ভারত সীমান্তবর্তী জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা আগাইর গ্রাম। আর এই গ্রামেই ভূ-তাত্বিক জরিপ এর ড্রিলিং কার্যক্রম চালিয়ে ৭ বছর আগে মাটির নিচে পাওয়া গেছে উন্নতমানের ‘লাইমষ্টোন’ অর্থাৎ ‘চুনাপাথর’ এবং ‘হোয়াইট কে’ বা ‘সাদামাটি’। সন্ধানের দীর্ঘ বছর পার হলেও আজো চুনাপাথর ও সাদামাটি উত্তোলনের কোন কার্যর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। জানা যায়, খনিজ সম্পদ উন্নয়নে ভূ-বৈজ্ঞানিক কার্যক্রমের আওতায় ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদে খনন শেষে ১ হাজার ৪৯৪ ফুট থেকে ১ হাজার ৫৩০ ফুট পর্যন্ত অর্থাৎ ৩৬ ফুট পুরু চুনাপাথরের স্তর পাওয়া গেছে। এরপর ১,৫৩০, থেকে ১,৭০০ ফুট পর্যন্ত রয়েছে শেল, কে ও স্যান্ডস্টোনের স্তর। ১,৭০০ থেকে ১,৭৬০ ফুট পর্যন্ত প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে পাওয়া গেছে সাদামাটি বা হোয়াইট কে। যা সিরামিক পণ্য ও টাইল্স তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আর ১,৭৬০ ফুট থেকে ১,৭৯০ ফুট পর্যন্ত ওয়েদার জোন। সেই সময় খনিজসম্পদের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে উপজেলার প্রত্যন্ত আয়মা রসুলপুর ইউনিয়নের আগাইর গ্রামে ভূ-পদার্থিক জরিপ চালানো হয়। প্রথম দফায় খনিজ সম্পদের সম্ভাব্যতা পাওয়া যায়। চুড়ান্ত অনুসন্ধানের জন্য গ্রামের ৪০ শতাংশ জায়গা লিজ নিয়ে কুপ খনন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৯ জন প্রকৌশলীসহ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের ২৯ সদস্যের ভূ-তাত্বিক জরিপ দল অনুন্ধান শুরু করে। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বিদেশী কোন বিশেষজ্ঞ বা ভূ-তাত্বিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ছাড়াই সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে জরিপ করা হয়। ড্রিলিং চলাকালে মাটির নিচ থেকে পাওয়া খনিজ পদার্থের বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় ভূ-তাত্বিক অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। সেখানে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নমুনা বিশ্লেষণের পরে সংগ”হীত খনিজ পদার্থগুলো ‘উন্নতমানের চুনাপাথর’ বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন তৎকালীন ভূ-তাত্বিক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মনিরা আক্তার চৌধুরী। তার ভাষ্যমতে, চুনাপাথরের মজুদ রয়েছে প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে। ১২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৮ কিলোমিটার প্রস্থ্যের একটি বেসিনে এ পাথর রয়েছে। এই বেসিনের কেন্দ্রে পাথরের পুরুত্ব অনেক বেশি হলেও চারপাশে পুরুত্ব কম থাকতে পারে। পাঁচবিবির চুনাপাথরের বড় ধরণের মজুদ থেকেই দেশে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামালের চাহিদার পুরোটাই মেটানো সম্ভব হবে এবং সেটা দেশের অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করবে। জরিপ সময়ে মাটির নিচ থেকে সংগ্রহ করা খনিজ পদার্থগুলো উন্নতমানের চুনাপাথর এ কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে এ প্রকল্পে কর্মরত ভূ-তাত্বিক প্রকৌশলীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু একই সাথে উদ্বিগ্ন ও শংকিত যে, প্রায় তিন যুগ পূর্বে জয়পুরহাটের মাটির নিচে বিশাল এলাকা জুড়ে পাওয়া উন্নতমানের চুনাপাথরের সন্ধান পাওয়ার পর আজও তা উত্তোলন করা হয়নি। জয়পুরহাটের চুনাপাথরের খনিটিকে মজুদের তুলনায় ব্যয় সাশ্রয়ী নয় বলে অলাভজনক ঘোষণা দিয়ে সেখানে যে নয়নাভিরাম ইমারতগুলো তৈরি করা হয়েছিল তা একের পর এক সরকারী অফিস এবং অপোর অবসান ঘটিয়ে মহিলা ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পাঁচবিবির আবিস্কৃত খনিটির সম্ভাব্য মজুদ সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও এলাকাকে আশান্বিত করে তুলেছে। সিমেন্ট তৈরির প্রধান কাঁচামাল ‘কিংকার’ তৈরিতে ব্যবহার হয় ‘চুনাপাথর’, সিরামিক পণ্য টাইল্স শিল্পের জন্য সাদামাটি প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়। এগুলো উত্তোলনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার হোক এমনটাই আশা পাঁচবিবিবাসীর। দেশে প্রতি বছরই ব্যাপকভাবে আমদানি করতে হয় সিমেন্ট তৈরির বড় উপাদান চুনাপাথর। এখন পাঁচবিবি থেকে যত দ্রুত তা উত্তোলন করা যাবে, তত শিঘ্রই আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে। ভূ-গর্ভে এটির আশপাশে অন্য খনিজসম্পদ প্রাপ্তির সম্ভবনা বেশি। পাঁচবিবিতে চুনাপাথরের খনি এবং সাদামাটি আবিষ্কারের ঘটনা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য সু-সংবাদ। তবে এ থেকে কতটা সুফল পাওয়া যাবে, তা নির্ভর করছে এসব খনিজসম্পদ উত্তোলন ও ব্যবহারে দক্ষতার উপর। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্তি দায়িত্ব) মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন জানান, আমাদের অধিদপ্তরের কাজ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান করে তা উত্তোলনের জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে তথ্য প্রদান করা। এসবের সম্ভব্যতা যাচাই করে তা উত্তোলনের দায়িত্ব তাদের। খনিজ সম্পদ ও উন্নয়ন ব্যুরো’র (বিএমডি) মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আব্দুল খালেক মল্লিক বলেন, আমরা এ বিষয়ে বিভিন্ন জায়গায় যে সকল এলাকায় খনিজ সম্পদ পাওয়া গেছে সেসব এলাকার পরিবেশ ও সম্পদের ক্ষতি না করে কিভাবে এসব খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা যায সে বিষয়ে আমরা একটি পরিকল্পনা তৈরী করছি। যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে উপস্থাপন করা হবে।