি, জাতিসত্তা, জাতীয়তাবাদী নিয়ে তর্ক-বিতর্ক অনেক দিনের। রাষ্ট্র গঠিত হয় মূলত একটি ভৌগোলিক সীমারেখা, সার্বভৌমিকতা ও একটি শাসক শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিবেষ্টিত একটি জনগোষ্ঠী দ্বারা। কিন্তু জাতি ও সমাজ বলতে তা বোঝায় না। কারণ জাতি ও সমাজ গঠিত হয় পর্যায়ক্রমে দীর্ঘ অনুশীলনকৃত একটি সংস্কৃতির মাধ্যমে, যা গড়ে উঠে প্রকৃতির প্রভাবে। প্রকৃতি মানুষকে শিক্ষা দেয়, প্রশিক্ষিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। প্রকৃতিই মানুষের প্রথম শিক্ষক ও পথ পরিদর্শক। প্রকৃতিই মানুষকে সমাজবদ্ধভাবে গড়ে উঠার প্রশিক্ষণ দিয়ে সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করার জন্য সময়ে সময়ে সৃষ্টিকর্তা ঐশী বাণী দিয়ে মহামানব প্রেরণ করেছেন, কিন্তু বৈষম্য দূরীভূত হয়নি। পৃথিবীতে যারা সভ্যতার বেশি দাবিদার তারাই বিভিন্ন কূটকৌশলের মাধ্যমে বৈষম্যকে টিকিয়ে রেখেছে। যারা মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রপাগান্ডা ও প্রচারের খাতে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার খরচ করে তাদের হাতেই বর্তমানে মানবতা সবচেয়ে বেশি ভূলুণ্ঠিত ও নিষ্পেষিত। সমাজে ও রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে সৃষ্ট বৈষম্যই পৃথিবীতে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার মূল কারণ, যার পরিসমাপ্তি হওয়ার কোনো লক্ষণ বিদ্যমান নেই। কারণ এর পেছনে রয়েছে রাজা-মহারাজাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক ও ইগো প্রবলেম। লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন) E-mail : taimuralamkhandaker@gmail.com