রাসূলে করিম সা: কখনো তাহাজ্জুদ ছাড়েননি। ছুটে গেলে কাজা করতেন। নিজে আদায় করতেন এবং সাহাবায়ে কেরাম ও পরিবারের লোকজনকেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তা আদায়ের জন্য উৎসাহিত করতেন। একদিন জিবরাইল আ: নবীজীকে একটি অসাধারণ কথা জানালেন। তা হলো- হে মুহাম্মদ! মুমিনের মর্যাদা কিয়ামুল লাইল বা রাতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায়ের মধ্যে, আর তাঁর সম্মান মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষিতার মধ্যে (মুসতাদরাকে হাকেম-৭৯২১)। এ থেকে বোঝা যায়, তাহাজ্জুদ নামাজ মুমিনের মর্যাদার সিঁড়ি। জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম উপায়। সফলতার চাবিকাঠি। সর্বোপরি আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও প্রিয় হওয়ার অনন্য আমল।
তাহাজ্জুদের গুরুত্ব : পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরই যে নামাজ আল্লাহর কাছে প্রিয় তা হলো তাহাজ্জুদ। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবীজী সা: ইরশাদ করেন, ‘ফরজ নামাজের পর উত্তম নামাজ রাতের নামাজ, অর্থাৎ তাহাজ্জুদ’ (সহিহ মুসলিম-২৭২৫)। উরওয়া রাহ. বলেন, আয়েশা রা: বলেন, (নবীজী) রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত বেশি নামাজ পড়তেন যে, তাঁর পা মোবারক ফুলে যেত। এ দেখে তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এত কষ্ট করছেন, অথচ আপনার পূর্বাপর সব গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে! রাসূল সা: বললেন, ‘আমার কি উচিত নয় যে, (এই মহা অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে) আমি একজন পূর্ণ শোকর আদায়কারী বান্দা হবো’ (বুখারি-৪৮৩৭, মুসলিম, -২৮২০)? নবীজী সা: তাহাজ্জুদ নামাজ স্বেচ্ছায় তো ছাড়তেনই না, কখনো অনিচ্ছায় ছুটে গেলেও কাজা করে নিতেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা: থেকেই বর্ণিত- রোগব্যাধি কিংবা অন্য কোনো কারণে যদি রাসূল সা: তাহাজ্জুদ আদায় করতে না পারতেন, তবে দিনের বেলায় ১২ রাকাত আদায় করে নিতেন’ (মুসলিম-৭৪৬)।
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত: তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত অনেক। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিস শরিফে তা বিধৃত হয়েছে। হজরত আবু উমামা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলে করিম সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা কিয়ামুল লাইলের প্রতি যতœবান হও। কেননা, তা তোমাদের পূর্ববর্তী সালেহিনের অভ্যাস ও রবের নৈকট্য লাভের বিশেষ মাধ্যম। আর তা পাপরাশি মোচনকারী এবং গোনাহ থেকে বাধা প্রদানকারী’ (তিরমিজি-৩৫৪৯; মুসতাদরাকে হাকেম-১১৫৬)।
পবিত্র কুরআনে মুত্তাকিদের জন্য জান্নাতের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সে দিন নিশ্চয়ই মুত্তাকিরা থাকবে প্রস্রবণবিশিষ্ট জান্নাতে’ (সূরা জারিয়াত-১৫)। সাথে তাদের কিছু গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যের বিবরণও এসেছে। তন্মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত’ (সূরা জারিয়াত (৫১) : ১৮)। ইবাদুর রহমান/রহমানের বান্দাদের কতিপয় বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে কুরআনে কারিমের সূরা ফুরকানে। সেখানেও উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যটি বিবৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- ‘আর তারা রাত অতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদারত হয়ে এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে’ (সূরা ফুরকান-৬৪)। সূরার শেষের দিকে তাদের পুরস্কারের বিবরণও এসেছে- ‘তাদের প্রতিদান দেয়া হবে জান্নাতের সুউচ্চ কক্ষ। কারণ তারা ছিল ধৈর্যশীল। তাদেরকে সেখানে অভ্যর্থনা করা হবে অভিবাদন ও সালামসহকারে। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আশ্রয়স্থল ও বসতি হিসেবে তা কত উৎকৃষ্ট’ (সূরা ফুরকান : ৭৫-৭৬)! সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা: বলেন, রাসূল সা: যখন মদিনায় এলেন, মানুষের সাথে আমিও তাঁকে একনজর দেখার জন্য বের হলাম। তাঁর চেহারা মোবারকের দিকে যখন তাকালাম, আমার বিশ্বাস হয়ে গেল, এ কোনো মিথ্যাবাদীর চেহারা হতে পারে না। তখন তাঁর মুখে সর্বপ্রথম আমি এই কথাগুলো শুনেছি- হে লোকসকল! সালামের প্রসার করো। মানুষকে আহার করাও! আর রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, তখন তুমি নামাজ আদায় করো (তাহাজ্জুদ আদায় করো)!
