মুদ্রাপাচার মূলত বৈধ অথবা অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ, দেশে রাখা নিরাপদ মনে না করা অথবা ভবিষ্যতে দেশ ত্যাগ করে ভিনদেশে স্থায়ী হয়ে সহজে ওই মুদ্রা ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, অবৈধ পন্থায় বিদেশে পাচার করাই মুদ্রাপাচার। মুদ্রাপাচার মানে স্যুটকেস ভরে দেশীয় মুদ্রা বিদেশে নিয়ে যাওয়া নয়। তবে মাঝে মধ্যে বিশেষ ক্ষেত্রে স্যুটকেস ভরেও ডলার পাচার হয়। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) মতে, অর্থপাচার হলো অবৈধ ও অপরাধ থেকে অর্জিত আয়কে বৈধতার আচ্ছাদন দেয়ার প্রক্রিয়া। মানি লন্ডারিংও মুদ্রাপাচারের অন্যতম এবং বহুল আলোচিত উপায়। মানি লন্ডারিংকে রূপক অর্থে বুশ লন্ডারিংও বলে। কারণ ২০০১ সালের নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার হামলা ছিল মূলত মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করার উছিলা। ফলে ক্রুসেডারদের ওপর মুসলমানদের পাল্টা হামলার ভয়ে অর্থ জোগান বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই আমেরিকান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ ‘মানি লন্ডারিং আইন’ করেন।
মুদ্রাপাচারের বিভিন্ন কৌশল: হুন্ডি হলো মুদ্রাপাচারের অন্যতম একটি কৌশল। বাংলাদেশের মুদ্রাপাচারে এ কৌশলটির প্রয়োগ ব্যাপক। এ কৌশলটি সহজভাবে সাধারণ পাঠকের বোঝার উপযোগী করে একটি ঘটনা বর্ণনা করছি। মনে করুন, একজন দুর্নীতিবাজ যার এক কোটি ডলার রয়েছে, যা বৈধ অথবা অবৈধভাবে অর্জিত এবং যার ওপর কোন ট্যাক্স দেয়নি। এই টাকা দুর্নীতিবাজ দেশে রাখা নিরাপদ মনে করে না। সুতরাং কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি কিনবে; কিন্তু দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একজন ব্যক্তিকে এত টাকা বাইরে ইনভেস্ট করতে দেবে না; নিয়মে পড়ে না, সুতরাং ভিন্ন পন্থা অবলম্বন। পন্থা হলো- ধরুন বাংলাদেশের একজন কানাডা থাকে, যিনি মানি লন্ডারিংয়ের সাথে জড়িত। ওই ব্যক্তির কাছে থাকা ডলার দিয়ে দেশের ওই দুর্নীতিবাজের জন্য কানাডায় বাড়ি কিনে দিলো। দুর্নীতিবাজ কানাডার ওই মানি লন্ডারের দেশী ব্যাংক হিসাবে দেশী মুদ্রায় ডলার ইকুইভ্যালেন্ট মূল্যের চেয়ে বেশি রেটে, টাকাটা পাঠিয়ে দিলো।
এখন প্রশ্ন হলো- কানাডার মানি লন্ডার বিদেশে ওই ডলার পায় কোথায়? সে ওই ডলারগুলো পেয়েছে ধরুন মধ্যপ্রাচ্যে তার কিছু ভাই-বন্ধু ও কর্মজীবীর সাথে সম্পর্ক রয়েছে, যারা ডলার ইনকাম করে। এই ডলার বাংলাদেশে তার পরিবারের ব্যাংক হিসেবে পাঠাতে হবে। বৈধভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হলে সে অনেক সমস্যায় পড়ে; যেমন- প্রথমত ব্যাংকের মাধ্যমে লিগাল চ্যানেলে টাকা পাঠাতে হলে সে হুন্ডির রেটের চেয়ে কম রেট পাবে। তার উপরে অফিসিয়াল চ্যানেলে পাঠালে এক্সট্রা আরো ফি লাগবে। অনেক অফিসিয়াল কাগজপত্র আছে সেগুলো পূরণ করতে হবে। বিদেশে কর্মরত অনেক শ্রমিক এই কাগজপত্র পূরণ করতে জানেও না। এমনকি সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করার পর এগুলো করতেও চায় না। কোম্পানির কাজের ব্যস্ততার কারণে ব্যাংকের কর্ম সময়ে ব্যাংকে যাওয়ার সময়ও পায় না। পাশাপাশি বিদেশের মানি লন্ডারের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে উল্লিখিত কোনো ঝামেলাই করতে হয় না। ফলে সহজেই টাকা পাঠাতে পারে দেশে।
