শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০৩ পূর্বাহ্ন

দিনাজপুরের প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস

স্বাধীন সেন
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২

বর্তমান দিনাজপুর জেলা একটি সাম্প্রতিক প্রশাসনিক একক। বৃহত্তর দিনাজপুরের কথাও যদি আমরা দেশভাগের আগে ও পরের বিভিন্ন প্রশাসনিক বদলের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবি, তাহলেও বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, জয়পুরহাটের কিয়দংশ, গোবিন্দগঞ্জের অংশসহ ভারতের পশ্চিম বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাকে বিবেচনায় নিতে হবে। আবার প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলের ভিত্তিতে ভাবলে প্রশাসনিক একককে আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে। মোগল আমলে আর সুলতানি আমলে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার উত্তরের অনেকটা অংশ কামতা ও কামরূপের শাসনাধীন ছিল। বিশেষ করে বর্তমান পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের অংশ। আর তারও আগে আদি মধ্যযুগে কামরূপ-প্রাগজ্যোতিষের বিভিন্ন শাসকের সময়ে উত্তরাংশের এসব এলাকা কামরূপের অংশ বা ভুটানের শাসকদের শাসনাধীনও ছিল। মোটকথা, বিভিন্ন সময়ে এখানকার নাম ও সীমানা পাল্টেছে। কোনো স্থির ও অনড় সীমানা দিয়ে দিনাজপুরকে বোঝার চেষ্টা করা ঐতিহাসিকভাবেই ভুল হবে।
অতীতে গেলে দেখা যায়, আজকের দিনাজপুর জেলা যে অঞ্চলে অবস্থিত, সেই অঞ্চল খ্রি. নবম শতাব্দীতে বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী নামে পরিচিত ছিল, যা জানা যায় দক্ষিণ ভারতে পাওয়া একটি শিলালিপির মাধ্যমে। বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশআর ভারতের পশ্চিম বাংলার উত্তরবঙ্গের মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা মিলে গঠিত ছিল বরেন্দ্র। নবম শতাব্দীর আগেও এ অঞ্চল বরেন্দ্র বা গৌড় কিংবা পু-্র নামে পরিচিত ছিল। বিভিন্ন তাম্রলিপিতে পাল রাজাদের ‘গৌড়েশ্বর’, ‘গৌড়াধীপ’, ‘গৌড়নৃপ’ ইত্যাদি পদাবলি ব্যবহার করে পরিচয় দেয়া থেকে ধারণা করা যায় যে গৌড় নামে এ অঞ্চলের পরিচিতি দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত ছিল।১ খ্রি. ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ পর্যন্ত সময় প্রতœতাত্ত্বিক-ঐতিহাসিকদের কাছে ‘আদি মধ্যযুগ’ নামে সমধিক পরিচিত ওজনপ্রিয়, যদিও একই সময় বা কালপর্বকে অন্য নামে (যেমন: মধ্যযুগ) চিহ্নিত করার উদাহরণও রয়েছে।২ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ঐতিহাসিক উপিন্দর সিং সম্প্রতি আদি মধ্যযুগ নিয়ে সম্পাদিত একটি বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে আদি মধ্যযুগ সমধিক গুরুত্ব পেলেও দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে এ সময়ের সংহত একটি ইতিহাস এখনো তৈরি হয়নি। আদি মধ্যযুগের আরম্ভ ও সমাপ্তি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। কোনা কোন মানদ-ের ওপর নির্ভর করে ওই সময়কে আদি মধ্যযুগ বলা হবে, তার শুরু ও শেষ নির্ধারিত হবে সেটা একটা বিস্তৃত ঐতিহাসিক বিতর্কের বিষয়। সাধারণভাবে রাজবংশীয় ইতিহাসের দিক থেকে গুপ্ত শাসনামল শেষ হওয়ার পর বৃহৎ কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে অসংখ্য ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র রাজত্বে বিভক্ত হওয়াটা একটা মানদ-। অন্যদিকে তুর্কি৩ শাসকদের শাসনামলের শুরুকে আদি মধ্যযুগের শেষ বলে চিহ্নিত করা হয়। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, শাসকদের পরিচয়নির্ভর কালপর্বজ্ঞাপক যেকোনো পদাবলিই সমস্যাজনক। কারণ শাসক বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে কোনো জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবন পাল্টে যায় না। তবে আদি মধ্যযুগের সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরে চলমান।