তবেই নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে’ (তিরমিজি-২৪৮৫; ইবনে মাজাহ-৩২৫১)। অন্য এক হাদিসে পাওয়া যায়, উপরোক্ত গুণাবলি যাদের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে, জান্নাতে থাকবে তাঁদের জন্য বিশেষ মর্যাদা। হজরত আবু মালেক আশআরি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই জান্নাতে রয়েছে এমন কিছু কক্ষ/প্রাসাদ, যার বাইরে থেকে ভেতরাংশ দেখা যাবে, ভেতর থেকে বহিরাংশ দেখা যাবে। এগুলো আল্লাহ তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন, যারা মানুষকে খাবার খাওয়ায়, কোমল ভাষায় কথা বলে, ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখে, সালামের প্রসার ঘটায় এবং রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তারা নামাজে দ-ায়মান থাকে’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস-২২৯০৫, ইবনে হিব্বান-৫০৯; জামে তিরমিজি, হাদিস-২৫২৭)।
তাহাজ্জুদ আদায় করবেন যেভাবে
দুই রাকাত দিয়ে শুরু করা : প্রথমে ছোট সূরা দিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে দুই রাকাত আদায় করবে। কারণ রাসূল সা: এমনটি করতেন। আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: রাতে যখন নামাজের জন্য উঠতেন, শুরুতে হালকা করে দুই রাকাত আদায় করতেন’ (মুসলিম, হাদিস-১৭৫৬; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা-৬৬৮২)। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবীজী সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ যখন রাতে উঠবে, সে যেন প্রথমে হালকা দুই রাকাতের মাধ্যমে শুরু করে’ (মুসলিম-৭৬৮; আবু দাউদ-১৩২৩)।
নিয়মিত আদায় করা : নবীজী নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। যেকোনো আমল নিয়মিত আদায় করা আল্লাহর কাছে অতি পছন্দনীয়। হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল, যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়’ (বুখারি-৬৪৬৪, মুসলিম,-৭৪২)। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা:-কে রাসূল সা: উপদেশ দিয়ে বলছেন, ‘হে আব্দুল্লাহ! অমুকের মতো হয়ো না। সে নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করত; কিন্তু পরবর্তীতে আবার ছেড়ে দিলো’ (বুখারি-১১৫২, মুসলিম-২৭০৩)।
ঘুমের চাপ হলে বিশ্রামে চলে যাওয়া : অনেকসময় এমন হয় যে, ঘুমের চাপ এত বেশি থাকে যে, আমল করাই কঠিন হয়ে যায়। নামাজে কী পড়ছে, কয় রাকাত পড়ল কিছুই বুঝতে পারে না। এ অবস্থায় নামাজ জারি না রেখে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেয়া চাই। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যদি (রাতের) নামাজে কারো তন্দ্রা আসে সে যেন শুয়ে যায়, যতক্ষণ না তার ঘুম দূর হয়। কেননা, এ অবস্থায় হয়তো সে ইসতিগফার করতে গিয়ে নিজেকে গালি দিয়ে বসতে পারে’ (বুখারি-২১২; মুসলিম-১৭৮৫)। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘যখন কেউ রাতে নামাজে দাঁড়াল, কিন্তু (ঘুমের কারণে) তার মুখে উচ্চারিত কুরআন এত অস্পষ্ট শোনা যেতে লাগল যে কী বলছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, সে যেন শুয়ে পড়ে’ (মুসলিম-৭৮৭)!
তাহাজ্জুদের রাকাত : রাসূল সা: কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ চার রাকাত পড়তেন, কখনো ছয় রাকাত পড়তেন। কখনো আট রাকাত পড়তেন। কখনো ১০ রাকাত পড়তেন। সুতরাং তাহাজ্জুদের নামাজ ১০ রাকাত পর্যন্ত পড়া রাসূল সা: থেকে আমরা সহিহ হাদিসে পাই। এর চেয়ে বেশি পড়া যাবে না- এমন নয়। যেহেতু এটি নফল নামাজ তাই যত বেশি পড়া যায় ততই সওয়াব। তাই ইচ্ছেমতো পড়া যায়। সেই সাথে চার রাকাতের কম পড়লে তা তাহাজ্জুদ হবে না- বিষয়টি এমনও নয়। তাই দুই রাকাত পড়লেও তা তাহাজ্জুদ নামাজ হিসেবেই গণ্য হবে। তাহাজ্জুদ নামাজ দুই রাকাত দুই রাকাত করে পড়তে পারেন। অথবা চার রাকাত চার রাকাত করে পড়তে পারেন। তাহাজ্জুদের নিয়ত নফল বলেও করা যায়। সুন্নত বলেও করা যায়। আবার তাহাজ্জুদ বলেও করা যায়। অন্যান্য সাধারণ নফলের মতোই তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করবে। এর জন্য বিশেষ কোনো নিয়ম নেই (ফতোওয়ায়ে শামি-২/৪৫৫)। লেখক : ইমাম ও খতিব, মসজিদুল আমান, গাঙ্গিনার পাড়, ময়মনসিংহ