শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আর প্রাথমিককে এই শিক্ষার মূলভিত্তি বিবেচনা করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষার উপরই মূলত দাঁড়িয়ে থাকে পরবর্তী স্তরের শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন। প্রাথমিক শিক্ষা স্তর যত মজবুত ও শক্ত হবে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শিক্ষাজীবন হবে ততই মসৃণ ও সাফল্যমন্ডতি। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষার উন্নয়নের জন্য যতই চেষ্টা বা শ্রম দেয়া হোক না কেন, তা বিফলে যাবে যদি না প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি করা যায়। কারণ, এই স্তরে শিক্ষার্থীরা যা কিছু শিখবে এবং জানবে তাই তাদের কাজে আসবে। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষার যত প্রসার ঘটবে ততই জাতির মুক্তি ঘটবে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে। আধুনিক বিশ্বের সব দেশেই প্রাথমিক শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে আমাদের দেশে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ঝরে পড়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিশুরা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ হওয়ার পূর্বে যেকোন সময় যেকোন শ্রেণি থেকে বিদ্যালয় ত্যাগ করে লেখাপড়া ছেড়ে দিলে তাকে প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়া বলে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট বিদ্যালয় রয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯১টি। মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ২ কোটি ৯০ হাজার জন। ২০২০ সালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার। ২০২০ সালে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭ দশমিক ২০ শতাংশ। আর ২০২১ সালে সেটি ছিল ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ঝরে পড়ার হার কিছুটা কমলেও এখনো এই হার আশঙ্কাজনক। ঝরে পড়ার অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে। দারিদ্র্য, অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, মেয়ে শিশুকে শিক্ষা না দেয়ার প্রবণতা, তাৎক্ষণিক লাভবান হওয়ার আশা, ভাষার সমস্যা, বিদ্যালয়ের দূরত্ব ইত্যাদি। এর মধ্যে ঝরে পড়ার সবচেয়ে বড় কারণ ধরা হয় দারিদ্র্যকে। দরিদ্র পিতা-মাতা সংসারের খরচ যোগানোর জন্য সন্তানদের স্কুলের পরিবর্তে কাজে পাঠাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাদের অনেকেরই মনোভাব হলো, সন্তান স্কুলের পরিবর্তে কাজে গেলে তাদের পরিবারের আয় বাড়ে, সাপোর্ট হয়। এই সমস্যা সমাধানে সরকার উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বর্তমানে শতভাগ উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে, যা অভিভাবকদের একাউন্টে সরাসরি জমা হয়। উপবৃত্তি পেতে হলে শিক্ষার্থীকে কমপক্ষে মোট পাঠ দিবসের শতকরা ৮৫ দিন বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে হয় এবং পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। উপবৃত্তি ঝরে পড়া রোধে অত্যন্ত কার্যকর একটি পদক্ষেপ।
ঝরে পড়ার আরেকটি কারণ অভিভাকদের অসচেতনতা। দরিদ্র ও অশিক্ষিত পিতা-মাতা অজ্ঞতার কারণে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চায় না। তারা মনে করে, সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে কোনো লাভ নেই, বরং এতে সময় ও অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এটা অনেকটাই নিরসন করা যাচ্ছে মা/অভিভাবক সমাবেশ, উঠান বৈঠক, মতবিনিময় সভা কিংবা হোম ভিজিটের মাধ্যমে। এগুলো যত বেশি বেশি করা যাবে অভিভাবকগণের সচেতনতা ততই বৃদ্ধি পাবে।
ঝরে পড়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে শিশুশ্রম। দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই শিশুদের নানামুখী কাজে লাগিয়ে তাদের শিক্ষাজীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা ঝরে পড়ছে। কোনো কোনো অঞ্চলের শিশুদের ইট ভাটায়, পরিবহন ও সংশ্লিষ্ট কাজে, উপকূলীয় ও হাওর এলাকায় মাছ ধরার কাজে যুক্ত করা হয়। এছাড়া কৃষিকাজে শিশুদের জড়ানো তো নিত্যদিনের চিত্র। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের উদাসীনতা এবং অতি লোভ বিশেষভাবে দায়ী। শিশু শ্রম প্রতিরোধে ইতোমধ্যে শিশুশ্রম নিরোধ আইন ও জাতীয় শিশু নীতি প্রণয়ন করেছে, যা শিশু শ্রম ও ঝরে পড়া রোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ঝরে পড়ার অন্য একটি কারণ বাল্যবিবাহ। দীর্ঘদিন ধরে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার প্রচারণা চালিয়ে আসছে এবং কঠিন বিধি-নিষেধ রয়েছে। কিন্তু তারপরও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশাসনের অগোচরে কিংবা গোপনে অল্প বয়সেই সন্তানদের (বিশেষ করে কন্যা সন্তান) বিয়ে দিচ্ছে অভিভাবকরা। কোনো কোনো স্থানে কেউ কেউ এর প্রতিবাদ করে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া থেকে মুক্ত হচ্ছে। কিন্তু সেই সংখ্যাটি অনেক কম। প্রশাসনের শক্ত নজরদারি ও প্রতিরোধের কারণে বাল্য বিবাহ এখন ব্যপকভাবে কমে এসেছে, যার ফলে ঝরে পড়ার হারও হ্রাস পাচ্ছে। ঝরে পড়া রোধে সরকার আরো যেসকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে এর মধ্যে রয়েছে, বছরের শুরুতে প্রতিটি স্কুলে ক্যাচমেন্ট এলাকা ভিত্তিক শিশু জরিপ পূর্বক ভর্তি নিশ্চিত করা, নিয়মিত মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও হোম ভিজিট কার্যক্রম, বছরের প্রথম দিন শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম, মিড ডে মিল চালু, একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালু ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, স্থানীয় জনগণকে বিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা এবং আনন্দস্কুল প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের অন্যতম দিক হলো বিনোদনের মাধ্যমে শিশুদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলা। লেখাপড়ার মাঝে খেলা ও ছবি আঁকার বিষয়টি পাঠদান কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা পড়ার মাঝে বিনোদন খুঁজে পায়। এ ধারণা থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সাভারে পরিচালনা করছে খেলা ও আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার কার্যক্রম। এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘শিখবে প্রতিটি শিশু’। লেখক: সহকারী শিক্ষক, শাঁকদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।