বর্তমান দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত বানগড় একটা সময় কোটিবর্ষ আর পরে দেবকোট নামে পরিচিত ছিল। এ বানগড়ে পু-্রনগর ভুক্তির অন্যতম ক্ষুদ্র একটি নগর কেন্দ্র (যা কোটিবর্ষ বিষয়ে কেন্দ্র ছিল) অবস্থিত ছিল। সেখানে কিন্তু আদি ঐতিহাসিক সময় থেকে মধ্যযুগ অবধি মানববসতির চিহ্ন পাওয়া গেছে। পশ্চিম বাংলার দিনাজপুর অঞ্চলের জরিপের কিছু ফলাফল জানা যাবে অধ্যাপক শীনা পাঁজার গবেষণার বিভিন্ন প্রতিবেদনে। আমরা এ ছোট লেখাটিতে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাংশের কয়েকটি উপজেলা আর জয়পুরহাটের কয়েকটি উপজেলার প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্ত নিয়ে আলাপ করব। আরেকটি কথা উল্লেখ করা জরুরি যে বাংলা অঞ্চলে অন্তকালী গুপ্ত শাসকদের যে কয়টি তাম্রলিপি পাওয়া গেছে তার প্রায় সবই দিনাজপুর থেকে পাওয়া গেছে। ফুলবাড়ীর দামোদরপুর থেকেই পাঁচটি আর হাকিমপুরের বৈগ্রাম থেকে একটি তাম্রলিপি পাওয়া গেছে। এগুলো প্রধানত জমি ক্রয়-বিক্রয়ের দলিল। কিন্তু মহাস্থানগড় ও বানগড়ের বাইরে আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে ও খননে আমরা আমাদের দিনাজপুর জেলায় এখনো গুপ্ত শাসনামল বা শশাঙ্কের শাসনামলের সমসাময়িক কোনো উপাত্ত সন্দেহাতীতভাবেই পাইনি। উল্লেখ্য, আমাদের দিনাজপুর জেলার প্রতিটি উপজেলাই আমরা জরিপ করেছি নিবিড়ভাবে। আদি মধ্যযুগের সমাজের, ধর্মের ও অর্থনীতির যে জটিল ইতিহাস আমাদের সামনে এরই মধ্যে হাজির আছে সেই ইতিহাসকে নিরিখ করার জন্য আদি মধ্যযুগের নতুন ধরনের প্রত্নতত্ত্বচর্চা প্রয়োজন। প্রথমত, এ প্রত্নতত্ত্বচর্চায় কোনো বিশেষ ধরনের বা প্রকৃতির প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ও নিদর্শনের প্রতি পক্ষপাত থাকবে না; দ্বিতীয়ত, প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা করতে হবে কেবল কতগুলো প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে অনুমিত প্রত্নস্থান নথিভুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়; বরং অতীত মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত সব ধরনের আলামত ও প্রমাণ শনাক্ত করে সেগুলো বিভিন্ন পদ্ধতিতে নথিভুক্ত করতে হবে, যাতে নথিভুক্ত উপাত্তকে জিআইএস-পরিপ্রেক্ষিতে রেখে বিশ্লেষণ করা যায়। তৃতীয়ত, প্রত্নস্থানগুলো কীভাবে কোন স্থানে অবস্থিত ও বিস্তৃত তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে হবে। চতুর্থত, পুরনো পুকুর ও দীঘির মতো প্রত্নতাত্ত্বিক আলামতগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সেগুলোর সঙ্গে প্রত্নস্থানগুলোর সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করতে হবে। পঞ্চমত, প্রত্নতাত্ত্বিক খননের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভূমিরূপে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের প্রত্নস্থান নির্বাচন করতে হবে। ষষ্ঠত, খননের উদ্দেশ্য কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উদ্ধার হলে হবে না; পুরনো দেয়াল ও স্থাপত্য কাঠামো উন্মোচন করা হলে হবে না। বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানবীয় ও পরিবেশগত ঘটনার কারণে ও প্রভাবে একটি স্থাপনা ও তার চারপাশের স্থানে যে পরিবর্তনগুলো হয় বা শতকের পর শতক যে ধারাবাহিকতা থাকে সেই পরিবর্তন ও ধারাবাহিকতাকে এবং তার কারণকে শনাক্ত করতে চেষ্টা করতে হবে। একটি স্থাপনার কয়টি নির্মাণপর্ব (কতবার সেই স্থাপনাটি সংস্কার হয়েছে, পুনর্নির্মিত হয়েছে বা পরিবর্ধিত হয়েছে) শনাক্ত করাই যেন প্রচলিত অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একটি স্থাপনার দেয়ালের ওপর তো মানুষ বসবাস করেনি; মানুষ তার বিভিন্ন কর্মকা- পরিচালনা করেনি। মানুষ দেয়াল দিয়ে আবদ্ধ স্থানে বসবাস করেছে এবং সেই স্থান ও দেয়াল দিয়ে ঘেরা স্থানের বাইরের স্থান বিভিন্ন কাজে (যেমন: ব্যবহারের অযোগ্য মৃৎপাত্র ফেলার কাজে, বর্জ্য ফেলার কাজে ইত্যাদি) ব্যবহার করেছে। বিভিন্ন সময়ে এ ব্যবহারের ধরন পাল্টেছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবীয় প্রক্রিয়ার কারণে। খননের সাম্প্রতিকতম পদ্ধতি প্রয়োগ করলে, নথিভুক্ত করলে ও ব্যাখ্যা করলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত বস্তুরাজি (যাকে আমরা বলি বস্তু সংস্কৃতি), সেগুলো কী অবস্থায় আছে, কী ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেগুলো গেছে তা বোঝা যায়। সপ্তমত, বাংলাদেশের মতো ভূমিরূপ যেখানে নদী, নদী ব্যবস্থা ও নদী ব্যবস্থার নিয়ত বদলে যাওয়া মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত, সেখানে নদীর ইতিহাস না বুঝলে, নদীর বদলে যাওয়ার প্রকৃতি, অনুষঙ্গ ও ধরনকে, অর্থাৎ নদী-ভূমিরূপ-মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কেও ইতিহাস না বুঝলে আমরা যা জানতে পারব তা হবে আংশিক ও খ-িত। এ ধরনের বোঝাপড়ার মাধ্যমেই অতীত মানুষের (কোনো রাজার নয় বা কোনো নগরের নয়) জীবনযাপন, তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে নির্মোহ অনুমান করা সম্ভব। এজন্যই উপর্যুক্ত বিষয়গুলো মনে রেখে মানুষের বিভিন্ন ধরনের বসতিগুলোকে শনাক্ত করা যায়, সেই বসতিগুলোর পরিবর্তন ও রূপান্তর বোঝা যায়, বসতিগুলোর প্রেক্ষিতে রেখে এবং বসতিগুলোর আন্তঃসম্পর্কের প্রেক্ষিতে রেখে সাধারণ মানুষের জীবনকে বোঝা সম্ভব হতে পারে। আদি মধ্যযুগের সামাজিক প্রেক্ষিতকে বুঝতে গেলে বসতি ও বসতি বিন্যাস প্রত্নতত্ত্বের বিকল্প নেই। মনে রাখা প্রয়োজন, প্রত্নতত্ত্বে বা ইতিহাসে শতভাগ নিশ্চয়তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। আদি মধ্যযুগীয় প্রত্নতত্ত্বচর্চার ওপরের প্রসঙ্গগুলো মনে রেখে আমরা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ১৫ বছর ধরে গবেষণা করে আসছি। সময়সাপেক্ষ হওয়ায় ও আর্থিক সংগতি না থাকায় আমরা দিনাজপুর ও জয়পুরহাট জেলায় আমাদের গবেষণা এখনো সীমাবদ্ধ রেখেছি। অতীতে বরেন্দ্র এবং গৌড় নামে পরিচিত এ এলাকা সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়ার কিছু নমুনা সংক্ষেপে ও তুলনামূলক সরলভাবে উল্লেখ করার চেষ্টা করলাম। তবে এ অনুমানগুলোকে কোনোভাবেই আদি মধ্যযুগীয় বরেন্দ্র বা গৌড়ের সমাজ ও পরিবেশকে বোঝার জন্য সাধারণীকরণ করে প্রয়োগ করলে হবে না। কারণ সেই গৌড় বা বরেন্দ্রর আয়তনের তুলনায় অল্প এলাকাই আমরা এখন পর্যন্ত গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছি: এক. এ অঞ্চলে বসতিগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, কৃত্রিম জলাশয় (পুকুর/দীঘি) ও বিশেষ করে ফেলে দেয়া বা পরিত্যক্ত মৃৎপাত্রের টুকরোর বিস্তৃতির মাধ্যমে চিহ্নিত করা যায়। এগুলো গুচ্ছাকারে বা বিচ্ছিন্নভাবে ভূপৃষ্ঠের ওপর ছড়িয়ে আছে। দিনাজপুর জেলার বিরামপুর, ফুলবাড়ী, হাকিমপুর, নবাবগঞ্জ আর জয়পুরহাট উপজেলার পাঁচবিবি, কালাই ও ক্ষেতলাল উপজেলায় আমরা ৬৬টি বিভিন্ন আকারের ও আয়তনের আদি মধ্যযুগীয় মানববসতি শনাক্ত করেছি। এছাড়া ১০৪টি বিচ্ছিন্ন প্রত্নস্থান রয়েছে যেগুলো বসতির বাইরে ছিল বা প্রান্তে ছিল।
দুই. যে প্রত্নস্থানগুলো আমরা পেয়েছি সেগুলোর একটা শ্রেণী হলো স্থাপত্য কাঠামোবিশিষ্ট ঢিবি। এগুলো প্রধানত ধর্মীয় বিভিন্ন স্থাপনা, যেমনবৗদ্ধ বিহার, বৌদ্ধ বা হিন্দু মন্দির, বৌদ্ধ স্তূপ ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষকে ধারণ করছে। আদি মধ্যযুগীয় মানববসতিগুলো এ ধর্মীয় স্থাপনাগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। এ মানববসতির কোনোটিই নগর ছিল না। কোনো কোনোটির আকার মহাস্থানগড় (তৎকালীর পু-্রনগর) ও বানগড়ের (তৎকালীন কোটিবর্ষ) চেয়েও প্রায় দুই বা তিন গুণ বড়।
তিন. মানববসতিগুলো মূলত গ্রাম বা সম্পন্ন বৃহদাাকারের গ্রাম কিংবা গ্রাম ও নগরের মাঝামাঝি অবস্থার বসতি। এগুলো কোনোভাবেই একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্ন ছিল না; বরং এগুলো ব্যবহারের ও পরিবর্তনের ধরন ও কালানুক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একটির সঙ্গে আরেকটির গতিশীল সম্পর্ক ছিল।
