শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৫ পূর্বাহ্ন

সজনীকান্তের জীবনানন্দ

রহমান মতি
  • আপডেট সময় শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

জীবদ্দশায় কবি জীবনানন্দ দাশের অনেক ধরনের সমালোচনা হয়েছে। সেসব সমালোচনা নানা বাঁক নিয়ে জীবনানন্দকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে। তখনকার নামিদামী সমালোচকরা তাঁর সৃষ্টি, ব্যক্তিস্বভাব, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে সমালোচনা করেছেন। এদের মধ্যে সজনীকান্ত দাস ছিলেন অন্যতম। তখন তিনি ‘শনিবারের চিঠি’-র ‘সংবাদ সাহিত্য’ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তিনি শুধু জীবনানন্দ দাশেরই ননরবীন্দ্রনাথ, নজরুল, প্রমথ চৌধুরী, দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখেরও সমালোচনা করেছেন। সমালোচনায় তাঁর বক্রভঙ্গিকেই তিনি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর ভেবেছেন। বক্র সমালোচনায় নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি করেন।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা ছিল তাঁর আক্রমণের সবচেয়ে বড় জায়গা। জীবনানন্দের কবিতা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সমালোচনায় বসতেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য জীবনানন্দ ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর সজনীকান্ত তাঁর ভুল স্বীকার করেন এবং জীবনানন্দকে সত্যিকার মহৎ আধুনিক কবি হিসেবে অকপটে স্বীকার করেন। সজনীকান্তের এমন উপলব্ধি পরবর্তিতে তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে রেখেছে। ভূমেন্দ্র গুহ বা সঞ্জয় ভট্টাচার্যদের ভাষ্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সমালোচনার একমুখী প্রবাহে সজনীকান্ত জীবনানন্দের কবিতাকে নানাভাবে গ্রাস করেছিল। জীবনানন্দের ‘সমারূঢ়’ কবিতাটি সমালোচনার এ ধরনের ধারাকে সরাসরি নির্দেশ করে এবং মধ্যকার গলদকে পানির মত স্বচ্ছ করে তোলে। সজনীকান্ত দাসের তৎকালীন সমালোচনার ভ্রান্তি এবং আমাদের বর্তমান পরিবর্তনশীল বিশ্লেষণ দুটিই সময়ের দাবি। সমালোচনার বিশেষ কিছু চুম্বকাংশ আমরা দেখব
ক. ‘সংবাদ সাহিত্য’ বিভাগে আক্রমণাত্মক সমালোচনার অংশ হিসেবে ‘জীবনানন্দ দাশ’ নামটিকেও আপত্তিকরভাবে তুলে ধরা হয়। ‘জীবানন্দ নহে’ বা ‘জিহ্বানন্দ নহে’ বলা হয়। এছাড়া ‘কবি গ-ার’ও বলা হয়।
এটি মূলত সজনীকান্তের ব্যক্তি আক্রমণের ভঙ্গি। ‘জীবানন্দ’ বা ‘জিহ্বানন্দ’; ‘কবি-গ-ার’ শব্দগুলিকে তিনি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেন। মানসিকতার নি¤œগামিতা এর নিয়ামক শক্তি।
খ. আশ্বিন ১৩৩৫-এর ‘শনিবারের চিঠি’-তে জীবনানন্দের ‘মাঠের গল্প’ শীর্ষক ‘কার্তিক মাঠের চাঁদ’ কবিতার একটি লাইনকে ঘিরে আপত্তি করেন সজনীকান্ত। লাইনটি হলÍ
মৃত সে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিল যারে!