অন্য দিকে বিদেশের ওই মানি লন্ডার মধ্যপ্রাচ্যের ওই ভাই-ব্রাদারদের কাছ থেকে যে ডলার পেল তা দিয়ে কানাডায় দেশ থেকে অর্থ পাচারকারীকে বাড়ি কিনে দিলো। দেশের দুর্নীতিবাজ বিদেশের ওই মানি লন্ডারের দেশের ব্যাংক হিসাবে জমা দেয়া এই টাকা লন্ডার মধ্যপ্রাচ্যের টাকা পাঠানো শ্রমিকদের দেশের আত্মীয়স্বজনদের দেশের ব্যাংক হিসাবে স্বাভাবিক রেটের চেয়ে বেশি রেটে জমা দিয়ে দিলো। এটিই হুন্ডি ব্যবসায়। আগেই বলেছি, এই লেনদেনের ক্ষেত্রে মানি লন্ডার টাকা প্রেরণকারী শ্রমিকদের বৈধ রেটের চেয়ে বেশি রেট দেয়। অন্য দিকে বাংলাদেশের পাচারকারী থেকে ডলারের রেট আরো বেশি নেয়। এই দুইয়ের মধ্যের মার্জিনটাই মানি লন্ডারিং মধ্যস্থতাকারীর লাভ। এভাবেই হুন্ডির মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যায়।
এই হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর প্রচলন ভারতীয় উপমহাদেশে ষোলো শতাব্দী থেকেই শুরু হয়। ব্রিটিশরাও উপমহাদেশ শাসনের সময় হুন্ডি সিস্টেমটিকে পরিবর্তন করেনি, কারণ এই কৌশলটি লোকাল অর্থনীতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। খুবই আশ্চর্যের বিষয় হলো- ওই সময় অফিসিয়াল হুন্ডির জন্য ফরম ছাপানো হতো যেখানে ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়ার ছবি ছাপানো থাকত। ঝামেলা হলে আদালতে গিয়ে ডিসমিস করত। অর্থাৎ ব্রিটিশ পিরিয়ডে এটি অবৈধ ছিল না; বরং অফিসিয়াল লেনদেনের মাধ্যম ছিল। আজকের দুনিয়ায় হুন্ডি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আগেই বলেছি, জর্জ বুশ দ্বিতীয়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হুন্ডির অবৈধ আইন করেন একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে।
একটি বিষয় খেয়াল করুন। বাংলাদেশের বর্তমান কার্ব মার্কেটে ডলারের রেট এক ডলার সমান ১১৫ টাকা। একই সময় ব্যাংক রেট মাত্র ৯৫ টাকা; সুতরাং হুন্ডি ব্যবসায় হবে না কেন? কোভিডের কারণে ২০২০-২১ সালে হুন্ডির ব্যবসায় এতটা ভালো চলছিল না; ফলে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল। কিন্তু কোভিডের প্রভাব কমে গেলে আবার হুন্ডি চালু হয় এবং অফিসিয়াল চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ কমে যায়। টাকা পাচারের আরো অনেক পদ্ধতি রয়েছে, নি¤েœ আলোচনা করা হলো। আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও রফতানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং করেও মুদ্রাপাচার হয়। যেমন বিদেশ থেকে কোনো পণ্য আমদানি করল এক কোটি ডলারে; কিন্তু বাস্তবে কাগজে ডিক্লেয়ার করল দেড় কোটি ডলার। এই মার্জিন ৫০ লাখ ডলার বিদেশে পাচার করে দিলো। কারণ হয়তো এটি অবৈধ বা কালো আয়, যা ওই দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী সরকারকে দেখাতে চান না। এ পদ্ধতিটিকে এক কথায় বলা হয় ওভার ইনভয়েসিং। একইভাবে পণ্য রফতানি করার সময় প্রকৃত রফতানি মূল্যের চেয়ে কমমূল্য কাগজে দেখানো বাড়তি অর্থ বিদেশে রেখে দেয়া হয়। যেমন- কোনো ব্যবসায়ী দেড় কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করলেন; কিন্তু কাগজে দেখালেন এক কোটি ডলার। এই মার্জিন ৫০ লাখ ডলার বিদেশে পাচার করল। এ পদ্ধতি হলো আন্ডার ইনভয়েসিং। এমনকি পুরোপুরি খালি কনটেইনার আমদানি, কিংবা এক পণ্যের নামে অন্য