চার. বসতিগুলোর স্থানিক বিস্তৃতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোথাও কোথাও খুব পাশাপাশি একটা বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এগুলো বিস্তৃত। যেমন: বর্তমান বিরামপুর-নবাবগঞ্জে নলশীশা-আশুলি-ছোট যমুনা নদীর পাড় ধরে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে খুব ঘন সন্নিবিষ্ট বসতির বিস্তার ঘটেছিল। আমরা অনুমান করি, বসতির নেটওয়ার্কে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল/নোডাল জোন ছিল। পাঁচ. বসতিগুলো লালাভ হলুদাভ বা লালাভ বাদামি রঙের মাটিবিশিষ্ট বরেন্দ্রভূমির মাটিতে যেমন অবস্থিত, ঠিক তেমনি নিয়মিত প্লাবিত হয় এমন সমতল ভূমিতেও অবস্থিত। নদীর ধারঘেঁষে রৈখিকভাবে এগুলো যেমন বিস্তৃত, তেমনি বৃত্তাকারে ঘন সংবদ্ধ আকারে এগুলো বিস্তৃত। এ বিস্তৃতির কারণ যেমন নদীর অবস্থান, তেমনি চাষযোগ্য সমতল ভূমির অবস্থান।
ছয়. বসতিগুলোর সমসাময়িক কৃত্রিম জলাশয়গুলো বসতির কাছে যেমন অবস্থিত, ঠিক তেমনি বসতি থেকে দূরে বিচ্ছিন্নভাবে বা গুচ্ছাকারে অবস্থিত। বসতির নিকটবর্তী জলাশয়গুলো দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজে বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কাজে ব্যবহূত হতো। অন্যদিকে দূরে জলাশয়গুলো বর্ষার পানি সঞ্চিত করে শীতকালে সেচের কাজে ব্যবহূত হতো। উঁচু, লালাভ বাদামি মৃত্তিকাবিশিষ্ট জমির তুলনায় সমতল ভূমিতে এ জলাশয়ের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। তার কারণ এ ধরনের জমিতে জল সঞ্চিত করে সেচের প্রয়োজনীয়তা কম ছিল।
সাত. জরিপ ও খননের উপাত্তের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে আমার দেখতে পেয়েছি, খ্রি. সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর দিকে এখানে আকস্মিকভাবে বসতির সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল আগের সময়ের তুলনায়। বসতির বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিকভাবেই জনসংখ্যার বেড়ে যাওয়াকে নির্দেশ করে, নতুন নতুন জমি আবাদের উপযোগীকরণের প্রমাণ বহন করে, ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠা সামাজিক স্তরবিন্যাস ও জটিলতাকে নির্দেশ করে। আদি মধ্যযুগের সমাজ সম্পর্কিত ইতিহাসের সামন্ততান্ত্রিক মডেল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র বিস্তারের মডেলের তত্ত্বের বেশকিছু ব্যাখ্যার সঙ্গে এ আলামত সামঞ্জস্য বিধান করে।
আট. প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসে খ্রি. সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর আগে এ এলাকায় মানববসতির বিস্তৃতির কথা উল্লেখ করা হয়। বিশেষ করে লিপিগত ও লিখিত উৎসের ভিত্তিতে বলা হয়, গুপ্ত শাসনামলে ও পরবর্তী সময়ে এ এলাকার মানববসতির সম্প্রসারণ ঘটেছিল। কিন্তু মহাস্থানগড় ও বানগড় ছাড়া (এ দুটি স্থানে খনন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বলা যায়) আমাদের জরিপ ও খননকৃত কোনো স্থান থেকে আমরা সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী-পূর্ববর্তী কোনো আলামত পাইনি। এক্ষেত্রে লিপিগত ও লিখিত উৎসের উপাত্তের সঙ্গে প্রতœতাত্ত্বিক উপাত্তের বৈসাদৃশ্য তৈরি হয়। আমরা অনুমান করি, গুপ্ত শাসনামল ও তার পরবর্তী সময়ে এ এলাকায় মানববসতির যে ব্যাপক বিস্তৃতির কথা বলা হয় তা সঠিক নয়। তবে অবশ্যই ওই সময়ে এখানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র পরিসরের মানববসতি গড়ে উঠেছিল। সেই মানববসতিগুলোর প্রমাণ বা আলামত বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় আর পরবর্তীকালীন বসতি গড়ে ওঠার প্রবল তৎপরতার কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নয়. খননের উপাত্তের কালানুক্রমিক ও স্তরবিন্যাসগত ব্যাখ্যায় আমরা লক্ষ করেছি, কোনো কোনো বসতিতে ধারবাহিকভাবে মানুষ থেকেছে খ্রি. চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত। কিন্তু এক্ষেত্রে বসতির প্রকৃতি ও কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। কোনো মন্দির পরবর্তী সময়ে সেকুলার বসতি হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে; কোনো বৌদ্ধ বিহার পরে ভিন্ন কোনো সেকুলার কাজে, মানুষের বসবাসের জন্য ব্যবহূত হয়েছে; কোনো বৌদ্ধ স্তূপ রূপান্তরিত হয়েছে হিন্দু মন্দিরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাওয়া সামাজিক ও ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিত এ রূপান্তরে কার্যকর