লাইনটি নিয়ে সজনীকান্ত বলেন
এই প্রাণঘাতি কবিতা লিখিয়া বেচারা পৃথিবীর যেটুকু প্রাণ ছিল এই কবিতা লেখা হওয়ার পর তাহাও আর নাই।
সজনীকান্ত ধূসর পা-ুলিপি কাব্যের ‘আর্কেটাইপ’ ভঙ্গিকেই এখানে অস্বীকার করে বসেন। সৃষ্টিতত্ত্বের আদিম রহস্যকে বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষায় কবিতাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ, সমালোচক সজনীকান্তের নজরে তা আসেনি।
গ. শ্রাবণ ১৩৩৬-এর ‘শনিবারের চিঠি’-তে ‘প্রগতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বোধ’ কবিতার ‘মুদ্রাদোষ’ বিষয়ক জটিলতাকে তুলে ধরেন সজনীকান্ত। সঙ্গে ‘মাথার মতন হৃদয়’ লাইনটির আপত্তি তোলেন। বলেন
হৃদয়ের সহিত গোবরের তুলনা এই প্রথম।
‘মেয়েমানুষ’ সম্পর্কিত বক্তব্য নিয়ে বলেন-
সব করিয়াই দেখিয়াছেন। শুধু বিবাহ করিয়া ‘মেয়েমানুষেরে’ দেখেন নাই। দেখিলে ভালো হইত, গরিব পাঠকেরা বাঁচিত।
‘মাথা’ থেকে সৃষ্টি মানুষের চিন্তা যার রূপ কবিতায় ‘বোধ’ নামে এসেছে তাকে ঘিরে ‘মুদ্রাদোষ’ যে কোনো ব্যক্তির একক সত্তার স্বাতন্ত্র্যবাদী বৈশিষ্ট্য। সজনীকান্ত মাথার ভেতরে দেখতে পান ‘গোবর’ অর্থাৎ দেখার তির্যক ভঙ্গিই তাকে কবিতার মৌল বক্তব্য থেকে বহুদূরে নিয়ে যায়। যেখানে তিনি অনর্থ ছাড়া অর্থ খুঁজে পান না। ‘মেয়েমানুষ’-কে তিনটি প্রবাহে কবিতায় উপলব্ধি করা হয়েছে। সজনীবাবু পারিবারিক আক্রমণের অংশ হিসেবে দেখেন যা হাস্যকর।
ঘ. ‘ক্যাম্পে’ কবিতার অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে মাঘ ১৩৩৮-এর ‘শনিবারের চিঠি’তে সমালোচনা করেন। ‘পুরুষহরিণ’ শব্দটিকে অশ্লীল বলেন। জীবনানন্দ ‘পুরুষহরিণ’ কে সাম্রাজ্যবাদী পৃথিবীর অপশক্তির প্রকাশরূপে দেখানো ‘চিতা’র প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে তুলে ধরেন। ‘ক্যাম্পে’-র মত কবিতা বাংলা কবিতায় নতুন সংযোজন। তাঁর বক্রতার চোখ তা বোঝেনি।
ঙ. বৈশাখ ১৩৪৪ সংখ্যায় ‘বেড়াল’ কবিতা নিয়ে লেখেন-
Cat-out of bag যে হইতেছে না ইহাই আশ্চর্য। এবং ইহাই কবিতা।
সজনীকান্তের কাছে বেড়ালটি out of bag হচ্ছে না অর্থাৎ থলের বেড়াল হিসেবেই দেখেন। জীবনানন্দ প্রতীকী চেতনায় ‘বিড়াল’কে উন্মুক্ত করেন। সাংকেতিক ভাষায় কবিতার নাম ‘বেড়াল’ যে ক্রমশ তার রূপের বদল ঘটায়। অনুভূতিতে বেড়ালটি ‘বিষয়’ থেকে ‘বিষয়ী’ হয়ে পড়ে। মাছের কাঁটার সফলতা থেকে বেড়ালটির কর্মকা- শুরু আর অন্ধকারের ভিতর পৃথিবীতে বহমান হবার আশ্চর্য পরাবাস্তব ভঙ্গি কবিতার আধুনিক শক্তিকে আশাবাদী করে তোলে। সজনীকান্তের out of bag-এর ভিত্তি আর থাকেই না সেখানে।
চ. অগ্রহায়ণ ১৩৪৪ সংখ্যায় ‘সমারূঢ়’ কবিতায় ‘অধ্যাপক’ প্রসঙ্গকে ব্যঙ্গ করে সজনীকান্ত বলেন
সবই মিলিয়া যাইতেছে, কেবল মৃত কবিদের মাংস-কৃমি খোঁটা অনুবাদ কবিতা বেচিয়া হাজার দেড়েক আসিয়াছে কিনা আমাদের জানা নাই। মনে হয়, ওটা অত্যুক্তি। কিন্তু কি সাংঘাতিক গালাগাল!
