প্লাস্টিকের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত প্রচেষ্টা- সাড়ম্বরে পালিত হলো মাত্র ক’দিন আগে। এ প্রচেষ্টায় যারা জড়িত ছিলেন তাদের ধন্যবাদ। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকার ও সরকারের এ সম্পর্কিত মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ প্রশংসার দাবিদার। এ উদ্যোগ অবশ্যই জনহিতকর ও জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তায়। কিন্তু খোলাবাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত এই উদ্যোগকে প- করে দিতে পারে। সব ভোজ্যতেল প্লাস্টিকের ব্যাগে সরবরাহ করা হবে, এটিই কিনতে ও খেতে হবে। ভেজাল ঠেকানোর নামে এ উদ্যোগ বন্ধের সাথে একমত। কিন্তু মাত্র ক’দিন আগে প্লাস্টিকবিরোধী যে অবস্থানের কথা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হলো, উদযাপন করা হলো, তার সাথে এর সাযুজ্য বোধগম্য নয়! ভেজাল নিরোধের নামে প্লাস্টিকের ব্যাগে তেল সরবরাহ করলেই কি ভেজালের দৌরাত্ম্য থেমে যাবে? ভেজাল কি আর কোথাও নেই? আমাদের দেশে চাল, ডাল, চিনি, লবণে এমনকি ওষুধে ভেজাল; সেখানে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। শুধু রোজার সময়ে একটু হইচই দেখা যায়। এরপরই সবই আবার কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমের অতলান্তে হারিয়ে যায়। এ ব্যাপারে ভেজাল নিরোধক আইনের কঠোর ও নিরপেক্ষ প্রয়োগই কেবল ভেজাল ঠেকাতে পারে। সাথে সাথে ভেজালের ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করার পদক্ষেপ এ ধরনের কার্যক্রমকে নিঃসন্দেহে সফল করার অন্যতম প্রধান শর্ত। সর্বস্তরের জনগণের ভেজালবিরোধী মানসিকতাই কেবল পারে ভেজাল ঠেকাতে। এ ছাড়াও বছরব্যাপী ভেজালবিরোধী অভিযান চলমান থাকা প্রয়োজন। আমাদের মতো মধ্যম আয়ের বিভিন্ন দেশ এটিকে কিভাবে ঠেকিয়েছে তাও দেখা দরকার। ভেজাল ঠেকানোর জন্য তেলের ব্যাপারে প্রসঙ্গটি এসেছে। অথচ আমরা অন্য কোথাও ভেজাল ঠেকাতে পারিনি। প্লাস্টিকের ব্যাগে দিলেই তেলের ভেজাল ঠেকানো যাবে তার নিশ্চয়তাই বা কতটুকু? চিনি, লবণ, চাল সবই এখন প্লাস্টিকের ব্যাগে পাওয়া যায়; এগুলোতে ভেজাল নেই? এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় না। মাঝে মধ্যেই এসবের ভেতর বিষাক্ত দ্রব্যের অস্তিত্ব নিয়ে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়। ভেজাল প্রতিরোধ করতে হলে ভেজালের মূল জায়গায় হাত দিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে গ্রামীণ জনপদের অধিবাসীদের কথা চিন্তা করা দরকার। তাদের আর্থিক সঙ্গতি ও ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করা দরকার। তারা কখনো পাঁচ লিটার তেল একসাথে ক্রয় করেন না। তারা এক লিটার কিংবা বড়জোর দুই লিটার তেল ক্রয় করেন। তবে বেশির ভাগ ভোক্তা দোকানে গিয়ে সচরাচর ২৫ অথবা ৫০ টাকার তেল ক্রয় করেন। এখন ২৫ বা ৫০ টাকা দিয়ে তেল তারা কিনতে পারবেন না। বাধ্য হয়ে ২৫০ বা ৫০০ গ্রাম তেল কিনতে হবে। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে এ পরিমাণ তেল কেনার সামর্থ্য বেশির ভাগ ভোক্তারই নেই, তবু বাধ্য হবে কিনতে। এতে জনগণের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। অপর দিকে, প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের কথাটিও ভাবা দরকার। বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামের প্রতিটিতে গড়ে ১০০ পরিবার কমপক্ষে মাসে ৫০০ গ্রামের তিনটি প্লাস্টিকের ব্যাগ মাটিতে ফেললে পাঁচ বা সাত বছর পর এ দেশের মাটির কী অবস্থা হবে- ভাবা যায় কি? যাও দু-একটি পুকুর-বিল-খাল রয়েছে, সব উধাও হয়ে যাবে। জমি উর্বরাশক্তি হারাবে। ফসলের পরিমাণ কমবে মারাত্মকভাবে। শুধু যারা প্লাস্টিক ব্যবসার সাথে জড়িত, তারাই লাভবান হবেন। অপর দিকে, প্লাস্টিকের প্যাকেটজাত তেলের উচ্চমূল্য ভোক্তাদেরই বহন করতে হবে। সরকার লাভবান হবে ভ্যাট থেকে। অপর দিকে, ক্ষতি ও হুমকির মুখে পড়বে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য। অতিরিক্ত মূল্য গুনতে হবে জনগণকে। প্লাস্টিক একটি অপচনশীল দ্রব্য, কখনো পচে না। এভাবে যদি প্লাস্টিকের প্যাকেট মাটিতে জমা হতে থাকে তাহলে আগামী ১০ বছর পর এ দেশে আবাদি জমির পরিমাণ সীমিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। সব আবাদি জমি প্লাস্টিকে সয়লাব হয়ে যাবে। সুতরাং আমরা মনে করি, এ ধরনের একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে খাদ্যনিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট মিলমালিক ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে পরিবেশের ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের ব্যাপারে সমীক্ষা চালানো দরকার। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না- দেশ ও দেশের মানুষ সুস্থ ও সক্ষম থাকলেই ব্যবসায় থাকবে। দেশ ও দেশের মানুষ না থাকলে ব্যবসায়ও থাকবে না।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ,