শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৪ পূর্বাহ্ন

রাশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে চীন যে শিক্ষা নিয়েছে

ন্যান্সি কিয়ান
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

চীন আগামী অক্টোবরে ২০তম জাতীয় কংগ্রেসের প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, ওই কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে নজিরবিহীনভাবে তৃতীয় মেয়াদের জন্য দায়িত্বভার দেয়া হবে। সংগতকারণে অনেক পর্যবেক্ষকই সামনের অনিশ্চিত দিনগুলো, বিশেষ করে তাইওয়ান নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ দেখার জন্য কারো কোনো স্বচ্ছ গোলকের প্রয়োজন পড়ে না। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দেখে সেটি বোঝা যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নিজেদের দিক থেকে চীনের নেতারা রাশিয়ার দিকে এখন তাকিয়ে আছেন।
চীন গত ১০০ বছরের বেশির ভাগ সময়ই রাশিয়ার ঐতিহাসিক গতিপথ অনুসরণ করেছে। কিছু ক্ষেত্রে হুবহু অনুকরণও করেছে। বিশ শতকের গোড়াতে উভয় রাষ্ট্রই ছিল বৃহৎ সাম্রাজ্য। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল মান্ধাতা আমলের, যা সাম্রাজ্য দুটির জনগণকে বৈদেশিক আক্রমণ, দুর্নীতি, অসমতা এবং দারিদ্র্য থেকে রক্ষা করতে পারেনি। যদিও ১৯০০ সালে রাশিয়ার মাথাপিছু আয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছিল, তবে চীনের মাথাপিছু আয় ছিল রাশিয়ার অর্ধেক। ১৯৪৯ সালে নতুন প্রজাতন্ত্রটিকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সোভিয়েত ব্যবস্থার আদলে গড়ে তোলা হয়েছিল। চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় রাষ্ট্রেই একটি নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি (কমান্ড ইকোনমি) বাজারকে প্রতিস্থাপন করেছিল। একই সঙ্গে কী উৎপাদন করবে, কী খাবে, মানুষ কোথায় কাজ করবে, কোথায় থাকবে, কী বলবে, পড়বে এবং লিখবেÍতাও নিয়ন্ত্রণ করেছিল রাষ্ট্র। এককথায় বলতে গেলে জনগণের জীবনের প্রতিটি দিকই প্রভাবিত করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে বেইজিং এবং মস্কোকে উৎপাদন বজায় রাখতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কারণ শ্রমের জন্য শ্রমিকদের খুব বেশি প্রেষণা দেয়া হতো না। জনগণকে কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য করার অন্যান্য কৌশলসহ সোভিয়েত এবং চীনা সরকারগুলো এমন এক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল, যা কৃষকের অনাহারের হুমকিতে ফেলেছিল। ওই ব্যবস্থায় যদি উৎপাদনের রাষ্ট্রনির্ধারিত কোটা পূরণ না করা হতো, তাহলে অনাহারই ছিল তাদের পরিণাম। এ পদ্ধতির ফলে ১৯৩২-৩৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে (ইউক্রেনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর হারসহ) ৭ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল। সমরূপভাবে ১৯৫৯-৬১ সালে চীনে দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল সাড়ে ১৬ থেকে ৪৫ মিলিয়নের মতো লোক।
বিস্ময়ের কিছু নেই, এ বিপুল অর্থনৈতিক বিপর্যয় শাসন ব্যবস্থার জন্য একটি গুরুতর রাজনৈতিক হুমকিও তৈরি করেছিল। সর্বোপরি, সোভিয়েত ও চীনা কমিউনিস্টদের মনে করা হয়েছিল আধুনিকায়নকারী হিসেবে, যারা জনগণকে ক্ষমতায়ন করবে এবং কয়েক শতকের নিপীড়ন, দুর্নীতি ও চরম দারিদ্র্যের অবসান ঘটিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেবে। বৈশ্বিক টালমাটাল সময়ে টিকে থাকতে প্রতিটি শাসকই বিদেশী দখলদারদের বিরুদ্ধে জনগণের রক্ষক হিসেবে তাদের ভূমিকার কথা প্রচার করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবশ্য অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। যুদ্ধে তাদের মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ২০-২৭ মিলিয়ন এবং ১৫-২০ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছিল। তদুপরি তারপরের দশকগুলোয় চলা শীতল যুদ্ধ বিদেশী আক্রমণের ভয়কে সক্রিয় রেখেছিল এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনকে বৈধতা দিয়েছিল।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাষ্ট্রের কী করা উচিত নয়, তার একটি মডেলে পরিণত হয় রাশিয়া। দেশটির মাথাপিছু আয় ১৯৮৯ ও ১৯৯৬ এ সময়পর্বের মধ্যে ৫০ শতাংশ কমে যায় এবং আরো এক দশক তা আর ১৯৮৯-এর স্তরে পৌঁছেনি। দুর্নীতি আর অপরাধ বাড়ে বিপুল মাত্রায়। বেকারত্ব ১৯৯১ সালের ৫ শতাংশ থেকে ১৯৯৮ সালে ১৩ শতাংশে উন্নীত হয়। সমান্তরালে বৃদ্ধি পায় মদ্যপান ও মাদকের মতো সামাজিক সমস্যাগুলো। ১৯৯৩ সালে মাথাপিছু অ্যালকোহল সেবন ১৪ দশমিক ৪ লিটারে (১০০ শতাংশ অ্যালকোহল) পৌঁছে, যা ১৯৮৯ সালে ছিল ১১ দশমিক ৭ লিটার। ১৯৯৪ সালে প্রতি লাখে ৪৭ জন অ্যালকোহলজনিত কারণে মারা যায়, যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তিন গুণ বেশি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং আরো যতেœর সঙ্গে নিজের উদারীকরণের পথ অনুসরণ করেছে। রাশিয়ায় জোরালো রাজনৈতিক উদারীকরণ যে কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করেছিল এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিলামের মধ্য দিয়ে যে বিলিয়নেয়ার ‘অলিগার্কদের’ উত্থান ঘটিয়েছিল, সেটি স্বীকার করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি একই পরিণতি এড়াতে খুব চেষ্টা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারীকরণ এবং স্থানীয় নির্বাচনের মতো রাজনৈতিক সংস্কারকে খুব সতর্কতার সঙ্গে আমলে নিয়ে দলটি ধীরে ধীরে অর্থনীতির পুনর্গঠন করেছে। অবিরত পরীক্ষা-নিরীক্ষার (ট্রায়াল অ্যান্ড এরর) মাধ্যমে এগিয়েছে তারা। একই সঙ্গে সম্পদের বণ্টনে এড়িয়েছে আকস্মিক ও অস্থিতিশীল পালাবদলের পথ।উদারীকরণ চীন ও রাশিয়াকে আপেক্ষিকভাবে সমতামূলক অর্থনীতি থেকে এমন এক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করেছে, যেখানে শীর্ষ ১ শতাংশ বিত্তশালী এক-তৃতীয়াংশ সম্পদের মালিক। ২০১৫ সালে চীনে নিচের ২৫ শতাংশ পরিবারের হাতে দেশটির মোট সম্পদের মালিকানা ছিল মাত্র ১ শতাংশ। অন্যদিকে রাশিয়ার নিচের অর্ধেক পরিবারের সম্পদের মালিকানা ছিল মাত্র ১৫ শতাংশ।
রাশিয়ার অলিগার্কদের মতো নতুন চীনা অভিজাতরা সাধারণত রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের জন্য আত্মম্ভরী, দুর্নীতিগ্রস্ত হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়। রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অলিগার্কদের ‘পরাভূত’ এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। চীনে দুর্নীতি কমাতে এবং আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মার মতো নতুন বিলিয়নেয়ারদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য শির আগ্রাসী প্রচারাভিযানও একইভাবে জনপ্রিয় হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমের সঙ্গে নতুন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও উভয় দেশের নেতাদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। রাশিয়া ও চীনের অনেক নাগরিকই এতে প্রলুব্ধ হয়েছে, ১৯৯১-পরবর্তী ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং তাইওয়ানের প্রতি মার্কিন সমর্থনের মাধ্যমে পশ্চিমারা তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। ফলে তাদের মধ্যে পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে। যেজন্য এক জরিপে দেখা যায়, রাশিয়ার তিন-চতুর্থাংশ মানুষ এবং চীনের বেশির ভাগ মানুষ ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে সমর্থন করে।
যদিও সময় বদলেছে, তবে জনপ্রিয়তার প্লেবুক বদলায়নি। কর্তৃত্ববাদী নেতারা এখনো দারিদ্র্য, দুর্নীতি এবং বিদেশী দখলকারদের বিরুদ্ধে সমতার রক্ষক হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে জনগণের কাছে জনপ্রিয় হতে চায়। ক্ষমতায় তাদের দখল যত বেশি বিতর্কিত, এ লড়াইয়ে তাদের সাফল্যের প্রয়োজনও তত বেশি। অর্থনৈতিক যুদ্ধে তাদের সাফল্য যত কম, তত বেশি তাদের প্রয়োজন হয় বাইরের শত্রুর। এটা কাকতালীয় নয়, ২০১২ সালে নজিরবিহীন তৃতীয় মেয়াদের জন্য পুতিনের বিতর্কিত প্রত্যাবর্তনের পরে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় এবং চলতি বছর ইউক্রেনে রাশিয়া আক্রমণ চালিয়েছে। আসলে এটাই ছিল তার একটা স্বাভাবিক কৌশল। তদুপরি এর সঙ্গে ২০১৪ সালের পর থেকে দেশটিতে আয় (এবং তেলের দাম) হ্রাস এবং বেড়ে চলা দুর্নীতির বিষয়টি মিলে গেছে। আসন্ন অক্টোবরে শির তৃতীয় মেয়াদের শুরুতে আপাতত কোনো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক প্রতিরোধ আশা করা যাচ্ছে না। কিন্তু তার পরও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য জনপ্রিয় দাবিগুলোর মুখোমুখি হবেন তিনি। ২০১২ সালে যখন শি ক্ষমতায় আসেন তখন থেকে দেশটিতে দুর্নীতি অনেক বেড়েছে। অসমতাও অব্যাহত থেকেছে। প্রলম্বিত শূন্য-কভিড লকডাউন দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ৩ দশমিক ৩ শতাংশ কমিয়েছে, ১৯৭৬ সালের পর থেকে (শুধু ২০২০ সাল বাদে) যা সর্বনি¤œ। জনপ্রিয়তা বাড়ানোর কর্তৃত্ববাদী নেতাদের প্লেবুক কৌশল চীনের অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মনোযোগ সরাতে এবং তাইওয়ানকে জোরপূর্বক দখলে নেয়ার বিষয়টিকে উৎসাহিত করে। তবে ইতিহাস ইঙ্গিত দেয়, চীন এক্ষেত্রে বেশ সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হবে এবং রাশিয়ার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তার ভবিষ্যৎ পদক্ষেপগুলো নেবে। ইউক্রেনের প্রতিরোধ যত বেশি সফল হবে, রাশিয়ার জন্য যুদ্ধটাও অনেক বেশি ব্যয়বহুল হবে। সম্ভবত এর সূত্র ধরে তাইওয়ান প্রণালিজুড়েও শান্তির সুবাতাস আগামীতে বইবে। [স্বত্ব:প্রজেক্ট সিন্ডিকেট] ন্যান্সি কিয়ান: মার্কিন অর্থনীতিবিদ, যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির কেলগ স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের ম্যানেজারিয়েল ইকোনমিক্স অ্যান্ড ডিসিশন সায়েন্সের অধ্যাপক গ্লোবাল পভার্টি রিসার্চ ল্যাবের সহপরিচালক এবং চায়না ইকোনো ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। (ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির, বণিকবার্তার সৌজন্যে )




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com