বিশ্বব্যাপী প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালে বিশ্বে ছয়জনে একজন ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তি হবে, যা ২০১৯ সালে ছিল এগারোজনে একজন। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, ১৯১১ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত প্রবীণ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের কাছাকাছি ছিল, ১৯৬১ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত ছিল প্রায় পাঁচ ভাগের মতো। বর্তমানে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণদের সংখ্যার প্রায় আট ভাগ। সংখ্যায় প্রায় দেড় কোটির মতো। জনসংখ্যা প্রক্ষেপণেও দেখা যায়, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগের বেশি ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ থাকবেন, সংখ্যার হিসেবে প্রায় সাড়ে ৪ কোটির কাছাকাছি। প্রবীণরা পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য অনেক কিছু করেছেন। এখন এসব প্রতিষ্ঠান তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব নেবে, সেটিই স্বাভাবিক। বাস্তবে তা যখন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হচ্ছে না, তখন সরকারের উচিৎ প্রবীণকল্যাণে গৃহীত কর্মসূচির যথাযথ তদারকি ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার লক্ষ্যে সংবিধানে ১৫ (ঘ) ধারা সংযুক্ত করেন (সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার)। ১৯৮২ সালে ভিয়েনায় প্রবীণবিষয়ক সম্মেলন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার প্রবীণ বিষয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে এবং ১৯৮৫-৯০ সালের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রবীণদের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। জাতির পিতার অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী প্রবীণকল্যাণ চিন্তাকে ত্বরান্বিত করতে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে বয়স্কভাতা কর্মসূচি প্রবর্তন করেন। বয়স্কভাতা কর্মসূচি প্রথমে ১০০ টাকা করা হলেও এটি বৃদ্ধি করে ৫০০ টাকা করা হয়। কিন্তু, এ সুবিধা এখনও সব প্রবীণের জন্য নিশ্চিত হয়নি। আবার যারা পাচ্ছেন, দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতির কারণে তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এক্ষেত্রে বয়স্কভাতার পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি সুবিধাভোগীর সংখ্যা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
২০০২ সালে ‘মাদ্রিদ ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন অন এইজিং’ প্রণীত হলে এশিয়ার অনেক দেশ জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা তৈরি করে। বাংলাদেশে এটি প্রণয়ন করতে বেশ সময় লেগে যায়। প্রবীণ নাগরিকদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্রমুক্ত সুস্থ ও নিরাপদ জীবনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩’ অনুমোদন হয়। উল্লেখ্য, এ নীতিমালায় প্রবীণদের জন্য গণপরিবহনে আসন সংরক্ষণ ও পর্যায়ক্রমে হ্রাসকৃত মূল্যে টিকেট সুবিধার কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রবীণ নাগরিকদের জন্য পরিচিতি কার্ড, স্বাস্থ্য কার্ড, প্রবীণ নিবাস, ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন ইত্যাদি সুবিধা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের কথাও বলা হয়। এছাড়া, নীতিমালায় দরিদ্র প্রবীণদের জন্য দারিদ্র্য নিরসন প্রকল্প গ্রহণ করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছে। শুধু তাই নয়, নীতিমালা বাস্তবায়নে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন এবং প্রতিটি জেলা-উপজেলা-ওয়ার্ড পর্যায়ে একটি করে কমিটি করার কথা বলা হয়।
চাকরিজীবী প্রবীণদের জন্য ভবিষ্যৎ তহবিল, গ্রাচ্যুইটি, কল্যাণ তহবিল, যৌথ বীমার সুবিধাসহ নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে, যা প্রসংশনীয়। কিন্তু সিংহভাগ প্রবীণ, যারা কোনো চাকরিতেই ছিলেন না, তাদের কী হবে? প্রবীণ কল্যাণে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন পাশ করেছেন। কিন্তু, এর বাস্তবায়ন আদৌ হচ্ছে কি না বা হলে এর হার কতটুকু, তা বলা মুশকিল। পিতা-মাতাসহ ছয় সদস্যের ভরণপোষণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে, যা প্রবীণ কল্যাণে একটি মাইলফলক উদ্যোগ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ভরণপোষণ না পেয়ে পিতা-মাতা সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে, এটিও মোটেও ভাবা যায় না। কাজেই পিতা-মাতাসহ ছয় সদস্যের ভরণপোষণের বিষয়টি কতখানি কার্যকর, তা বিস্তর গবেষণার দাবি রাখে। একইভাবে বিধবাভাতা কর্মসূচি বাংলাদেশ সরকারের নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। যদিও ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বাগেরহাট, বরিশাল ও সিলেট জেলায় ছয়টি শান্তিনিবাস আছে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এটি স্থাপন করার কথাও রয়েছে, যা বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি। জাতীয় প্রবীণ কমিটি গঠন, চাকরিজীবী প্রবীণদের জন্য ভবিষ্যৎ তহবিল, গ্রাচ্যুইটি, কল্যাণ তহবিল, যৌথ বীমার সুবিধাসহ নানামুখী উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে, এগুলোর যথোপযুক্ত তদারকি ও বাস্তবায়নের প্রতি আন্তরিক না হলে সব উদ্যোগ বিফলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বয়োবৃদ্ধির সক্রিয়তা তত্ত্বে দেখানো হয়েছে, কর্মে নিযুক্ত থাকা প্রবীণরা তুলনামূলক ভালো থাকেন। কাজেই যারা কর্মঠ প্রবীণ তাদের অভিজ্ঞতাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে ভাবা দরকার। খ-কালীন, চুক্তিভিত্তিক, ঘণ্টাভিত্তিক বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন কাজে তাদের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে বদ্ধপরিকর। ২০৪১ সালের মধ্যে রূপকল্প অর্জনেও বাংলাদেশ সরকারও নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সোনার মানুষ প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, সোনার মানুষ তৈরি হবে আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি এবং আত্ম-সমালোচনার মধ্যে দিয়ে। সোনার মানুষ তৈরি এবং সোনার বাংলা বিনির্মাণের জন্য সব শ্রেণির মানুষকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে প্রবীণকল্যাণ কার্যক্রম অনেক বেগবান হয়েছে। কাজেই প্রবীণ নাগরিকরা যে দেশের সম্পদ, সেটি ভাবনায় এনে বাড়াতে হবে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিধি। সরকারের বিদ্যমান উদ্যেগগুলোর যথাযথ তদারকি ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি প্রবীণদের অন্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, পরিবহনসহ বিভিন্ন সেবাপ্রাপ্তি সহজ করতে হবে। তাদের অধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যক্তি, দল, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সরকারি-বেসরকারি সংগঠনসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে। গণমাধ্যমে প্রবীণদের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। প্রবীণ নাগরিকদের পরিবার সম্মাননা চালু করা যেতে পারে এবং সেটি হবে খুবই আকষর্ণীয়, যাতে প্রবীণদের সেবা করার প্রতিযোগিতা শুরু হবে। প্রবীণকল্যাণ ফাউন্ডেশনকে আরও সক্রিয় করতে হবে। অন্যথায়, উন্নয়নকে টেকসই করা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। সমাজ, পরিবার ও দেশে প্রবীণকে বোঝা মনে না করে শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় তাদেরকে কাছে টানি, আস্থাশীল হই, গড়ে তুলি সামাজিক আন্দোলন, বিনির্মাণ করি প্রবীণবান্ধব সমাজ। এটিই হোক প্রবীণ দিবসের মহান ব্রত। লেখক: প্রফেসর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।