প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। দশ. একটি মন্দিরও তার রূপ পাল্টেছে। যেমন বিরামপুরের চ-ীপুরে আমরা একটি বিষ্ণু মন্দির পেয়েছি। সেই মন্দিরটির গর্ভগৃহ খ্রি. আনুমানিক দশম-একাদশ শতাব্দীর দিকে ভেঙে ফেলা হয়। আমরা অনুমান করি, এটি কোনো সম্প্রদায়গত সংঘাতে বা কর্তৃত্ব বিস্তারের জন্য ঘটা সংঘাতে ধ্বংস হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ওই মন্দিরটির গর্ভগৃহ পুনর্গঠিত হয় এবং ম-প পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু মন্দির হিসেবে এর ব্যবহার অব্যাহত থাকে। কিন্তু খ্রি. চতুর্দশ শতাব্দীর দিকে এটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয় প্রধানত স্থানীয় নদী ব্যবস্থা পাল্টে যাওয়ার কারণে। মন্দির ও বসতিটি বর্তমান ছোট যমুনা নদীর একটি পুরনো নদীখাতের পূর্ব তীরে অবস্থিত। আবার খ্রি. ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে মন্দিরটি যখন পরিত্যক্ত হয়ে ঢিবিতে রূপান্তরিত হয়েছে, তখন সেই ঢিবির ওপর এসে তৎকালীন মানুষ বসবাস করেছে এবং লৌহ নিদর্শন উৎপাদনের সঙ্গে ঢিবিটিকে সম্পর্কিত করেছে। এগারো. কোনো কোনো বসতিতে হিন্দু মন্দিরের ব্যবহার এ এলাকায় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বখতিয়ার খলজির আগমনের পরও অব্যাহত ছিল। বিরামপুরের সন্দলপুরে একটি বৌদ্ধ স্তূপকে সম্ভবত শিব মন্দিরে রূপান্তর করা হলেও সেই মন্দিরটি চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্যবহূত হয়েছিল। মন্দিরটি আশুলি নদীর আদিখাতের পাড়ঘেঁষে ছিল এবং সেটি নদীর প্রবাহপথ পরিবর্তনের কারণে প্রভাবিত হয়েছিল। বারো. প্রচলিত ইতিহাসে ধরে নেয়া হয়, বৌদ্ধ বিহারগুলো তৎকালীন জনবসতি থেকে কিছুটা দূরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়ে উঠেছিল। অনুমান করে নেয়া হয়, বিহারে বসবাসরত বৌদ্ধ শ্রমণেরা ধর্মচর্চা ও শাস্ত্রচর্চা করতেন বলে এ বিচ্ছিন্নতা জরুরি ছিল। কিন্তু পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারে আমাদের পরিচালিত গবেষণা এবং দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের দোমাইলে বৌদ্ধ বিহারের যে গুচ্ছ আমরা খুঁজে পেয়েছি সেটাসহ আরো কয়েকটি বসতি (যেমন: বিরামপুরের চরকাই, ফুলবাড়ীর পুকুরী কিংবা পাঁচবিবির পাথরঘাটার উচাই) বৌদ্ধ বিহার বা বিহারগুচ্ছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। সাঁচি, ভারহুত, অমরাবতীর মতো আদি ঐতিহাসিক যুগের বৌদ্ধ বিহার ও স্তূপকেন্দ্রিক মানববসতির প্রমাণ সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত হওয়ায় এবং নালন্দার বৌদ্ধ বিহারসংলগ্ন মানববসতি এবং হাটের মতো বাণিজ্য কেন্দ্রের প্রমাণ পাওয়া যাওয়ায় বৌদ্ধ বিহার সম্পর্কে ধরে নেয়া স্বতঃসিদ্ধ ধারণাগুলো পাল্টে গেছে।৪ বৌদ্ধ সঙ্ঘ (যারা মহাবিহার/বিহার/বিহারিকায়) বসবাস করেন কেবল ধর্মচর্চা, শাস্ত্রচর্চা ও ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন এবং সাধারণ সমাজের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নিতান্তই নির্ভরশীলতার ছিল বলে যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত তা যে ভ্রান্ত তার প্রমাণ প-িতেরা দিয়েছেন। বরং লিপিগত প্রমাণে দেখা যায়, রাজাদের দান করা নিষ্কর ভূমিদানের ফলে খ্রি. সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে বৌদ্ধ বিহারগুলো বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তির মালিক হয়ে উঠেছিল। এ ভূমির আবাদ ও শস্যের ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট বিহারের ভিক্ষুরা যুক্ত থাকতেন। তৎকালীন বাণিজ্যপথের ও নেটওয়ার্কের পাশেই অনেক বৌদ্ধ বিহার গড়ে উঠেছিল। বাণিজ্য সংঘঠনেও বৌদ্ধ বিহার ও সঙ্ঘের ভূমিকা ছিল। সমসাময়িক সমাজ ও বিহারগুলোর সম্পর্ক নিবিড় ছিল, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সমাজের ও উৎপাদনের বিভিন্ন পরিক্ষেত্রে যুক্ত থাকতেন। সোমপুর মহাবিহারের প্রতœতাত্ত্বিক উপাত্তের ভিত্তিতে আমার আরো ধারণা করি, সংলগ্ন এলাকার সেচ ও বন্যা ব্যবস্থাপনায় ওই বিহারের বৌদ্ধ সঙ্ঘের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ছিল। বৌদ্ধ বিহারকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করা তাই ভ্রান্ত। প্রখ্যাত প-িত ফ্রেডরিখ অ্যাশার এ প্রসঙ্গেই নালন্দা মহাবিহার নিয়ে খুব চমৎকার আলোচনা করেছেন সম্প্রতি। ৫.