সজনীকান্ত নিজে যা করেছেন তাও সাংঘাতিক। ‘সমারূঢ়’ কবিতার ‘অধ্যাপক’ পূর্বসূরিদের কাছ থেকে যে অনুপ্রেরণা নেন তাকে চৌর্যবৃত্তির দৃষ্টিতে সজনীকান্ত দেখেন। ‘অ-সমালোচক’কে জীবনানন্দ ব্যঙ্গ করেন তাঁর অর্থাৎ সমালোচকের উপলব্ধিজাত সমালোচনার অদক্ষতার জন্য। একে সজনীকান্ত গ্রহণ করেননি এখানে। কারণটিও খুব স্পষ্ট তিনি নিজেই সে কাজটি করেছেন।
ছ. আশ্বিন ১৩৪৭ সংখ্যায় ‘ঘোড়া’ কবিতার সমালোচনায় সজনীকান্ত নাম দেন ‘ঘোড়ার ডিম’। ‘Part’ বিষয়কে ‘ঐড়ষব’ করার প্রবণতার কথা বলেন। কবিতাটির শেষ ২টি লাইনের জন্য আপত্তি করে বলেন
ধর্মত বলিতেছি, কপিরাইট অ্যাক্টের ভয়ে শেষ ২টি লাইন বাদ দিয়া গোটা কবিতাটিই উদ্ধৃত করিয়াছি।
‘ঘোড়া’ কবিতার সময়চেতনা সজনীকান্তের কাছে ধরা পড়ে নি। ‘Part কে নাকি জীবনানন্দ ‘ঐড়ষব’ করেছেন এ কবিতায় অথচ ঘোড়া কোনো চধৎঃ সত্তাই নয়। এটি মহাকালীন সময়চেতনার পূর্ণরূপ। শেষ দুই লাইন নিয়ে কপিরাইট অ্যাক্টের কথা তোলেন। শেষ দুই লাইনে আছে
সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;
এইসব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্ধতার জোছনাকে ছুঁয়ে।
এখানে কপিরাইট অ্যাক্ট কোথায় কার্যকর হবে তার কোনো হদিস সজনীকান্ত দেননি। প্রবহমান সময়ের এক একটি ফুঁ হল গতিময়তা। এভাবে সময় চলতে চলতে ‘ঘোড়া’ হয়ে পড়ে বিবর্তনের ফল। কবিতার এ বাণী সত্য ও আধুনিক।
জ. ফালগুন ১৩৪৯ সংখ্যায় ‘দোয়েল’ কবিতাকে সজনীকান্ত ‘টাইপ কবিতা’ বলেন। এ মন্তব্যটিও সঠিক নয়। ‘দোয়েল’ কবিতার কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে-
কার লাশ! কেটেছিলো কারা?
সারা পৃথিবীতে আজ রক্ত ঝরে কেন?
সে সব কোরাসে একতারা।
কবিতার এ বক্তব্যগুলো ‘টাইপড’ নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে একজন উপনিবেশী নাগরিক হিসেবে জীবনানন্দ দাশ তাঁর সময়চেতনা থেকে কবিতাটি লেখেন। জিঘাংসা বা অত্যাচারের মানসিকতা আদিম যুগের মত সে যুগে এসেছে। সেজন্য ‘দোয়েল’টি শেষপর্যন্ত আদিম হয়ে যায়। বক্তব্য যেভাবে শুরু হয় শেষের লাইনের সঙ্গে সে সুর আর থাকে না। পাল্টে যায়। হত্যা, মৃত্যু, লাশ ইত্যাদির পুনরাবৃত্তিতে সুর যেন সব এক হয়ে কোরাস ভিত্তিক একতারা হয়ে যায়। লাইনটি প্রবল প্রতীকী।
এতসব সমালোচনায় সজনীকান্ত একমুখী প্রবাহের পরিচয় দেন। এই একমুখীতার ধারাকে তিনি যেভাবে বহমান রেখেছেন তাতে তিনি নিজেই ‘টাইপড’ হয়েছেন। ব্যঙ্গ, বক্রতা, ব্যক্তি আক্রমণ ইত্যাদি সমালোচনার এক একটি ভঙ্গি কিন্তু তা যদি অযৌক্তিক ও অসচেতন হয় তাহলে সমালোচকদের দৌর্বল্য সহজেই অনুমেয় হয়। সজনীকান্ত নিজেকেই তুলে ধরতে গিয়ে তাঁর সমালোচনাকে দুর্বল করেন। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর সজনীকান্তই বড় কবির মর্যাদায় জীবনানন্দকে অভিহিত করেন। সমালোচক হিসেবে তিনি প্রথমে জীবনানন্দ সম্পর্কে যা বলেন মৃত্যু পরবর্তী বদলে যাওয়া স্বরে তার মূল্য সামান্যই থাকে। সজনীকান্ত দাশের সমালোচনাগত বিভ্রান্তি বলে দেয় সমালোচনা সবার কাজ নয়।-বাংলাট্রিবিউন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com