কোনো পণ্য আমদানি-রফতানি করার ঘটনাও রয়েছে। এ ছাড়াও ব্যাংকের সাথে মিলে ও ব্যাংক কর্মকর্তার সাথে কারসাজি করে, মোটা অঙ্কের রফতানি বিল দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নেয়া হয়। বাস্তবে এর বিপরীতে কোনো পণ্যই রফতানি হয়নি। রফতানি আয় দেশে ফেরত না এনে ওই অর্থ দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি বাবদ ব্যয় করা। সাম্প্রতিক সময়ে চালু করা রফতানি উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা। মোট কথা, এভাবে নানা উপায়ে বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে অর্থপাচার হয়ে থাকে। এসব কর্মকা-ের সাথে দেশী-বিদেশী আমদানি-রফতানি প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা, প্রভাবশালী নেতা এমনকি ব্যাংকও জড়িত থাকে।
মুদ্রাপাচার কারা করে ও কোথায় করে? ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সের রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের একটি অংশ টাকা পাচার করে ব্যাংকগুলোতে গোপনে রেখে দিয়েছিলেন। পরে সেই তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। ফলে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো ১৯৩৪ সালে ‘সুইস ব্যাংকিং অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন পাস করে যে আইন অনুযায়ী কোনো গ্রাহকের তথ্য সুইস ব্যাংকগুলো প্রকাশ করতে পারবে না। এর পর থেকেই সুইস ব্যাংকগুলোর গোপন হিসাবে অর্থ রাখার প্রবণতা বেড়ে যায়। ত্রিশের দশকের শেষ দিকে জার্মানিতে নাৎসিদের ‘শুদ্ধি’ অভিযান শুরু করলে ইহুদিরা তাদের অর্থ সুইস ব্যাংকে রাখা শুরু করে।
পরবর্তীতে তৃতীয় বিশ্বের দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক শাসক ও রাজনীতিবিদ এবং উন্নত বিশ্বের অসাধু ব্যবসায়ীদের অর্থ লুকিয়ে রাখার বড় জায়গা এই সুইস ব্যাংক। ইদানীং কর ফাঁকি, অপরাধমূলক ও জঙ্গি কর্মকা-ে অর্থায়ন বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে কঠোর অবস্থান থেকে এখন সরে আসতে হচ্ছে তাদের। তবে সুনির্দিষ্ট গ্রাহকের তথ্য তারা এখনো প্রকাশ করে না। এই সুইস ব্যাংকই বাংলাদেশী দুর্নীতিবাজ আমলা, সামরিক-বেসামরিক শাসক ও রাজনীতিবিদের অর্থ রাখার অন্যতম স্থল। শেয়ার মার্কেট লুট, ব্যাংক লুট, বড় বড় মেগা প্রজেক্ট থেকে লুটের টাকা বাংলাদেশী লুটেরারা পাচার করে থাকে সুইস ব্যাংকে। বাংলাদেশীদের সুইস ব্যাংকের অর্থের হিসাব পাওয়া যায় ২০০৪ সাল থেকে।
উল্লেখ্য, আইএলওর সমীক্ষা মতে- বাংলাদেশে আসা মুদ্রার মাত্র ৪০ শতাংশ রেমিট্যান্স বৈধ চ্যানেলেই আসে। বাকি ৬০ শতাংশের ৩০ শতাংশ রেমিট্যান্স বিদেশীরা নিজেরাই নিয়ে আসে অথবা তাদের কোনো আত্মীয়ের মাধ্যমে ক্যাশ পাঠায় এবং বাকি ৩০ শতাংশ হুন্ডিতে আসে। বাংলাদেশ পৃথিবীর ৩০টি সর্বোচ্চ মানি লন্ডারিংয়ের দেশের মধ্যে অন্যতম।