তেরো. নবাবগঞ্জের দোমাইলে যে বৌদ্ধ বিহারগুচ্ছ আমরা পেয়েছি সেই বিহারগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বসতি খ্রি. দ্বদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পরিত্যক্ত হয়েছিল কেবল পার্শ্ববর্তী নলশীশা নদী ও তুলসীগঙ্গা নদীর গতিপথের পরিবর্তনের কারণে এবং সম্পর্কিত বন্যার ফলে। অর্থাৎ বরেন্দ্র অঞ্চলে আদি মধ্যযুগে মানববসতি গড়ে ওঠার ও বিলুপ্ত হওয়ার বা অব্যাহতভাবে বসতি থাকার কিংবা পরিত্যক্ত হওয়ার পর পুনরায় বসতি গড়ে ওঠার যে আলামতগুলো আমি ওপরে হাজির করলাম তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে আদি মধ্যযুগে এ এলাকায় মানববসতি গড়ে ওঠার, রূপান্তরিত হওয়ার বা পরিত্যক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া ও কারণগুলো স্থান ও সময়ভেদে বিবিধ ছিল। কোনো সমরূপ ও সমসত্ত্ব ঐতিহাসিক রূপরেখায় ফেলে এ ইতিহাস ব্যাখ্যা করা যাবে না। চৌদ্দ. আদি মধ্যযুগে এখানে মানববসতির আকার ও প্রকারও বিভিন্ন ছিল। কোনোটি ছিল মাটির প্রাচীর ঘেরা। কোনোটি ছিল পরিখা ঘেরা। কোনোটি অসংখ্য পুকুর দিয়ে ঘেরা। কোনোটি আবার কোনো সুনির্দিষ্ট সীমারেখা ছাড়াই। পনেরো. লিপিগত প্রমাণের আলোকে এ এলাকায় ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ বসতির উল্লেখ করা হয়। লিপিগত প্রমাণে আছে ব্রাহ্মণদের বসতির জন্য আলাদা নিষ্কর জমি দান করা হচ্ছে। এগুলো ‘অগ্রহার’ বা ‘ব্রহ্মদেয়’ বসতি নামে সমধিক পরিচিত। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে আমরা এখনো এমন একটা বসতিও পাইনি যেটিকে কেবল ব্রাহ্মণ্য বা বৌদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যে বসতিগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি সেগুলো বৌদ্ধ বিহার, বৌদ্ধ মন্দির ও হিন্দু মন্দির একই বসতিতে অবস্থিত। কালানুক্রমিকভাবে আমরা এমন বসতি পেয়েছি যেখানে দশম-একাদশ শতাব্দীর দিকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় প্রভাব বৃদ্ধির প্রচলিত ঐতিহাসিক ভাষ্যের সমর্থনে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়। আবার এমন বসতিও আমরা পেয়েছি, যেখানে এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। সমগ্র বরেন্দ্রর মতো একটা বৃহৎ ভৌগোলিক এলাকায় যেভাবে ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় প্রভাব বৃদ্ধির একটি সমসত্ত্ব ইতিহাস লেখা হয়, সেই লেখা তাই সমস্যাজনক। আদি মধ্যযুগীয় বরেন্দ্রে বা গৌড়ে স্থানভেদে কিংবা কালভেদে এ প্রভাব বেড়েছে বা বাড়েনি। ষোলো. প্রচলিত ইতিহাসে যেভাবে আদি মধ্যযুগ ও মধ্যযুগকে একটি কালিক সীমারেখা দিয়ে পৃথক করা হয়, যেভাবে অনুমান করা হয় যে বখতিয়ার খলজির এ এলাকা অধিকার করে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার সমাজ ও অর্থনীতি পাল্টে গিয়েছিল মানববসতির উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যাবলি সেই ভেদরেখাকে অস্পষ্ট করে দেয়। রাজবংশের বদল বা শাসকদের ধর্মের বদলের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ ও সাধারণের জীবনযাপন পাল্টে যায় না।
সতেরো. খননের ও জরিপের উপাত্তের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, আমরা যেভাবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের মধ্যে (বা আদি মধ্যযুগ ও মধ্যযুগের মধ্যে) অথবা বিভিন্ন শাসনামলের মধ্যে ফারাক করে ইতিহাস লিখি ও পড়ি, সেই বোঝাপড়া সমস্যাজনক। মানুষের বসতি, ধর্মস্থান, জীবনযাপন বা অভ্যাস শাসকের বদলের সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিকভাবে বদলে যায় না। শাসকরা কিছু বদল করতে পারেন, কিন্তু সেই বদলের প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনে সর্বত্র সবসময় একইভাবে পড়ে না। এমনকি দিনাজপুরের লালমাটি, পলিমাটি আর হিমালয়ের পাদদেশীয় পলভূমির মাটি আলাদা। নদী ব্যবস্থা সবসময় সামগ্রিকভাবে পাল্টায়নি। জলাভূমি বা কৃষিকাজ কিংবা বাণিজ্যের ও স্থানীয় ব্যবসার ব্যবস্থা বিভিন্ন স্থান ও পথ (যেমন: হাট বা হট্ট, নদীর পাড়ের বাজার, হিমালয়ের কাছাকাছি বাণিজ্যপথ) অনুসারে পাল্টেছে। বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন স্থানিক পরিসর অনুসরণ করে। ঘোড়াঘাটের বেলওয়া, কাহারোল ও বোচাগঞ্জের বাসুদেবপুরে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননের উপাত্ত এ লেখায় অন্তর্ভুক্ত করা হলো না। ঘোড়াঘাট, পার্বতীপুর, কাহারোল, খানসামা, বোচাগঞ্জ ও বীরগঞ্জে পরিচালিত নিবিড় সামগ্রিক জরিপের/টোটাল সার্ভের ফলাফলও এ আলোচনায় বিবেচনা করা হলো না। কারণ এখনো সেগুলোর মাধ্যমে প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ সম্পন্ন হয়নি।
তবে পরিসরের কথা বিবেচনা করে, যে আদি মধ্যযুগের প্রত্নতত্ত্বের ভিত্তিতে বরেন্দ্র বা গৌড়কে বোঝার যে ক্ষুদ্র, সরল ও সংক্ষিপ্ত প্রয়াস আমি এখানে করলাম, বলাই বাহুল্য তা অসম্পূর্ণ ও নিরিখযোগ্য। দিনাজপুর নামে আজকের যে ভূভাগ বা প্রশাসনিক এককের ভিত্তিতে আমরা স্থান ও সময়কে বোঝার ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি সেটা ভুল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থানের পরিচয়, বৈশিষ্ট্য আর মানুষ-প্রতিবেশের সম্পর্ক পাল্টেছে। দিনাজপুরের মধ্যেও নানা স্থানে নানা ধরনের মানুষ, মানুষের নানা ধরনের জীবন ও যাপন আজও চোখে পড়বে। সমরূপীকরণ করে ইতিহাস বোঝার চেষ্টা তাই যতটা পরিত্যাগ করা যায় ততটাই আমরা অতীতকে তার বিবিধতা ও বৈচিত্র্যসমেত বুঝতে পারব। সামনের দিনগুলোর গবেষণায় আমরা প্রচলিত ইতিহাসবোধের আরাম ও আত্মতুষ্টিকে নস্যাৎ করার মতো আরো অনেক আলামত খুঁজে পাব সেটা নিশ্চিত। অতীতকে ভয় পেয়ে, আড়াল করে, অস্বীকার করে আর অবজ্ঞা করে কোনো লাভ নেই। অতীত কখনো না কখনো বর্তমানে নিজের বহুরূপী সত্তাকে প্রকাশিত করবেই। তাই অতীত সম্পর্কে প্রতিনিয়ত শিখে যাওয়াটাই এই মূহূর্তে প্রয়োজন। তথ্যসূত্র ও টিকা: ১. দেখুন, নোটস, স্বাধীন সেন, দ্য ট্রানসফরমেটিভ কনটেক্সট অব এ টেম্পল ইন আরলি মেডাইভাল বরেন্দ্রী: রিপোর্ট অন দি এক্সক্যাভেশন অ্যাট তিলেশ্বরীর আড়া ইন দিনাজপুর ডিস্ট্রিক্ট, বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ৩১(১) (২০১৫).
২. দক্ষিণ এশিয়ায় ইতিহাসবিদ্যা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুগ বিভাজন বা কালপর্বীকরণ এ উপমহাদেশে সবসময়ই সমস্যাজনক। ইতিহাস বা সময়কে বিভিন্ন যুগে বা পর্বে বিভাজিত করে আলোচনা করতে গেলে এক ধরনের সমরূপীকরণ করতে হয়। কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা বৈশিষ্ট্যাবলিকে প্রধান ধরে নিয়ে এ কালপর্বীকরণ করতে হয়। জেমস মিল ভারতের ইতিহাসকে তিনটি যুগে/কালপর্বেহিন্দু, মুসলমান ও ব্রিটিশÍবিভক্ত করেন। এ যুগ বিভাজন ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান ধরে নিয়েছে প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়ের ক্ষেত্রে। আবার ঔপনিবেশিক সময়কে ‘ব্রিটিশ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। যুগ বিভাজনের এ পদ্ধতি পরবর্তী সময়ে সমালোচিত হয়েছে। কারণ এ ইতিহাসে প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়কে যুগ বিভাজন করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন ব্রিটিশরা আসার আগে ভারত উপমহাদেশের কোনো ইতিহাস ছিল না। এ ঔপনিবেশিক ইতিহাসে অতীতকে নিকৃষ্ট ও পিছিয়ে পড়া হিসেবে পরিবেশন করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনায় আগের যুগ বিভাজনের সীমানা অক্ষুণ্ন রেখে ‘প্রাচীন যুগ’, ‘মধ্যযুগ’ ও ‘আধুনিক যুগ’ হিসেবে যুগ বিভাজন করা হয়। এ যুগ বিভাজনও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের মানদ-কে প্রশ্ন না করে, ওই মানদ- অনুসারেই নিজ নিজ সমৃদ্ধি ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের বয়ান হয়ে দাঁড়ায়। নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস’ এ প্রবণতা থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি পারেননি। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্থানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু নীহার রায়ের প্রচেষ্টা রমেশ চন্দ্র মজুমদারের বাংলার ইতিহাসের তুলনায় অনেক বেশি জনমনস্ক। ‘ঐতিহাসিক’ যুগ আর প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাশাপাশি ‘আদি ঐতিহাসিক’ ও ‘আদি মধ্যযুগ’ পদের ব্যবহারও আছে। অনেকে (যেমন হারমান কুলকে বা দাউদ আলী) আদি মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক সময়ের শুরু পর্যন্ত সময়কে মধ্যযুগ বলেন। একদল ঐতিহাসিক রাজবংশের নামে যুগ বিভাজন করেন আর সেই যুগ বিভাজনই আমাদের বিদ্যায়তনগুলোয় জনপ্রিয় টেক্সট বইগুলোয় সবচেয়ে প্রচলিত; যেমনমৌর্য যুগ, কুশান যুগ, গুপ্ত যুগ, পাল যুগ, মোগল যুগ ইত্যাদি। এ ধরনের যুগ বিভাজন খুবই বিপজ্জনক ও সমরূপকারী এবং উচ্চবর্গের ইতিহাসচৈতন্যের উপস্থাপনকারী। রাজবংশের/শাসকদের বংশপরিচয় দিয়ে যুগ/কালপর্ব চিহ্নিত করার অর্থ হচ্ছে এ কথা ধরে নেয়া যে রাজবংশের বদলের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি আর বস্তু সংস্কৃতি পাল্টে যায়। সাম্প্রতিককালের ইতিহাস লিখনে ঐতিহাসিকরা তাই অনেক সতর্ক পর্যালোচনামূলক অবস্থান নেন ঐতিহাসিক কালানুক্রম ও যুগ বিভাজন প্রসঙ্গে।
৩. ‘মুসলমান’ নয়; কারণ, বিভিন্ন দলিলপত্র ও লিখিত সূত্র মারফত দেখা গেছে, তৎকালীন সময়ে ‘মুসলমান’ নামক পদ কোনো বহিরাগত জনগোষ্ঠীর সত্তা বা পরিচয় প্রকাশের জন্য ব্যবহূত হতো না। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা এলেও সমসাময়িক সংস্কৃত লিখনীতে তাদের তুর্কি হিসেবে, কখনো অপমানসূচক ম্লেচ্ছ বা যবন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছি। তাদের নিজেদের লেখা বিবরণীতেও নিজেদের তারা মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত করেননি। মধ্যযুগকে ‘মুসলমান’ বা ‘ইসলামী’ শাসনামল হিসেবে চিহ্নিত করাটা পরবর্তীকালের ঔপনিবেশিক ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের সৃষ্ট। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ইতিহাসে হিন্দু যুগ বা বৌদ্ধ যুগ বলেও কোনো বর্গ নেই। ওই সময়ের শাসকদের হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করাও তাই কালবিভ্রান্তিকর। কোনো নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষের সত্তাকে ‘হিন্দু’ হিসেবে চিহ্নিত করাটা আদি মধ্যযুগ-পরবর্তী ঘটনা। দেখুন, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, ইন্টারোগেটিং ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি: ভয়েসেস ফ্রম ইন্ডিয়াস এনশিয়েন্ট টেক্সট। ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের ২০১৪ অধিবেশনে পঠিত সভাপতির ভাষণ। আরো দেখুন ডেভিড লোরেনজেন, ‘হু ইনভেন্টেড হিন্দুইজম: এসেস অন রিলিজিয়ন ইন হিস্ট্রি’, (যোদা প্রেস, দিল্লি, ২০০৬)।
৪. জুলিয়া শ, বুড্ডিস্ট ল্যান্ডস্কেপ ইন সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ান সাঁচি হিল অ্যান্ড আর্কিওলজিস অব রিলিজিয়াস অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ, সি. থার্ড সেঞ্চুরি বিনি টু ফিফত সেঞ্চুরি এডি, (লেফট কোস্ট প্রেস, লন্ডন, ২০১৩)। জেসন হকস, ‘দ্য ওয়াইডার আর্কিওলজিক্যাল কনটেক্সটস অব দ্য বুড্ডিষ্ট স্তূপা সাইট অব ভারহুত’ আর আকিরা সিমাদা, ‘অমরাবতী অ্যান্ড ধান্যকটক: টাইপোলজি অব মনাসটিক স্পেসসে ইন এনশিয়েন্ট ইনডিয়ান সিটিস’। দুটো প্রবন্ধই জেসন হকস ও আকিরা সিমাদা সম্পাদিত ‘বুড্ডিস্ট স্তূপাস ইন সাউথ এশিয়া: রিসেন্ট আর্কিওলজিক্যাল, আর্ট হিস্টোরিক্যাল অ্যান্ড হিস্টোরিক্যাল পার্সপেক্টিভস’, (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লি, ২০০৯) বইয়ে সংকলিত। আরো দেখুন, স্বাধীন সেন, এ. কে. এম. সাইফুর রহমান ও সৈয়দ মোহাম্মদ কামরুল আহছান, ‘ক্রসিং দ্য বাউন্ডারিস অব দি আর্কিওলজি অব সোমপুর মহাবিহার: অল্টারনেঠিভ অ্যাপ্রোচেস অ্যান্ড প্রোপোজিশনস’, প্রত্নতত্ত্ব ২০, ২০১৪ , বিশেষ করে নোটস।
৫. ফ্রেডেরিখ এশার, নালন্দা: সিচুয়েটিং দ্য গ্রেট মনাসট্রি। মার্গ, ২০১৫। স্বাধীন সেন: প্রত্নতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com