দেশের টাকা কেন বিদেশে পাচার করছে? দেশের ক্ষতি জেনেও মানুষ হুন্ডিতে কেন মুদ্রা পাঠায় সে বিষয়ে কথা আগেই বলেছি। বর্তমানে যদিও সরকার ২.৫ শতাংশ ইনসেনটিভ দিচ্ছে অফিসিয়াল চ্যানেল টাকা পাঠানোর জন্য, এর পরও অনেকেই বাড়তি সুবিধা পাওয়ার জন্য হুন্ডির কাছে যায়। এই প্রক্রিয়া অনৈতিক জেনেও রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরা বিজনেস এথিক্স নিয়ে এত বেশি মাথা ঘামায় না। বিশেষ করে তারা যখন দেখে, কোটি টাকার ঋণ নেয়া দেশের মিলিয়নিয়াররা বিজনেস এথিক্সের ধার ধারে না, ঋণের টাকা আর ফেরত দেয় না; এমনকি তাদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স বড়লোকেরা, নেতারা আবার বিদেশে পাচার করে, তখন তারা নৈতিকতার ধার ধারে না। এমনকি নৈতিকতার কথা বলার নৈতিক শক্তি দেশের সরকারেরও প্রকৃত অর্থে নেই। রেমিট্যান্স প্রেরণকারী ছাড়াও দেশের বড় ব্যবসায়ীরা ডলার পাচার করেন অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) ফাঁকি দেয়ার জন্য। ধরুন, কোনো ব্যবসায়ী যদি উৎপাদনের জন্য দরকারি কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করে তাহলে আমদানিকারক কাঁচামালের ওপর শুল্ক ছাড় পাবেন। তবে ওই কাঁচামাল দিয়ে জিনিসপত্র তৈরি করে বিদেশে রফতানি করলে এই আয় রফতানিকারকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঢোকামাত্রই ওই আয়ের ওপর একটি অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) কাটা হয়। সে কারণে ব্যবসায়ীরা খুবই বাধ্য না হলে বিদেশ থেকে ডলার আর দেশে আনতে চান না। আবার তারা জানেন, পরবর্তী আমদানির জন্য আবারো তো এই ডলার কাজে লাগবে। ফলে ওই ডলার আর দেশীয় মুদ্রায় ভাঙানোর কোনো ঝুঁকি ব্যবসায়ীরা নেন না। ব্যবসায়ীরা অগ্রিম আয়কর থেকে বাঁচার জন্য বিদেশী বায়ারের সাথে যোগসাজশ করে পণ্যের মূল্য রফতানি মূল্যমানের চেয়ে কম দেখায় ও বাকি টাকা হুন্ডিতে সেটেল করে।
নির্বাচনের সাথে টাকা পাচারের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক এরিকা ফ্রান্টজ। আফ্রিকার ৩৬টি দেশের ওপর করা ‘ইলেকশন অ্যান্ড ক্যাপিটাল ফ্লাইট : এভিডেন্স ফ্রম আফ্রিকা’ নামে ওই গবেষণায় ১৯৭১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান, নির্বাচনী চক্রের সাথে পুঁজি পাচারের একটি যোগসূত্র রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলেই দুর্নীতিবাজ নেতা ও আমলাদের অনিশ্চয়তা বেড়ে যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমনটি দেখা গেছে।
যেমন ২০০৬ ও ২০০৭ সালের প্রবল রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা রাখার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। তবে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কঠোর অবস্থান নেয়ায় ২০০৮ সালে অর্থপাচার কমে যায়। আবার ২০১৪ সালের এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা থাকায় এর ঠিক আগে টাকা পাচার আবার বেড়ে যায়। এখন আবার নির্বাচন আসছে এবং ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে যারা অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছে ও ধারণা করছে যে, ক্ষমতা পরিবর্তিত হলে দেশে থাকা সম্ভব হবে না- তারা এখন বেশি মাত্রায় মুদ্রাপাচার করছে। দেখা যাচ্ছে, সুইস ব্যাংকের রমরমা অবস্থা অন্য দেশের যতই কমে যাক, বাংলাদেশীরা সেখানে অর্থ রাখা ক্রমেই বাড়িয়েছে। কারণ বাংলাদেশী পাচারকারীরা দেশের ক্ষমতারই অংশ, ফলে বিপদের সম্ভাবনা কম। নীতিনৈতিকতা ও লাজলজ্জা কম; সুতরাং কে কী বলল তাতে ওদের কিছু আসে-যায় না। নিজের দেশের টাকা কেন বিদেশে পাচার করে, বলতে গেলে আরো বলতে হয়, দেশের অসাধু রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। তারা মনে করেন, তাদের ভবিষ্যৎ সেখানেই, বাংলাদেশে নয়। এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম করার লোভনীয় অফার রয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ তার মধ্যে আছে। কানাডার ‘বেগমপাড়া’ এর বড় উদাহরণ। সেখানে অর্থপাচার করে বাড়ি, ব্যবসায়-বাণিজ্য গড়ে তুলছে অনেক পাচারকারী। দেশে বিনিয়োগের ভালো ক্ষেত্র না থাকা, সুশাসনের অভাব ইত্যাদিও দেশ থেকে অর্থপাচারের কারণ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, অর্থপাচার রোধে যে আইন ও প্রতিষ্ঠানের দরকার, বাংলাদেশের তার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করি না। যা নেই তা হচ্ছে রাজনৈতিক উৎসাহ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ এই ঘোষণা কার্যকর করতে রাজনৈতিকভাবে দৃশ্যমান ও ধারাবাহিক কোনো পদক্ষেপ নেই। আর দুদক প্রকাশ্যে যতই সঠিক কথা বলুক না কেন, প্রভাবশালী কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এ রকম একটি উদাহরণ নেই। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সেটি যে রাজনৈতিকভাবে উপকারী, সেই অনুধাবন না আসা পর্যন্ত কোনো কাজও হবে না। আর সামাজিক ও রাজনৈতিক জবাবদিহির জায়গা শক্তিশালী না হলে এ অনুধাবন আসবে না।
সব শেষে বলতে হয়, বাংলাদেশের উন্নতির জন্য গত ১০ বছরে দেশের খেটে খাওয়া মানুষ, বিকাশমান মধ্যবিত্ত, পেশাজীবী, প্রবাসী শ্রমিক, কৃষকসহ সবাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে আসছেন। আর সেই সময় আমাদের উচ্চবর্গের সুবিধাভোগীরা ঠিকমতো কর দেয়নি, শেয়ারবাজার লুটপাট করেছে, অতিমূল্যায়িত প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছে। সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে পরিশ্রম করেছে অথচ উচ্চবর্গের মানুষদের সেই আস্থা ও বিশ্বাস নেই বলে অর্থপাচার করে। আর রাজনীতিই তাদের রক্ষা করছে। সুতরাং রাজনীতির উচ্চারণ ও আচরণের মধ্যে পার্থক্য থাকলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
অর্থপাচার কিভাবে দেশের জন্য ক্ষতিকর? বৈদেশিক মুদ্রা দেশের অর্থনীতির ব্লাডস্বরূপ। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দেনা-পাওনা শোধ করা হয়। দেশের অর্থনীতির মুদ্রার মান নির্নীত হয়; মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত থাকে। সুতরাং অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশ ও সরকার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার রিজার্ভ হ্রাস হয়। এতে দেশ সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়। দেশীয় টাকা অর্থপাচারের মাধ্যমে বিদেশে চলে যায়। এ টাকা দেশে থাকলে তা বিনিয়োগ ও ভোগে ব্যবহৃত হতো, কর্মসংস্থান ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখত; সুতরাং এতে দেশ ও জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে।
ধরুন, ডলার যদি বিদেশ থেকে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো হতো, তা হলে দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধি পেত। দেশ পণ্য আমদানিতে ব্যবহার করত, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখত। কিন্তু এই ডলার মানি লন্ডারের কাছে গেলে ডলার দেশে আসে না, অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখে না। ফলে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি দেখা দেয় এবং দেশের চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয়; আমদানি প্রবাহ বন্ধ হয়, দেশের উৎপাদন ব্যাহত, বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়, মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। এক সময় দেশ দেউলিয়া হয়ে যায়।
এ ছাড়াও অর্থপাচারের নেপথ্যে থাকে অপরাধমূলক কর্মকা-। সেটি হতে পারে অবৈধ পণ্য আমদানি করা, হতে পারে সন্ত্রাসী বা অবৈধ কোনো উদ্দেশ্যে অর্থপাচার করা, যা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। এতে সরকার শুল্ক ও কর থেকে বঞ্চিত হয়। মোটকথা, নানান দিক থেকে অর্থপাচার দেশ, জাতি ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। তাই একে বর্তমানে একটি বিশেষ অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অর্থপাচার রোধের উপায়: আগেই বলেছি, প্রচলিত উপায়ে অর্থপাচার সম্পূর্ণ বন্ধ করা একদমই অসম্ভব। কারণ ষোলো শতাব্দী থেকে উপমহাদেশে শুরু হওয়া এই কার্যক্রম এখন এতটাই প্রতিষ্ঠিত- এই পন্থা অবৈধ কি না সে কথাও পাচারকারীরা ভুলে গেছে। তবে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও তার কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে।
দেশে কালো টাকাকে সাদা করার বৈধতা মূলত দুর্নীতিকে বৈধতা ও প্রকারন্তে অর্থপাচারকে বৈধতা দেয়ার শামিল; প্রথমে এই কাজ বন্ধ করতে হবে। অর্থপাচার বন্ধের অন্যতম একটি উপায় হতে পারে ধর্মীয় বিধির মাধ্যমে মোটিভেশনের মাধ্যমে নৈতিক মানের উন্নয়ন করে। মানি লন্ডারিং বা বিভিন্ন পন্থায় টাকাপাচার ইসলামী অর্থনীতি ও শরিয়াহ দৃষ্টিতে হারাম এবং নিষিদ্ধ। অবৈধ পন্থায়, যেমন- শেয়ারবাজার লুট, ভুয়া নামে মেগা ব্যাংক ঋণ, অতিমূল্যায়িত প্রকল্প থেকে আত্মসাৎ, মাদকদ্রব্য সরবরাহ, অস্ত্রের ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন হারাম। বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির আলোকে পরিচালিত রাষ্ট্র যদি অর্থপাচার বিষয়ক আইন তৈরি করে, তাহলে শরিয়াহ আইনে করবে, ব্যাংক তা অনুসরণ করবে।অর্থপাচার রোধের আরেকটি উপায় হলো অর্থ উপার্জনের উৎস বৈধ হতে হবে। অধিকন্তু পাচারকৃত আয় বৈধ হোক অথবা অবৈধ হোক, পাঠানোর পন্থা অবৈধ হলে আইনের দৃষ্টিতে দূষণীয় হবে। এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান ও তার প্রয়োগ থাকতে হবে। পাশাপাশি এই অপরাধের শাস্তি থেকে দুনিয়ায় পার পাওয়া গেলেও পরকালে পার পাওয়া যাবে না, এই বিশ্বাস মনে সৃষ্টি করতে হবে। এ ছাড়াও ব্যাংকিং কার্যক্রমে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ে শরিয়াহ মাফিক ব্যাংকিং কার্যক্রম অনুসরণ করলে আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং এবং রফতানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং হবে না; উল্লেখ্য, শরিয়ায় এ ধরনের অপরাধ করার সুযোগ নেই। এখানে আরো উল্লেখ্য, মুদ্রার বেশির ভাগ পাচার কোনো না কোনোভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে হয়; সুতরাং ব্যাংক নৈতিকতা ও শরিয়াহ অনুসরণ করলে মুদ্রাপাচার অনেকটাই কমে যাবে। এ ছাড়াও অবৈধ কোনো পাচারের সাথে নৈতিকভাবে কোনো শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকার সংশ্লিষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং মুদ্রাপাচার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল :mizan12bd@yahoo.com